জলবায়ু ১: গ্রিন হাউজ গ্যাস কি? জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে এর সম্পর্ক কি?
শীতপ্রধান দেশগুলোতে তীব্র শীতের কারণে শাকসবজির চাষ হয় না। এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য জমির ওপর কাচের ঘর বানানো হয়। যেখানে সূর্যের রশ্মি সহজে ঢুকতে পারে কিন্তু বেরিয়ে যেতে পারে না। ফলে ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে শাকসবজি চাষের অনুকূল হয়। এই কাচের ঘরকে বলা হয় গ্রিন হাউজ।
পৃথিবী ঘিরে থাকা বাতাসের বেশকিছু গ্যাসের কারণে গি্রণ হাউজের মতোই পৃথিবীতে সূর্যের রশ্মি সহজে ঢুকতে পারে কিন্তু বেরিয়ে যেতে পারে না। এই গ্যাসগুলোর মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, জলীয় বাষ্প, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরেফ্লোরোকার্বন অন্যতম। এ গুলোকে সম্মিলিতভাবে গি্রন হাউজ গ্যাস বলে। বায়ুমন্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবী ঘিরে একটা চাদর বা কম্বলের মতো অদৃশ্য আবরণ তৈরি হয়েছে। এই কম্বল তাপ ধরে রেখে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে। যাকে বলা হচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশি্বক তাপমাত্রা বৃদ্ধি।
গ্রিন হাউজ মূলত মানুষের উপকারের জন্যই তৈরি করা হয়। কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত তাপমাত্রা শোষণ করার ফলে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাওয়াকে বলা হয় গ্রিন হাউজ ইফেক্ট। বায়ুমন্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাসগুলো একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকলে পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় থাকে। কিন্তু বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্দি পাচ্ছে। যাকে বলা হচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি।
কেন বাড়ছে গ্রিনহাউজ গ্যাস
জাতিসংঘের ক্লাইমেট অ্যাকশন ওয়েবসাইট বলছে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যেমন– কয়লা, খনিজ তৈল এবং গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ নানামুখী ব্যবহারের কারণে বিশ্বের গ্রিন হাউস গ্যাসের ৭০ শতাংশ এবং শুধু কার্বন–ডাই–অক্সাইডের পরিমাণ ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করা ১০টি দেশের তালিকার চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পরেই রয়েছে ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া, ব্রাজিল, জাপান, ইরান ও সৌদি আরব। শিল্পোন্নত হওয়ায় এ সব দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বেশি।
রেফ্রিজারেটর (ফ্রিজ) ও এয়ারকন্ডিশনার ব্যবহার, কোল্ড স্টোরেজ, মশক নিধনে অ্যারোসল ইত্যাদি ক্লোরোফ্লোরোকার্বন নিঃসরণ করে। এই গ্যাস বাতাসের সংস্পর্শে দীর্ঘদিন টিকে থাকে এবং প্রতিনিয়ত বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তরের কাঠামোকে ভেঙে ফেলতে থাকে। ওজোনস্তর ক্রমশ হালকা-পাতলা হয়ে যাওয়াকে বলা হচ্ছে ওজোনস্তরের ‘ফুটো’হয়ে যাওয়া। ওই ফুটো দিয়ে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি ভূপৃষ্ঠে প্রবেশ করতে পারে। ফ্লোরিন ধারণকারী কৃত্রিম গ্যাসগুলোও জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব ফেলে। যদিও শক্তি, শিল্প বা কৃষিকাজের জন্য এ সব গ্যাস নিঃসরণ হয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিসংস্থার মতে, বৈশি্বক গ্রিণহাউস গ্যাসের নিঃসরনের ক্ষেত্রে তৃতীয় অবস্থানে আছে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন। মূলত রাসায়নিক কৃষি ও বহুজাতিক কোম্পানি নির্ভর খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা এই নিঃসরণ ও দূষণ চাঙ্গা রাখে। কৃষক, জেলে, আদিবাসীসহ গ্রামীণ জনগণের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া প্রকৃতিঘনিষ্ঠ। ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে কৃষিতে রাসায়নিকের ব্যবহার বাতাসে মিথেন ও অন্যান্য গ্যাসের পরিমান বাড়িয়েছে।
বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণেও বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন বাড়ছে। গাছপালা কার্বন ধরে রাখে। গাছ কাটা বা পোড়ানো হলে পৃথিবীতে সঞ্চিত কার্বন বায়ুমণ্ডলে নিঃসরিত হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন কি
কোনো একটি জায়গায় বছরের পর বছর ধরে আবহাওয়ার যে গড়, তাকে বলা হয় জলবায়ু। আর জলবায়ু পরিবর্তন বলতে ৩০ বছর বা তার বেশি সময়ে কোনো জায়গার গড় জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদি ও অর্থপূর্ণ পরিবর্তন বোঝায়। জলবায়ু পরিবর্তন একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক ঘটনা। জাতিসংঘের ক্লাইমেট অ্যাকশন ওয়েবসাইট অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তন বলতে বিশ্বের তাপমাত্রা ও জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনকে বোঝায়। সূর্যের কার্যক্রমের পরিবর্তন বা বড় ধরনের আগে্নয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে এই পরিবর্তন হয়। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের তাপমাত্রা বেশিমাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের বিধ্বংসী কার্যক্রমের জন্য।
পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে পাঁচটি স্তর আছে– ট্রপোমন্ডল, স্ট্রাটোমন্ডল, মেসোমন্ডল, তাপমন্ডল ও এক্সোমন্ডল। মাটির সঙ্গে লেগে থাকা স্তরটির নাম ট্রপোমন্ডল। এই স্তরে মেঘ, বৃষ্টিপাত, বজ্রপাত, বায়ুপ্রবাহ, ঝড়, তুষারপাত, শিশির, কুয়াশা সৃষ্টি হয়। এই স্তর অঞ্চলভেদে ৮-১৯ কিলোমিটার কিলোমিটার পর্যন্ত হয়। এর পরের স্তর স্ট্রাটোমন্ডলের বিস্তৃতি ৫০ কিলোমিটার। এই স্তরেই ওজোন গ্যাসের স্তর বেশি পরিমাণে অবস্থান করে। ওজোন স্তর সূর্যের আলোর বেশিরভাগ অতিবেগুনি রশ্মি শুষে নেয়। ফলে পৃথিবীতে সরাসরি সূর্যের তাপ পরে না। সহনীয় মাত্রায় পরে। আবার এই স্তরের ওজোন গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে গেলে তা অধিকমাত্রায় তাপ শোষণ করে। ট্রপোমন্ডলে বায়ুমন্ডলের নানা উপাদান বা গ্যাস একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকে। এই গ্যাসগুলো সূর্য থেকে আসা তাপ স্বাভাবিক মাত্রায় ধরে রেখে পৃথিবীকে মানুষ ও প্রাণীর বাসযোগ্য করে রাখে।
এই কন্টেন্টটি শেয়ার করুন:
Post Comment