সরেজমিন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ
আলতাফ শাহনেওয়াজ
এমন বিষণ্ন সকাল আগে কখনো দেখেনি কেউ। আজ মঙ্গলবার (২২ জুলাই) সকালে সূর্য উঠলেও ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়িতে অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আকাশে সে সূর্যের আলো কালো রঙেই ফুটেছে আজ।
সকাল নয়টায় এ ক্যাম্পাসে পৌঁছে কারও মুখে কোনো আলো দেখা গেল না, গোটা ক্যাম্পাসই যেন নিথর, নিহত। সবার মুখেই বিষাদের তীব্র নীরব ছায়া, আর্তনাদ। মাইলস্টোন কলেজের যে ভবনের সামনে গতকাল সোমবার বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, দেখা গেল, সেই হায়দার আলী ভবনটি ঘিরে রেখেছেন বিমান বাহিনীর সদস্যরা।
চারপাশে এখনো দগদগে হয়ে আছে আগুন লাগার চিহ্ন। কোনো এক শিশুর পোড়া একটি স্কুলব্যাগ হাতে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন একজন। এ ব্যাগটি কার? শিশুটি কি মারা গেছে?—প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসা করা যাবে কার কাছে? উপস্থিত শোকার্ত মানুষেরা নিঃশব্দে চোখ মুছছেন। নির্বাক। কেউবা গতকাল রাত পেরিয়ে এখনো খুঁজে ফিরছেন প্রিয় স্বজনকে। সব মিলিয়ে আজ সকালে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিবেশ ছিল এমনই।
হায়দার আলী ভবনের সামনে দাঁড়াতেই মনে হলো, এক দিন আগেও এই এলাকা ছিল শিশুদের কলকাকলিমুখর। আর আজ সবই সুনসান। সে স্থান এখন অন্তহীন এক বেদনা আর দহনের ভারে যেন ন্যুব্জ। এক অভিভাবক বললেন, ‘এখানে প্রতিদিন বাচ্চারা খেলাধুলা করত। আহারে…।’ কথাটি তিনি আর শেষ করতে পারলেন না।
মাহরিন আপা এত ভালো মানুষ ছিলেন! ঘটনার সময় নিজে পুড়ে গিয়েও অনেক বাচ্চাকে বাঁচিয়েছেন তিনি। বাচ্চাদের বাঁচাতে গিয়ে তাঁর শরীরের ৮০ শতাংশই পুড়ে যায়। নিহত মাহরিন চৌধুরীর সহকর্মী
মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষক শফিকুল ইসলাম টুটুলকে পাওয়া গেল হায়দার আলী ভবনের অদূরেই। ‘বেলা একটার একটু পরেই বিকট একটা আওয়াজ শুনলাম। তারপর পাশের ভবন থেকে ছুটে এসে দেখি আগুন জ্বলছে।’—ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বললেন তিনি। পাশে দাঁড়ানো আরেকজন যোগ করলেন, ‘আসলে শিক্ষক-ছাত্র-সেনাবাহিনী-ফায়ার সার্ভিস সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে। কিন্তু ধ্বংসের মাত্রা এত বেশি যে কারও কিছু করার ছিল না।’
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্যাম্পাসটি বেশ বড়। শিক্ষায়তনটির পূর্বপাশে চারতলা হায়দার আলী ভবনের অবস্থান। এ ভবনে মূলত দ্বিতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণি—স্কুল শাখার ক্লাশ হয়। সকাল আটটা থেকে শুরু হয়ে এ শাখার কার্যক্রম চলে বেলা একটা পর্যন্ত। এরপর শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা আবাসিক থাকে, তারা চলে যায় হোস্টেলে। অনেকেই খাবার খেতে যায় পাশের ক্যান্টিনে। আর অভিভাবকেরা এসে বাড়ি নিয়ে যাবেন, এ অপেক্ষায় থাকে কোনো কোনো শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসের গতকালের দৃশ্যগুলোও এমন ছিল। অন্য দিনের মতো একইভাবে শুরু হয়েছিল ক্লাস। ঠিক দুপুর একটায় বাজল স্কুল শাখার ছুটির ঘণ্টা।
শিশুরা যখন বাড়ি ফিরতে উন্মুখ, তখনই ঘটল দুর্ঘটনাটি। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আরেক শিক্ষক মহিউদ্দিন মুকুল। ব্যবস্থাপনা বিষয়ের এ শিক্ষকের বর্ণনায় তখনকার চিত্রটি শুনে থমকে যাবেন যে কেউ।
হঠাৎ একটা শব্দ হলো, এত জোরে শব্দ হলো যে মনে হলো কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছে। এ সময় দেখি আগুন ওপরে উঠে যাচ্ছে। আমি তখন কী করব, হিতাহিতজ্ঞান ছিল না আমার। অসহায়ের মতো কাঁদছিলাম। মাকে ফোন করে বললাম, ‘মা, বাচ্চারা মারা যাচ্ছে মা, আমি কী করব।’ সানজিদা আক্তার স্মৃতি, শিক্ষার্থী, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ
তিনি বলেন, আমি পাশের ভবনে ছিলাম। হঠাৎ শুনি বিকট শব্দ। এক দৌড়ে ছুটে এলাম। কারণ, এই ভবনেই আমার ভাগ্নি পড়ে। কিন্তু এসে যা দেখলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। হায়দার আলী ভবনের যেখানে সিঁড়ি ও প্রধান প্রবেশদ্বার, দেখলাম, বিমানটি সেখানে বিধ্বস্ত হয়ে এর সামনের অংশ প্রায় ১৫ থেকে ২০ ফুট মাটির গভীরে ঢুকে গেছে। আর বিমানের পেছনের অংশ ভেঙে আঘাত হেনেছে ভবনের দোতলায়। ততক্ষণে আগুন ধরে গেছে গোটা ভবনে। ধোঁয়ায় একাকার চারদিক। বাচ্চারা চিৎকার করছে। কিন্তু সিঁড়ি আর প্রবেশদ্বারের সামনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ায় কেউই বের হতে পারছে না। এর মধ্যে শিক্ষকেরা ছুটে এলেন। কলেজ শাখার শিক্ষার্থীরা ছুটে এল। আর ঘটনার তিন থেকে চার মিনিটের মাথায় এল দিয়াবাড়ির সেনা ক্যাম্পের সদস্যরা। এরপর ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা। সবাই মিলে তখন দ্রুত ভবনের দুইপাশের গ্রিল ভেঙে ২০ থেকে ৩০টি বাচ্চাকে উদ্ধার করে। এ দিনের কথা আমি জীবনে ভুলব না।
ঘটনার মর্মান্তিক বিবরণ দিতে গিয়ে বারবার অশ্রুসজল হয়ে উঠছিল মহিউদ্দিন মুকুলের চোখ। ধরে আসা গলায় তিনি বললেন, ‘স্কুল ছুটির পর যদি শিক্ষার্থীদের অনেকে হোস্টেল বা ক্যান্টিনে না চলে যেত, তাহলে কী যে অবস্থা হতো।’
মানে আরও মৃত্য, আরও পোড়াদেহ! আমরা স্তব্ধ হয়ে যাই। এলমেলো হাঁটতে থাকি। ক্রন্দন ছাড়া এখানে কোনো শব্দ নেই।
‘আমার মিস নাই, আমার মিস নাই।’ বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটি। আজ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে মাকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছিল সে। বারবার তাকাচ্ছিল আগুনে পুড়ে যাওয়া হায়দার আলী ভবনের দিকে। তার টলমলে চোখে অনেক কথা যেন গুমরে মরছে।
গতকাল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন মাইলস্টোন কলেজের দুই শিক্ষক মাহরিন চৌধুরী ও মাসুকা বেগম। মাসুকা ছিলেন স্কুলের ইংরেজি মাধ্যমের ইংরেজি শাখার শিক্ষক। আর মাহরিন পড়াতেন বাংলা মাধ্যমে। ঘটনার সময় ভবনের তিনতলায় ছিলেন মাহরিন। এ শিক্ষকের কথা উঠতেই কেঁদে ফেললেন তাঁর এক সহকর্মী, ‘মাহরিন আপা এত ভালো মানুষ ছিলেন! ঘটনার সময় নিজে পুড়ে গিয়েও অনেক বাচ্চাকে বাঁচিয়েছেন তিনি। বাচ্চাদের বাঁচাতে গিয়ে তাঁর শরীরের ৮০ শতাংশই পুড়ে যায়।’
এরপর আবারও কান্নার রোল। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এমন অঝোর কান্নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকব, এমন সাধ্য কি আমাদের আছে!
ততক্ষণে বয়স্ক হতে শুরু করেছে সকাল। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঢল নেমেছে মানুষের। সেই কোলাহলে হঠাৎ কানে গেল, কে যেন বলছে, ‘যেভাবে যে অবস্থায় পারেন, আমার ভাগ্নিকে খুঁজে দেন।’
কাছে যেতেই বছর ত্রিশের যুবক সাগর হোসেন নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমার ভাগ্নি রাইসা মনি। ক্লাস থ্রিতে পড়ত। আইডি নম্বর: ২০১০। কাল থেকে তাকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। কাল ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত আটটা হাসপাতালে গিয়েছি, বার্ন ইউনিটে গিয়েছি। সারারাত ধরে খুঁজেছি। কোথাও রাইসাকে পাইনি। আপনারা যেভাবে পারেন, আমার ভাগ্নিটার সন্ধান দেন, অন্তত পোশাকটা হলেও দেন।’
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধেশ্বরী শাখায় চাকরিরত সাগর হোসেনের কথা শুনে তাঁকে ঘিরে এর মধ্যেই ভিড় জমে গেছে। আর তিনি বারবার বলছেন, ‘কাল থেকে এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে আমার বোন ও দুলাভাই দুজনই অসুস্থ হয়ে গেছেন। রাইসাকে না পেলে আমরা কী করব এখন!’
ঘুরতে ঘুরতে খানিক বাদে আবার দেখা হলো সাগর হোসেনের সঙ্গে। তখন কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেছেন তিনি। গভীর মমতায় ছুঁয়ে দেখছেন খাতা ও বই। কাছে যেতেই বললেন, ‘এই যে দেখেন, রাইসার খাতা আর বই পেয়েছি।’
ভেজা খাতাটি কেন যে বারবার খুলে-মেলে দেখাচ্ছিলেন সাগর! আগুন নেভানোর সময় পানিতে ভিজলেও খাতার ওপরে ইংরেজি হরফে লেখা ‘রাইসা মনি’ নামটি তখনো জ্বলজ্বল করছে। আর খাতার ভেতর গোটা গোটা অক্ষরে দেখা গেল রাইসার লেখাজোকা। সাগর বললেন, ‘আমার ভাগ্নিটা কি বেঁচে আছে?’
তাঁর এ প্রশ্নে কে কী বলবে, এখানে সবাই-ই নিরুত্তর। তবে বিকেলে অফিসে ফেরার পর জানা গেল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কিছুক্ষণ আগে মারা গেছে রাইসা মনি।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সবুজ মাঠটি এরমধ্যেই লোকজনে গিজগিজ—শিক্ষক, শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী, কে আসেননি! অন্ধকার সূর্যটি তখন মাথার ওপর। গরমে দরদর করে ঘামছেন সবাই। মানুষের ঘাম আর কান্নার নোনাজলের ফারাক করবে, এমন পাষাণ হৃদয় কি কেউ আছেন?
মর্মান্তিক মৃত্যুর এ ঘটনায় ব্যাথিত, ক্ষুব্ধ আজ মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সবাই। ফুঁসছেন এলাকাবাসীও। এ কলেজের বিজ্ঞান শাখার একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সানজিদা আক্তার স্মৃতি। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সময় তিনি ছিলেন ভবনটির পাশেই। ‘কেন আমাদের বাচ্চারা এভাবে মরে যাবে?’ এ প্রশ্ন রেখেই সে সময়ের মর্মন্তুদ বর্ণনা দিলেন তিনি।
কথা বলতে বলতে স্মৃতি চিৎকার করছিলেন, ‘আমি তখন ছিলাম ভবন থেকে একটু দূরে। হঠাৎ একটা শব্দ হলো, এত জোরে শব্দ হলো যে মনে হলো কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছে। এ সময় দেখি আগুন ওপরে উঠে যাচ্ছে। আমি তখন কী করব, হিতাহিতজ্ঞান ছিল না আমার। অসহায়ের মতো কাঁদছিলাম। মাকে ফোন করে বললাম, ‘মা, বাচ্চারা মারা যাচ্ছে মা, আমি কী করব।’
এখনো স্মৃতির কণ্ঠে কান্নাই ঝরে পড়ল। একটু থেমে বললেন, ‘এই মাইলস্টোনে আমি ক্লাস টু থেকে পড়ি। আমাদের ওপর দিয়ে প্রতিদিনই বিমান যায়। পাশেই প্রশিক্ষণ হয়। কেন এই লোকালয় দিয়ে বিমান যাবে? কালকে তো আমি আগুনে পোড়া বাচ্চা দেখেছি। কাল থেকে আর কিছুই খেতে পারিনি। আমাদের বাচ্চাগুলো মরে গেল, আমরা কিছেই করতে পারিনি। কে জবাব দেবে?’
স্মৃতির কথাগুলো কাঁটার মতো কানে বিঁধছে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাথার ওপর থাকা নিকষ সূর্যটি তখন হয়তো তীব্র ক্ষোভেই দপদপ করছে, ফুটছে ওপরে আকাশে। বিষণ্ন বয়সী সকালটি তখন ক্রমাগত গড়াচ্ছে তীব্র দুপুরের দিকে। আর শোকে পাথর হয়ে থাকা এ বিদ্যায়তন থেকে ফিরতে ফিরতে ভাবছি, সাগর ও স্মৃতি যে প্রশ্ন রেখে গেল, তার জবাব কি আমরা দিতে পারব?
লেখক: স্ট্রিমের বাংলা কনটেন্ট এডিটর; কবি
এমন বিষণ্ন সকাল আগে কখনো দেখেনি কেউ। আজ মঙ্গলবার (২২ জুলাই) সকালে সূর্য উঠলেও ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়িতে অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আকাশে সে সূর্যের আলো কালো রঙেই ফুটেছে আজ।
সকাল নয়টায় এ ক্যাম্পাসে পৌঁছে কারও মুখে কোনো আলো দেখা গেল না, গোটা ক্যাম্পাসই যেন নিথর, নিহত। সবার মুখেই বিষাদের তীব্র নীরব ছায়া, আর্তনাদ। মাইলস্টোন কলেজের যে ভবনের সামনে গতকাল সোমবার বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, দেখা গেল, সেই হায়দার আলী ভবনটি ঘিরে রেখেছেন বিমান বাহিনীর সদস্যরা।
চারপাশে এখনো দগদগে হয়ে আছে আগুন লাগার চিহ্ন। কোনো এক শিশুর পোড়া একটি স্কুলব্যাগ হাতে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন একজন। এ ব্যাগটি কার? শিশুটি কি মারা গেছে?—প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসা করা যাবে কার কাছে? উপস্থিত শোকার্ত মানুষেরা নিঃশব্দে চোখ মুছছেন। নির্বাক। কেউবা গতকাল রাত পেরিয়ে এখনো খুঁজে ফিরছেন প্রিয় স্বজনকে। সব মিলিয়ে আজ সকালে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিবেশ ছিল এমনই।
হায়দার আলী ভবনের সামনে দাঁড়াতেই মনে হলো, এক দিন আগেও এই এলাকা ছিল শিশুদের কলকাকলিমুখর। আর আজ সবই সুনসান। সে স্থান এখন অন্তহীন এক বেদনা আর দহনের ভারে যেন ন্যুব্জ। এক অভিভাবক বললেন, ‘এখানে প্রতিদিন বাচ্চারা খেলাধুলা করত। আহারে…।’ কথাটি তিনি আর শেষ করতে পারলেন না।
মাহরিন আপা এত ভালো মানুষ ছিলেন! ঘটনার সময় নিজে পুড়ে গিয়েও অনেক বাচ্চাকে বাঁচিয়েছেন তিনি। বাচ্চাদের বাঁচাতে গিয়ে তাঁর শরীরের ৮০ শতাংশই পুড়ে যায়। নিহত মাহরিন চৌধুরীর সহকর্মী
মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষক শফিকুল ইসলাম টুটুলকে পাওয়া গেল হায়দার আলী ভবনের অদূরেই। ‘বেলা একটার একটু পরেই বিকট একটা আওয়াজ শুনলাম। তারপর পাশের ভবন থেকে ছুটে এসে দেখি আগুন জ্বলছে।’—ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বললেন তিনি। পাশে দাঁড়ানো আরেকজন যোগ করলেন, ‘আসলে শিক্ষক-ছাত্র-সেনাবাহিনী-ফায়ার সার্ভিস সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে। কিন্তু ধ্বংসের মাত্রা এত বেশি যে কারও কিছু করার ছিল না।’
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্যাম্পাসটি বেশ বড়। শিক্ষায়তনটির পূর্বপাশে চারতলা হায়দার আলী ভবনের অবস্থান। এ ভবনে মূলত দ্বিতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণি—স্কুল শাখার ক্লাশ হয়। সকাল আটটা থেকে শুরু হয়ে এ শাখার কার্যক্রম চলে বেলা একটা পর্যন্ত। এরপর শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা আবাসিক থাকে, তারা চলে যায় হোস্টেলে। অনেকেই খাবার খেতে যায় পাশের ক্যান্টিনে। আর অভিভাবকেরা এসে বাড়ি নিয়ে যাবেন, এ অপেক্ষায় থাকে কোনো কোনো শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসের গতকালের দৃশ্যগুলোও এমন ছিল। অন্য দিনের মতো একইভাবে শুরু হয়েছিল ক্লাস। ঠিক দুপুর একটায় বাজল স্কুল শাখার ছুটির ঘণ্টা।
শিশুরা যখন বাড়ি ফিরতে উন্মুখ, তখনই ঘটল দুর্ঘটনাটি। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আরেক শিক্ষক মহিউদ্দিন মুকুল। ব্যবস্থাপনা বিষয়ের এ শিক্ষকের বর্ণনায় তখনকার চিত্রটি শুনে থমকে যাবেন যে কেউ।
হঠাৎ একটা শব্দ হলো, এত জোরে শব্দ হলো যে মনে হলো কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছে। এ সময় দেখি আগুন ওপরে উঠে যাচ্ছে। আমি তখন কী করব, হিতাহিতজ্ঞান ছিল না আমার। অসহায়ের মতো কাঁদছিলাম। মাকে ফোন করে বললাম, ‘মা, বাচ্চারা মারা যাচ্ছে মা, আমি কী করব।’ সানজিদা আক্তার স্মৃতি, শিক্ষার্থী, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ
তিনি বলেন, আমি পাশের ভবনে ছিলাম। হঠাৎ শুনি বিকট শব্দ। এক দৌড়ে ছুটে এলাম। কারণ, এই ভবনেই আমার ভাগ্নি পড়ে। কিন্তু এসে যা দেখলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। হায়দার আলী ভবনের যেখানে সিঁড়ি ও প্রধান প্রবেশদ্বার, দেখলাম, বিমানটি সেখানে বিধ্বস্ত হয়ে এর সামনের অংশ প্রায় ১৫ থেকে ২০ ফুট মাটির গভীরে ঢুকে গেছে। আর বিমানের পেছনের অংশ ভেঙে আঘাত হেনেছে ভবনের দোতলায়। ততক্ষণে আগুন ধরে গেছে গোটা ভবনে। ধোঁয়ায় একাকার চারদিক। বাচ্চারা চিৎকার করছে। কিন্তু সিঁড়ি আর প্রবেশদ্বারের সামনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ায় কেউই বের হতে পারছে না। এর মধ্যে শিক্ষকেরা ছুটে এলেন। কলেজ শাখার শিক্ষার্থীরা ছুটে এল। আর ঘটনার তিন থেকে চার মিনিটের মাথায় এল দিয়াবাড়ির সেনা ক্যাম্পের সদস্যরা। এরপর ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা। সবাই মিলে তখন দ্রুত ভবনের দুইপাশের গ্রিল ভেঙে ২০ থেকে ৩০টি বাচ্চাকে উদ্ধার করে। এ দিনের কথা আমি জীবনে ভুলব না।
ঘটনার মর্মান্তিক বিবরণ দিতে গিয়ে বারবার অশ্রুসজল হয়ে উঠছিল মহিউদ্দিন মুকুলের চোখ। ধরে আসা গলায় তিনি বললেন, ‘স্কুল ছুটির পর যদি শিক্ষার্থীদের অনেকে হোস্টেল বা ক্যান্টিনে না চলে যেত, তাহলে কী যে অবস্থা হতো।’
মানে আরও মৃত্য, আরও পোড়াদেহ! আমরা স্তব্ধ হয়ে যাই। এলমেলো হাঁটতে থাকি। ক্রন্দন ছাড়া এখানে কোনো শব্দ নেই।
‘আমার মিস নাই, আমার মিস নাই।’ বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটি। আজ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে মাকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছিল সে। বারবার তাকাচ্ছিল আগুনে পুড়ে যাওয়া হায়দার আলী ভবনের দিকে। তার টলমলে চোখে অনেক কথা যেন গুমরে মরছে।
গতকাল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন মাইলস্টোন কলেজের দুই শিক্ষক মাহরিন চৌধুরী ও মাসুকা বেগম। মাসুকা ছিলেন স্কুলের ইংরেজি মাধ্যমের ইংরেজি শাখার শিক্ষক। আর মাহরিন পড়াতেন বাংলা মাধ্যমে। ঘটনার সময় ভবনের তিনতলায় ছিলেন মাহরিন। এ শিক্ষকের কথা উঠতেই কেঁদে ফেললেন তাঁর এক সহকর্মী, ‘মাহরিন আপা এত ভালো মানুষ ছিলেন! ঘটনার সময় নিজে পুড়ে গিয়েও অনেক বাচ্চাকে বাঁচিয়েছেন তিনি। বাচ্চাদের বাঁচাতে গিয়ে তাঁর শরীরের ৮০ শতাংশই পুড়ে যায়।’
এরপর আবারও কান্নার রোল। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এমন অঝোর কান্নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকব, এমন সাধ্য কি আমাদের আছে!
ততক্ষণে বয়স্ক হতে শুরু করেছে সকাল। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঢল নেমেছে মানুষের। সেই কোলাহলে হঠাৎ কানে গেল, কে যেন বলছে, ‘যেভাবে যে অবস্থায় পারেন, আমার ভাগ্নিকে খুঁজে দেন।’
কাছে যেতেই বছর ত্রিশের যুবক সাগর হোসেন নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমার ভাগ্নি রাইসা মনি। ক্লাস থ্রিতে পড়ত। আইডি নম্বর: ২০১০। কাল থেকে তাকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। কাল ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত আটটা হাসপাতালে গিয়েছি, বার্ন ইউনিটে গিয়েছি। সারারাত ধরে খুঁজেছি। কোথাও রাইসাকে পাইনি। আপনারা যেভাবে পারেন, আমার ভাগ্নিটার সন্ধান দেন, অন্তত পোশাকটা হলেও দেন।’
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধেশ্বরী শাখায় চাকরিরত সাগর হোসেনের কথা শুনে তাঁকে ঘিরে এর মধ্যেই ভিড় জমে গেছে। আর তিনি বারবার বলছেন, ‘কাল থেকে এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে আমার বোন ও দুলাভাই দুজনই অসুস্থ হয়ে গেছেন। রাইসাকে না পেলে আমরা কী করব এখন!’
ঘুরতে ঘুরতে খানিক বাদে আবার দেখা হলো সাগর হোসেনের সঙ্গে। তখন কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেছেন তিনি। গভীর মমতায় ছুঁয়ে দেখছেন খাতা ও বই। কাছে যেতেই বললেন, ‘এই যে দেখেন, রাইসার খাতা আর বই পেয়েছি।’
ভেজা খাতাটি কেন যে বারবার খুলে-মেলে দেখাচ্ছিলেন সাগর! আগুন নেভানোর সময় পানিতে ভিজলেও খাতার ওপরে ইংরেজি হরফে লেখা ‘রাইসা মনি’ নামটি তখনো জ্বলজ্বল করছে। আর খাতার ভেতর গোটা গোটা অক্ষরে দেখা গেল রাইসার লেখাজোকা। সাগর বললেন, ‘আমার ভাগ্নিটা কি বেঁচে আছে?’
তাঁর এ প্রশ্নে কে কী বলবে, এখানে সবাই-ই নিরুত্তর। তবে বিকেলে অফিসে ফেরার পর জানা গেল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কিছুক্ষণ আগে মারা গেছে রাইসা মনি।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সবুজ মাঠটি এরমধ্যেই লোকজনে গিজগিজ—শিক্ষক, শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী, কে আসেননি! অন্ধকার সূর্যটি তখন মাথার ওপর। গরমে দরদর করে ঘামছেন সবাই। মানুষের ঘাম আর কান্নার নোনাজলের ফারাক করবে, এমন পাষাণ হৃদয় কি কেউ আছেন?
মর্মান্তিক মৃত্যুর এ ঘটনায় ব্যাথিত, ক্ষুব্ধ আজ মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সবাই। ফুঁসছেন এলাকাবাসীও। এ কলেজের বিজ্ঞান শাখার একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সানজিদা আক্তার স্মৃতি। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সময় তিনি ছিলেন ভবনটির পাশেই। ‘কেন আমাদের বাচ্চারা এভাবে মরে যাবে?’ এ প্রশ্ন রেখেই সে সময়ের মর্মন্তুদ বর্ণনা দিলেন তিনি।
কথা বলতে বলতে স্মৃতি চিৎকার করছিলেন, ‘আমি তখন ছিলাম ভবন থেকে একটু দূরে। হঠাৎ একটা শব্দ হলো, এত জোরে শব্দ হলো যে মনে হলো কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছে। এ সময় দেখি আগুন ওপরে উঠে যাচ্ছে। আমি তখন কী করব, হিতাহিতজ্ঞান ছিল না আমার। অসহায়ের মতো কাঁদছিলাম। মাকে ফোন করে বললাম, ‘মা, বাচ্চারা মারা যাচ্ছে মা, আমি কী করব।’
এখনো স্মৃতির কণ্ঠে কান্নাই ঝরে পড়ল। একটু থেমে বললেন, ‘এই মাইলস্টোনে আমি ক্লাস টু থেকে পড়ি। আমাদের ওপর দিয়ে প্রতিদিনই বিমান যায়। পাশেই প্রশিক্ষণ হয়। কেন এই লোকালয় দিয়ে বিমান যাবে? কালকে তো আমি আগুনে পোড়া বাচ্চা দেখেছি। কাল থেকে আর কিছুই খেতে পারিনি। আমাদের বাচ্চাগুলো মরে গেল, আমরা কিছেই করতে পারিনি। কে জবাব দেবে?’
স্মৃতির কথাগুলো কাঁটার মতো কানে বিঁধছে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাথার ওপর থাকা নিকষ সূর্যটি তখন হয়তো তীব্র ক্ষোভেই দপদপ করছে, ফুটছে ওপরে আকাশে। বিষণ্ন বয়সী সকালটি তখন ক্রমাগত গড়াচ্ছে তীব্র দুপুরের দিকে। আর শোকে পাথর হয়ে থাকা এ বিদ্যায়তন থেকে ফিরতে ফিরতে ভাবছি, সাগর ও স্মৃতি যে প্রশ্ন রেখে গেল, তার জবাব কি আমরা দিতে পারব?
লেখক: স্ট্রিমের বাংলা কনটেন্ট এডিটর; কবি
পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে ঠিক এভাবেই হেনস্থার শিকার হচ্ছেন বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকেরা। লাগাতার সেই আক্রমণ প্রবল হয়ে উঠেছে। এর বিরুদ্ধে সড়কে নামতে বাধ্য হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
২ দিন আগেশেখ হাসিনার সমর্থকেরা নিজেদের এ স্থানকে দুর্ভেদ্য ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনাই শুধু করেনি, প্রতিপক্ষ দলের কার্যক্রমকে তাদের প্রভাবের ওপর হুমকি হিসেবেও দেখেছেন। এমন মনোভাব আদতে শেখ পরিবারের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতার নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
৬ দিন আগেবন্য প্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুম হিসেবে বছরের জুন থেকে আগস্ট—তিন মাস সুন্দরবনে জেলে, বাওয়ালীসহ পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও থামছে না হরিণশিকারিদের তৎপরতা। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে গড়ে উঠেছে একাধিক হরিণশিকারি চক্র।
৮ দিন আগেআওয়ামী লীগের শাসনামলে গোপন বন্দিশালায় দায়িত্বরতদের কেউ কেউ বন্দীদের নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বন্দীদের ওপর যে ধরনের অত্যাচার চালানোর নির্দেশ দিতেন, বাহিনীর সদস্যদের অনেকেই তা পুরোপুরি পালন করতেন না।
১০ দিন আগে