leadT1ad

হঠাৎ কেন সরে গেলেন খোদা বকশ চৌধুরী

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা

প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২: ৪৮
খোদা বকশ চৌধুরীর হঠাৎ পদত্যাগ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। স্ট্রিম গ্রাফিক

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) খোদা বকশ চৌধুরীর হঠাৎ পদত্যাগ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। অথচ একদিন আগেও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর শপথ নেওয়ার গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল। বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) রাতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় নির্বাহী ক্ষমতা অনুশীলনের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ সহকারী খোদা বকশ চৌধুরীর পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতি গ্রহণ করেছেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হলেও কার্যত মন্ত্রণালয় চালাতেন খোদা বকশ চৌধুরী। আইনশৃঙ্খলার বিষয়টিও তিনি দেখতেন। এতে প্রায়ই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হতো।

সম্প্রতি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্যও এই টানাপোড়েনকে দায়ী করেছেন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ইতোমধ্যে ২৩ ডিসেম্বর উপদেষ্টা পরিষদে রদবদলের সিদ্ধান্তের গুঞ্জন শোনা যায়। পাশাপাশি পুলিশের উচ্চপর্যায়েও বড় ধরনের পরিবর্তনের কথা শোনা যায়।

বলা হয়েছিল, বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা রেখে বর্তমান নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানকে নতুন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা করা হবে। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আপত্তির মুখে খলিলুর রহমানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।

এ ছাড়া রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাহিনী ও সংস্থারও তাঁর বিষয়ে আপত্তি আছে বলে জানা গেছে। তাঁকে স্বরাষ্ট্রের দায়িত্ব দিলে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সহায়তা পাওয়া যাবে না—এমন আশঙ্কা ছিল। এতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে, যা নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে তুলবে। তাই বর্তমান উপদেষ্টাদের মধ্যে কাউকে স্বরাষ্ট্রের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে বলে আলোচনা ছিল।

সোমবার সচিবালয়ে পদত্যাগ নিয়ে গুঞ্জন বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘পদত্যাগ করলে এখানে বসতাম না।’

অন্যদিকে আরেকটি সরকারি সূত্র জানিয়েছিল, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে সরিয়ে খোদা বকশ চৌধুরীকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে উপদেষ্টাদের মধ্যে মতভেদ তৈরি হওয়ায় আগের অবস্থান থেকে সরে আসেন প্রধান উপদেষ্টা।

উপদেষ্টা পরিষদে রদবদল নিয়ে জানতে চাইলে বিষয়টিকে গুঞ্জন বলে উড়িয়ে দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ। মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন হচ্ছে—এমন কোনো তথ্য আমার জানা নেই।’

সূত্র জানিয়েছে, উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন—এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় খোদা বকশ চৌধুরী পদত্যাগ করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘তাঁর এই পদত্যাগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে, তা সামনের দিনগুলোতে বলা যাবে। এখন কিছু বলা যাবে না। ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ না, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সিস্টেম। এ ছাড়া যারা মাঠে কাজ করেন, তাঁদের কতটা উজ্জীবিত করা যায়, সেটিও এখানে ব্যাপার। তাঁরা যদি সঠিকভাবে কাজ না করেন, তাহলে বদল কিংবা পদত্যাগ দিয়ে কিছু হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে সঠিক নেতৃত্বও থাকতে হবে। নেতৃত্ব ভালো না হলে মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের উজ্জীবিত করা যাবে না। একজন পদত্যাগ করায় আরও ভালো কেউ দায়িত্ব পাবেন। যোগ্য কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হলেও কার্যত মন্ত্রণালয় চালাতেন খোদা বকশ চৌধুরী। আইনশৃঙ্খলার বিষয়টিও তিনি দেখতেন। এতে প্রায়ই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হতো।

সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি নাজমুল হক বলেন, ‘পদত্যাগ করলে তো কোনো সমাধান আসে না। পদত্যাগ করার পরে ওই পদে যদি আরও ভালো কাউকে অধিষ্ঠিত করা হয়, সে যদি সমাধান করতে পারে—এই একটা সুযোগ সৃষ্টি হলো। সে নিজে মনে করছে যে আমি এটা সমাধান করতে পারব না, আমি স্টেপ ডাউন করছি, আমি পদত্যাগ করছি।’

তবে নতুন কেউ এসে দায়িত্ব নিয়ে সমস্যার সমাধানের সুযোগ তৈরি করে দেয় বলে জানান সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা।

১৯৭৯ সালে পুলিশে যোগ দেওয়া খোদা বকশ আইজিপির দায়িত্ব পান ২০০৬ সালের নভেম্বরে; বিএনপি জোট সরকারের শেষ দিকে। জোট সরকার দায়িত্ব হস্তান্তরের পর রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও তিনি আইজিপির দায়িত্ব পালন করেন।

পরে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিলে তাঁকে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। এরপর ২০১০ সালের মার্চে স্বেচ্ছায় অবসরে যান খোদা বকশ।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত বছরের ১০ নভেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে তাঁকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেয়।

তখন খোদা বকশ চৌধুরী ছাড়াও আরও দুজনকে বিশেষ সহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের সহযোগিতার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ জন্য তাঁদের ওই সব মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছিল।

স্বাস্থ্যের দায়িত্ব পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক সায়েদুর রহমান এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন অধ্যাপক এম আমিনুল ইসলাম। গত ১০ মার্চ আমিনুল ইসলামও পদত্যাগ করেছিলেন। তখন তাঁকে শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে—এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল।

কিন্তু গত ৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও মানবাধিকারকর্মী সি আর আবরারকে শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পাঁচ দিন পর পদত্যাগ করেন অধ্যাপক আমিনুল।

এদিকে, শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে ইনকিলাব মঞ্চ। সংগঠনটি ২০ ডিসেম্বর শাহবাগে সমাবেশ থেকে ওসমান হাদির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে অগ্রগতি জানাতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) খোদা বকশ চৌধুরীকে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে জবাব দিতে না পারলে তাঁদের পদত্যাগ দাবি করে ইনকিলাব মঞ্চ।

তখন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল জাবের দুটি দাবি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা (জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী) ও সহকারী উপদেষ্টাকে (খোদা বকশ চৌধুরী) জনতার সামনে এসে বলতে হবে, গত এক সপ্তাহে তাঁরা কতটুকু এগিয়েছেন। এর জবাব দিতে না পারলে তাঁদের অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। সিভিল-মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের (সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা) মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা আওয়ামী সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করুন।’

ইতোমধ্যে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও মানুষের মধ্যে নানা কথা হচ্ছে। তবে কী কারণে তিনি পদত্যাগ করেছেন, তা তাৎক্ষণিকভাবে সুনির্দিষ্ট করে জানা যায়নি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত