leadT1ad

‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’র গতিরোধ করে অ্যাকটিভিস্টদের আটক করেছে ইসরায়েল

স্ট্রিম ডেস্ক
ইসরায়েলি নৌবাহিনী গাজামুখী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নৌবহরের গতিরোধ করে। ছবি: সংগৃহীত।

ইসরায়েলি নৌবাহিনী গাজামুখী ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ নৌবহরের গতিরোধ করে সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ২০০ জন বা আরও বেশি অ্যাকটিভিস্টকে আটক করেছে। বুধবার রাতে আটকের এই ঘটনা ঘটে গাজা উপত্যকা থেকে ৭০-৭৫ নটিকাল মাইল দূরে আন্তর্জাতিক পানিসীমায়। এতে ফ্লোটিলার আয়োজকরাসহ কয়েকটি দেশের সরকার নিন্দা জানিয়েছে।

বহরে ছিল প্রায় ৪৪ থেকে ৪৭টি নৌযান। এতে অংশ নেয় ৪৪টি দেশের প্রায় ৫০০ কর্মী। তারা খাদ্য, ওষুধ, ও পানি পরিশোধক নিয়ে গাজায় যাচ্ছিল। সংগঠকরা একে শান্তিপূর্ণ মানবিক উদ্যোগ বলে আখ্যা দেন। তারা বলেন, এর লক্ষ্য ছিল ২০০৭ সাল থেকে গাজার ওপর আরোপিত ইসরায়েলি অবরোধ ভাঙা।

যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন স্পেন ও ইতালির ইউরোপীয় সংসদ সদস্যরা। এছাড়া ছিলেন আইনজীবী, সাংবাদিক এবং খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বাংলাদেশের আলোকচিত্র শিল্পী শহীদুল আলম, সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তী নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি মান্ডলা ম্যান্ডেলা। এছাড়া ছিলেন ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুধবার (১ অক্টোবর) রাত সাড়ে ৮টার দিকে গাজা উপকূল থেকে প্রায় ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে তাদের উপর অভিযান চালানো হয়। ইসরায়েলি বাহিনী অন্তত ১৩টি নৌযান আটক করে। এর মধ্যে ছিল ডেইর ইয়াসিন/মালি, হুগা, স্পেকট্রা, আদারা, আলমা এবং সিরিয়াস। কয়েকটি নৌযানে পানি কামান ও ধাক্কার মতো আক্রমণও চালানো হয়।

গ্লোবাল সুমুদ বহরের মুখপাত্র সাইফ আবুকেশেক জানিয়েছেন, আটক নৌযানগুলোতে ৩৭টি দেশের ২০১ জনের বেশি মানুষ ছিলেন। এর মধ্যে স্পেন থেকে ৩০ জন, ইতালি থেকে ২২ জন, তুরস্ক থেকে ২১ জন এবং মালয়েশিয়া থেকে ১২ জন ছিলেন।

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার নৌবহর। ছবি: সংগৃহীত।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার নৌবহর। ছবি: সংগৃহীত।

অ্যাকটিভিস্টরা অভিযোগ করেছেন, ইসরায়েল তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং ক্যামেরা ও লাইভস্ট্রিম বন্ধ করে দেয়। ফলে বহরটি বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে কোনো যাত্রী আহত হননি। ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অভিযানটি নিরাপদে সম্পন্ন হয়েছে। তারা একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যেখানে দেখা যায়, এক সৈন্য থুনবার্গকে তাঁর জিনিসপত্র ফিরিয়ে দিচ্ছে।

ইসরায়েলি সরকার জানিয়েছে, বহরটি যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে যাচ্ছিল এবং গাজার ওপর নৌ অবরোধ ভঙ্গ করছিল। তাদের দাবি, বহরের সঙ্গে হামাসের সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইসরায়েল বলেছে, সহায়তা সরবরাহ করতে চাইলে তা ইসরায়েলি বন্দর দিয়ে পাঠানো উচিত।

জাতিসংঘে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন জানান, আটক কর্মীদের ২ অক্টোবর ইয়োম কিপ্পুর শেষে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। অভিযানের জন্য ইসরায়েলি নৌবাহিনী আগে থেকেই জেটবিমান ও নৌযান মোতায়েন করেছিল। তারা ড্রোন নজরদারির মতো ভয় দেখানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

ফ্লোটিলার আয়োজকরা ইসরায়েলের এই পদক্ষেপকে অবৈধ ও আন্তর্জাতিক পানিসীমায় জলদস্যুতা হিসেবে নিন্দা করেছেন। তাঁদের দাবি, এই মিশন কোনো আইন ভঙ্গ করেনি। বরং ইসরায়েল গাজায় ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

এক ভিডিও বার্তায় মার্কিন অ্যাকটিভিস্ট লাইলা হেগাজি তাঁর আটককে ইসরায়েলি বাহিনীর অপহরণ বলে বর্ণনা করেন। তিনি আন্তর্জাতিক মহলকে আহ্বান জানান যেন চলমান সংঘাতে সহযোগিতা বন্ধ করা হয়।

ব্রাজিলীয় অ্যাকটিভিস্ট থিয়াগো অ্যাভিলা বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ ও অহিংস মানবিক মিশনে এসেছি।’ আটক অভিযান সত্ত্বেও বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) পর্যন্ত প্রায় ৩০টি নৌযান গাজার পথে অগ্রসর হচ্ছিল। তারা এখন গাজা থেকে ৪৫ নটিকাল মাইল দূরে রয়েছে।

ঘটনাটি আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে ‘সন্ত্রাসী কার্যকলাপ’ এবং ‘আন্তর্জাতিক আইনের মারাত্মক লঙ্ঘন’ বলে আখ্যা দেয়। তুরস্ক তার নাগরিকদের দ্রুত মুক্তির দাবিও জানায়। হামাস বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতাকামীদের এই পদক্ষেপের নিন্দা জানাতে আহ্বান জানায়।

ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি জানান, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েছে যে কোনো সহিংসতা করা হবে না। আটক নৌযানগুলোকে আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হবে এবং আটক অ্যাকটিভিস্টদেরও কয়েক দিনের মধ্যে ফেরত পাঠানো হবে। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-নোয়েল বারো ঘটনাটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন, যাতে নিরাপদে বোর্ডিং নিশ্চিত হয়।

অ্যাকটিভিস্টদের গ্রেফতার করছে ইসরায়েলি বাহিনী। ছবি: সংগৃহীত।
অ্যাকটিভিস্টদের গ্রেফতার করছে ইসরায়েলি বাহিনী। ছবি: সংগৃহীত।

ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির আগে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে তাঁদের সঙ্গে ‘সন্ত্রাসী পর্যায়ের’ আচরণ করা হবে। এখন সেই পরিকল্পনাই কার্যকর হচ্ছে। জিএসএফ প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, আটক যাত্রীরা হাতে পাসপোর্ট ধরে আছেন। তাঁরা ঘোষণা দিচ্ছেন, তাঁরা অহিংস মিশনে অংশ নিতে গিয়ে জোরপূর্বক অপহৃত হয়েছেন।

এদিকে এথেন্স, রোম, বার্লিন, ব্রাসেলস, তিউনিস এবং আঙ্কারায় ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। ইতালির বৃহত্তম শ্রমিক ইউনিয়ন ৩ অক্টোবর সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।

এর আগেও ২০২৫ সালের জুনে ইসরায়েলি বাহিনী ম্যাডলিন নামের নৌযান থেকে গ্রেটা থুনবার্গসহ কয়েকজনকে আটক করেছিল। ফলে এবার গ্রেটা থুনবার্গকে দ্বিতীয়বারের মতো আটক করা হল। ২০১০ সালের একটি বহরে ইসরায়েলি অভিযানে নয়জনের মৃত্যু হয়।

গ্লোবাল সুমুদ বহর শুরুতে ইতালি, স্পেন ও তুরস্কের নৌযানের এসকর্টে চলেছিল। তবে ইসরায়েলি পানিসীমার কাছে এসে তারা সরে দাঁড়ায়।

গ্রেটা থুনবার্গের উপস্থিতি ঘটনাটিকে বিশ্বজুড়ে আরও আলোচনায় নিয়ে আসে। সমর্থকরা এটিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবিক সহায়তার অধিকারের ওপর আঘাত হিসেবে দেখছেন। জাতিসংঘের প্রস্তাবের উল্লেখ করে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন জানিয়েছে, এই অবরোধ মানবিক আইনের পরিপন্থী।

এখনও অবশিষ্ট নৌযানগুলো এগোচ্ছে। পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ রয়ে গেছে। আবারও আটক অভিযান হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আটককৃত কর্মীদের ৭২ থেকে ৯৬ ঘণ্টার মধ্যে ফেরত পাঠানো হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদি আটক হলে গণমাধ্যমে আলোচনার ঝড় আরও জোরদার হবে।

ঘটনাটি এমন এক সময়ে ঘটছে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গাজার জন্য একটি শান্তি পরিকল্পনা দিয়েছেন। বহরের অংশগ্রহণকারীরা সেটিকে ফিলিস্তিনিদের মানবিক মর্যাদার প্রতি অবমাননা হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছে।

এ ঘটনায় গাজায় মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার এবং যুদ্ধাবস্থায় অবরোধের নৈতিকতা নিয়ে বিতর্ক আবারও সামনে এসেছে। ইসরায়েল বলছে, অবরোধ হামাসের কাছে অস্ত্র পাচার ঠেকানোর জন্য। সমালোচকদের অভিযোগ, এতে সাধারণ মানুষেরই বেশি ভোগান্তি হচ্ছে। ইসরায়েল ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করছে এবং বলছে, অনুমোদিত পথেই সহায়তা পাঠানো সম্ভব।

বাধা সত্ত্বেও জিএসএফ জানিয়েছে, তাদের বহু নৌযান বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত গাজার পথে অটলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আয়োজকরা বলেছেন, কয়েকটি নৌযান আটক হলেও গ্লোবাল সুমুদ বহর কোনোভাবেই থামবে না। তারা বিশ্বব্যাপী সংহতির আহ্বান জানিয়েছেন।

এর আগে বহরকে নানা বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল। গ্রিস ও তিউনিসিয়ার কাছে ড্রোন হামলার অভিযোগ উঠেছিল। জিএসএফ দাবি করে, এসবের পেছনে ইসরায়েলের ভূমিকা ছিল। তবে জেরুজালেম এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

জিএসএফ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, সব অংশগ্রহণকারী ও নাবিকের খোঁজ রাখার জন্য তারা সচেষ্টভাবে কাজ করছে। অবশিষ্ট নৌযানগুলো এগিয়ে চলেছে। ভূমধ্যসাগর এখন উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে মানবিক উদ্যোগের সঙ্গে নিরাপত্তা স্বার্থের সংঘাত ঘটছে।

গ্রেটা থুনবার্গকে আটক। ছবি: সংগৃহীত।
গ্রেটা থুনবার্গকে আটক। ছবি: সংগৃহীত।

‘সুমুদ’ শব্দটি আরবী, যার অর্থ ‘অটলতা’ বা প্রতিরোধ। ফিলিস্তিনের গাজার ওপর ইসরায়েলের অবরোধকে চ্যালেঞ্জ জানাতে আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা এর আয়োজন করেন। এর অংশ হিসেবেই একটি মিডিয়া ফ্লোটিলারও আয়োজন করা হয়, যেখানে শহীদুল আলমও যোগ দেন।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি তিউনিসিয়া থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এর যাত্রা শুরু হয়। এর আগে বহরটি গত ৩১ আগস্ট স্পেনের বার্সেলোনা থেকে ছেড়ে আসে। পরে ৭ সেপ্টেম্বর তিউনিসিয়ার সিদি বু সাঈদ বন্দরে থামে। সেখান থেকে নেলসন ম্যান্ডেলার পরিবার-সন্তানরাও এতে যুক্ত হন।

মিশনটি শুরু হয় ৫০টির বেশি নৌযান নিয়ে। এগুলো অন্তত ৪৪টি দেশের প্রতিনিধিত্ব করছিল। নৌযানগুলোতে ছিল শত শত আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক, কর্মী এবং সংসদ সদস্য। আয়োজকদের তথ্য অনুযায়ী, তাদের মধ্যে ২৪ জন ছিলেন মার্কিন নাগরিক, যাদের মধ্যে কয়েকজনই ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক।

বহরটির লক্ষ্য হলো গাজায় খাদ্যসঙ্কটে ভোগা মানুষের জন্য জরুরি সরবরাহ পৌঁছে দেওয়া। বর্তমানে সেখানে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষে রয়েছেন।

আর মিডিয়া ফ্লোটিলার লক্ষ্য মূলত তথ্যের অবরোধ ভাঙা। ইসরায়েল অধিকাংশ বিদেশি সাংবাদিককে গাজায় প্রবেশে বাধা দেয়। ২০০৭ সাল থেকেই ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় আন্তর্জাতিক পর্যযবেক্ষকদের প্রবেশ কার্যত সীমিত।

অংশগ্রহণকারীরা সরাসরি উপকূলে পৌঁছে সেখানকার বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরতে চান। এর মধ্যে রয়েছে মানবিক বিপর্যয়, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ও অবরুদ্ধ মানুষের দৈনন্দিন জীবন। এই মিশনগুলো সমন্বয় করে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এএফসি), যা বিভিন্ন নাগরিক সমাজের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক।

Ad 300x250

সম্পর্কিত