leadT1ad

কারওয়ান বাজারে চাঁদাবাজি-হামলা, অভিযোগ সেই আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে

প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০: ২২
কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেট। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বেড়েছে চাঁদাবাজি। চাঁদা না দিলে মারধরসহ বিভিন্ন হেনস্তার অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। থানায় একাধিক অভিযোগ ও স্মারকলিপি দিয়েও ফল পাননি তাঁরা। নিরুপায় হয়ে সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের মানববন্ধন করছিলেন ব্যবসায়ীরা। এসময় তাঁদের ওপর হামলা চালিয়েছে একদল দুর্বৃত্ত। এতে কয়েকজন আহত হয়েছেন।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আগে যাঁরা চাঁদাবাজি করত, তাঁরা পালিয়ে যান। এরপর থেকে কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেট, ফুটপাত ও আড়তে চাঁদাবাজি শুরু করেন তেঁজগাও থানা যুবদলের তৎকালীন সদস্যসচিব আব্দুর রহমান। চাঁদা না পেয়ে ব্যবসায়ীদের তুলে নিয়ে মারধরের অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। পরে অবশ্য তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

২৫ বছর ধরে কিচেন মার্কেটে চালের ব্যবসা করেন মোহাম্মদ বেলায়েত হুসেন। আব্দুর রহমানের লোকজন তাঁকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করেছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। সিটি রাইসের এই স্বত্বাধীকারী স্ট্রিমকে বলেন, ‘গত সাত মাস আগে আবদুর রহমান আমার কাছে চাঁদা দাবি করে। আমি চাঁদা দিতে অস্বীকার করি। পরে তাঁর সঙ্গে থাকা লোকজন আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিতে থাকে।’

বেলায়েত হুসেন আরও বলেন, ‘একরাতে তাঁরা আমার ওপর আক্রমণ চালিয়ে আহত করে। সেদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে এক ব্যবসায়ী ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করছিলাম। তখন আব্দুর রহমানসহ লোকজন নিয়ে আমার ওপর হামলা করলে গুরুতর আহত হই।’

এই ঘটনায় মামলা করেছিলেন কিনা প্রশ্ন করলে বেলায়েত হুসেন বলেন, ‘আব্দুর রহমানের গুণ্ডাবাহিনী আছে। তাঁরা যে কোনো সময় যা খুশি তাই করতে পারে। তাছাড়া থানাতেও তাঁর লোক আছে। পুলিশ আমাদের মামলা নেবে না।’

আব্দুর রহমানের হামলার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসাইন নামের আরেক ব্যবসায়ী। তিনি ৩৫ বছর ধরে কারওয়ান বাজারে ব্যবসা করছেন। আব্দুর রহমান তাঁর কাছে ১৫ লাখ টাকার চাঁদা দাবি করেছেন বলে অভিযোগ।

দেলোয়ার হোসাইনও মামলা করেননি উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি চাঁদা দিতে চাইনি। গত ৩ ফেব্রুয়ারি আব্দুর রহমানের লোকজন আমাকে তুলে নিয়ে কারওয়ান বাজারের কাঠপট্টি এলাকায় মারধর করে। তারপর একটা সিএনজিতে বসিয়ে বলে, “আপনি চলে যান। আপনার ব্যবসা করার দরকার নেই।”’

কিচেন মার্কেট ব্যবসায়ীদের সমিতির নাম হলে ‘ইসলামিয়া শান্তি সমিতি’। সোমবার চাঁদাবাজদের হামলার পর সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি হাজী মো. শাহ কামাল মানিকের সই করা এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তিন দফা দাবি জানানো হয়েছে। আব্দুর রহমান ও তাঁর সহযোগীদের অনিতিবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচার, সাধারণ ব্যবসায়ীদের নির্ভয়ে ব্যবসা পরিচালনা এবং কারওয়ান বাজার এলাকা চাঁদামুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

একইসঙ্গে, ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কিচেন মার্কেটের মাছবাজার থেকে প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা চাঁদা নেন আব্দুর রহমান। মাংস বাজার থেকে নেন ৬০ হাজার টাকা। কিচেন মার্কেটের পশ্চিমপাশের মুরগী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নেন ৭০ হাজার টাকা। কিচেন মার্কেটের তৃতীয়তলায় বাথরুমকে গোডাউন হিসেবে ভাড়া দিয়ে নেন ৪০ হাজার টাকা। মার্কেটের তৃতীয় তলার দোকান থেকে নেন ৫৫ হাজার টাকা।

অন্যদিকে, চাঁদা থেকে মুক্তি পেতে আজ তেঁজগাও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার, র‍্যাব-২-এর অধিনায়ক, তেজগাঁও সেনা ক্যাম্প ও তেঁজগাও থানায় ৫৫০ ব্যবসায়ীর সই করা একটি স্মরকলিপি জমা দিয়েছে ইসলামি শান্তি সমিতি।

এ ব্যপারে যোগাযোগ করা হলে ইসলামিয়া শান্তি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবু বকর সিদ্দীক স্ট্রিমকে বলেন, ‘দৈনিক ও মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা নেয় আব্দুর রহমান। মার্কেটের তৃতীয়তলার বাথরুম দখল করে গোডাউন বসিয়েছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর কিচেন মার্কেটে ২টি দোকান কিনেছেন আব্দুর রহমান। ব্যবসায়ীদের দাবি, চাঁদার টাকা দিয়ে দোকান দুটি কিনেছেন তিনি।

আব্দুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
আব্দুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

আব্দুর রহমান আছেন আগের মতোই

চাঁদাবাজির ঘটনা প্রকাশ্যে এলে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর যমুনা টিভির এক সাক্ষাৎকারে আব্দুর রহমান বলেন, ‘বিগত দিনে যে চাঁদাবাজরা ছিল, তাঁরা তো আসে নাই। তইলে এটার হাল তো ধরতে হবে। তখন আমি এবং ২০-২৫ জন মিলে এটার হাল ধরছি। আমি যুবদলের কর্মী এবং ব্যবসায়ী।’

এই বক্তব্য প্রকাশ্যে এলে তাঁকে দল থকে বহিষ্কার করে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি। ১৯ সেপ্টেম্বর দপ্তর সম্পাদক নুরুল ইসলাম সোহেলের সই করা প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘দলীয় শৃঙ্খল পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগে ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার তেঁজগাও থানা যুবদলের সদস্যসচিব মো. আব্দুর রহমানকে প্রাথমিক সদস্যসহ দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’

তবে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, বহিষ্কার হওয়ার পরও দলের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছেন আব্দুর রহমান। বরং বহুগুণ বেড়েছে তাঁর দৌরাত্ম। এমনকি দলীয় কর্মকাণ্ডে পোস্টারও ছাপাচ্ছেন তিনি।

এ ব্যপারে আব্দুর রহমান স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমি ২০ বছর ধরে দল করি, এই দলের তৃণমূল থেকে আমার উঠে আসা। যেহেতু একটা থানাতে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করছি, হয়তো আমার যারা অনুসারী আছে, যারা আমাকে পছন্দ করে, তারা এগুলা করতে পারে।’

চাঁদাবাজির বিষয়ে আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমি ব্যবসায়ী, আমার বাবা—বড় ভাই ব্যবসায়ী। একজন ব্যবসায়ী কখনো চাঁদাবাজ হতে পারে না।’

আবদুর রহমান আরও বলেন, ‘কিচেন মার্কেটে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে কোনো নির্বাচন হয় না। নির্বাচন ছাড়াই জোর দখল কইরা ওরা এই মার্কেটের সমিতি, কমিটি কইরা রাখছে। আমি নির্বাচনের পক্ষে কথা বলার কারণেই আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মারা ঐক্যবদ্ধ হইয়া এই ঘটনাগুলো করতেছে। তাঁরা এবারও বিনা ভোটে কমিটি করতে চাচ্ছে আর আমি চাচ্ছি ভোটের মাধ্যমে কমিটিটা হোক।’

অভিযোগ প্রসাশনের বিরুদ্ধেও

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চাঁদার ভাগ পান তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (অপারেশন্স) আব্দুল হান্নান ও কারওয়ান বাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই হায়দার আলী।

অভিযোগের বিষয়ে হান্নান বলেন, ‘এই অভিযোগ ব্যবসায়ীরা কেন জানিয়েছেন, সেটা আমি জানি না। এটা তাঁদেরকেই জিজ্ঞেস করতে হবে। আব্দুর রহমানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক নেই।’

এসআই হায়দার আলী বলেন, ‘এগুলো বানোয়াট অভিযোগ। এসবের কোনো ভিত্তি নেই।’

এদিকে, আজকের মানববন্ধনের ব্যাপারে গতকালই তেঁজগাও থানা পুলিশকে জানিয়েছিল ব্যবসায়ীরা। নিরাপত্তার জন্য সেখানে পুলিশও রাখা হয়। পুলিশের সামনে আব্দুর রহমানের লোকজন হামলা চালালেও তাঁরা নীরব ছিল বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।

এ ব্যাপারে তেজগাঁও থানার ওসি কৌশৈন্যু মারমা বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা আমাদের জানিয়েছিলেন। আমরা ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। কিন্তু হামলাটা অতর্কিতভাবে হয়েছে। হঠাৎ হামলা হওয়ার ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো তথ্য ছিল না।’

মামলা না নেওয়ার ব্যাপারে কৌশৈন্যু মারমা বলেন, ‘কেউ মামলা করতে এলে অবশ্যই নেওয়া হবে। আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে আগেরই অনেক মামলা রয়েছে। তবে তিনি সব মামলাতেই জামিনে আছেন।’

এদিকে আব্দুর রহমানকে সংযত করা না গেলে কঠিন আন্দোলনে নামবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ ব্যাপারে ইসলামিয়া শান্তি সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘আমরা থানায় গিয়েছি। স্মারকলিপি দিয়েছি। এতে যদি কাজ না হয়, আমরা ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিসহ (এফবিসিসিআই) বড় ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে কথা বলে আন্দোলনে নামব।’

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত