তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কিছু অংশ অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানি পিছিয়েছে। বুধবার (১১ ডিসেম্বর) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ছয় সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ শুনানি গ্রহণ করে আগামী ২০২৬ সালের ৫ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি করেছেন।
আজ আদালতে রিট আবেদনকারী এবং ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’ (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। ইন্টারভেনর হিসেবে আইনজীবী সারা হোসেন, রুহুল কুদ্দুস কাজল, মোহাম্মদ শিশির মনির ও এস এম শাহরিয়ার কবির বক্তব্য রাখেন।
শুনানি শেষে বিএনপির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, আদালত জুলাই সনদ-সংক্রান্ত বিষয় ও চলমান নির্বাচন প্রক্রিয়া বিবেচনায় নিয়ে শুনানিটি মুলতবি করেছেন।
জয়নুল আবেদীনের ভাষ্য, জুলাই সনদ-সংক্রান্ত ইস্যুটি শুনানির শেষ পর্যায়ে হঠাৎ আসে, যা দীর্ঘ শুনানিতে তেমনভাবে আলোচনায় ছিল না। এখন কোনো সিদ্ধান্ত দিলে তা ভবিষ্যতে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে কি না, কিংবা নির্বাচনের পর গঠিত নতুন পার্লামেন্ট এ বিষয়ে কী অবস্থান নেবে—আদালত তা বিবেচনায় নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, সুপ্রিম কোর্ট সর্বোচ্চ আদালত হওয়ায় এখনই কোনো রায় দিলে তা আগামী পার্লামেন্টের ওপর বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে। অদূর ভবিষ্যতেই নির্বাচন হওয়ায় আদালত সিদ্ধান্ত দেওয়া থেকে আপাতত বিরত থেকেছেন।
এর আগে গত ১৩ নভেম্বর সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার অনুমতি বা ‘লিভ টু আপিল’ দিয়েছিল। হাইকোর্ট পঞ্চদশ সংশোধনীর কিছু অংশ বাতিল করলেও সুজনের পক্ষ থেকে দায়ের করা আপিলে পুরো সংশোধনী বাতিলের আবেদন করা হয়েছে। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর বেঞ্চ ঐতিহাসিক রায় দেন। রায়ে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং এটি সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামো’ বা বেসিক স্ট্রাকচারের অংশে পরিণত হয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তিসংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ নম্বর অনুচ্ছেদ সংবিধানসম্মত নয় বলে বাতিল করা হয়। পাশাপাশি সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর ৪৭ ধারা দিয়ে এই বিধানটি বিলুপ্ত করা হয়েছিল, যা আদালতের মতে মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। এছাড়া সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত হওয়া সংবিধানের ৭ক, ৭খ এবং ৪৪(২) অনুচ্ছেদও বাতিল ঘোষণা করা হয়। ৭ক অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল এবং ৭খ অনুচ্ছেদে মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করা হয়েছিল।
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেন, গণতন্ত্র সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে আস্থা নষ্ট হয়েছে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’। তবে আদালত পুরো পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করেননি। সংশোধনীর ৫৪টি পরিবর্তনের বাইরে বাকি বিধানগুলো ভবিষ্যৎ জাতীয় সংসদ আইন অনুসরণ করে এবং জনগণের মতামত নিয়ে সংশোধন বা পরিমার্জন করতে পারবে। এসবের মধ্যে রয়েছে জাতির পিতার স্বীকৃতি ও ২৬ মার্চের ভাষণের মতো বিষয়। ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পাস হওয়া পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুজনের সম্পাদকসহ অন্যরা রিট করেছিলেন।