leadT1ad

জানাজার আগে জীবনী পাঠ, দেশই খালেদা জিয়ার ঠিকানা, শায়িত হলেন সেখানেই

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া

‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলতেন, “দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই, বাংলাদেশই হলো আমার ঠিকানা। এই দেশ, এ দেশের মাটি ও মানুষ আমার সবকিছু।” চিরচেনা এই দেশের মাটিতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। আজ এই দেশের মাটিতেই তাঁর শহীদ স্বামীর পাশে তিনি শায়িত হবেন চিরদিনের জন্য।’

বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় খালেদা জিয়ার জানাজার আগে তাঁর জীবনী পাঠ করার সময় এসব কথা বলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।

নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘গণতন্ত্রের মাতা ও আপোসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গতকাল ৩০ ডিসেম্বর ভোর ৬টায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আমরা তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাদের সকলের পরম শ্রদ্ধেয় নেত্রীকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন।’

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে দেশে-বিদেশে শোকের ছায়া নামে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘উনার মৃত্যু সংবাদ মুহূর্তের ভেতর ছড়িয়ে পড়লে দেশ-বিদেশের সব বাংলাদেশি শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে এবং মূল ধারা থেকে সোশ্যাল মিডিয়া পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তাদের দোয়া ও প্রার্থনায়। অন্যদিকে পুরো বিশ্বের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে আসতে শুরু করে আন্তরিক শোক বার্তা।’

দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষায় চির আপোষহীন দেশনেত্রী দেশ-বিদেশের কোনো অপশক্তির সামনে কখনো মাথা নত করেননি। কোনো প্রলোভন, কোনো ষড়যন্ত্র বা হুমকি তাঁকে জীবনের শেষ দিন অবধি আপোসের পথ বেছে নিতে বাধ্য করতে পারেনি। তিনি বরাবর থেকে গেছেন দেশের মানুষের পাশে।

খালেদা জিয়ার জীবন সম্পর্কে বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালে। শৈশব থেকেই তিনি পরিচ্ছন্ন এবং পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন। ফুলের প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। পরবর্তী জীবনেও তিনি এই অভ্যাস বজায় রেখেছিলেন, তাঁর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক চর্চায়। তাই তাঁর রাজনীতিও ছিল নিজের মতই সৌন্দর্যমণ্ডিত। ফুলের প্রতি অনুরাগের কারণেই হয়তো সবচেয়ে কঠিন সময়েও তাঁর সব রাজনৈতিক বক্তব্যও থাকতো সুশোভিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘১৯৬০ সালের ৫ আগস্ট তৎকালীন সেনাবাহিনীর চৌকস কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সাথে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দুই পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকো স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মালয়েশিয়ায় অবস্থানকালে, প্রকৃতপক্ষে বিনা চিকিৎসায় ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার লাশ যখন ঢাকায় আসে, তখন তার মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও ছিলেন তাঁর গুলশান অফিসে সেই একই সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে অন্তরীণ।’

জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় খালেদা জিয়ার জানাজার আগে জীবনী পাঠ করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। স্ট্রিম ছবি
জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় খালেদা জিয়ার জানাজার আগে জীবনী পাঠ করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। স্ট্রিম ছবি

রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার যুক্ত হওয়া নিয়ে বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘তাঁর রাজনীতিতে আগমন ছিল আকস্মিক, কিন্তু দেশের প্রয়োজনে তা ছিল অনিবার্য। ১৯৮১ সালের ৩০ মে কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম) শাহাদাতবরণ করার পর দলীয় সরকারের ভিতরেই ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে ওঠে। সাংগঠনিকভাবে বিএনপি ও সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সময় দল এবং দলীয় নেতাদের মনোবল অটুট রাখার লক্ষ্যে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবনের ক্লান্তিহীন পথচলা।’

তিনি আরও বলেন, ‘দলের প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী হলেও দলের গঠনতন্ত্র সমুন্নত রেখে তিনি ক্রমশ দলের ভাইস চেয়ারপারসন, সিনিয়র ভাইস চেয়ারপারসন, তারপর দলীয় কাউন্সিলে নির্বাচিত চেয়ারপারসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার ৪৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ৪১ বছরই তিনি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির শীর্ষ নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দলকে সুসংহত করেছেন। শক্তিশালী করেছেন।’

খালেদা জিয়ার জানাজা বুধবার বিকেল তিনটায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হয়। ছবি: বিএনপি মিডিয়া সেল
খালেদা জিয়ার জানাজা বুধবার বিকেল তিনটায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হয়। ছবি: বিএনপি মিডিয়া সেল

দীর্ঘ ৯ বছর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই করে ১৯৯১ সালের সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া বিএনপিকে ফের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আনেন জানিয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘জাতির কাছে তিনি পান আপোসহীন দেশনেত্রীর মর্যাদা। দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষায় চির আপোষহীন দেশনেত্রী দেশ-বিদেশের কোনো অপশক্তির সামনে কখনো মাথা নত করেননি। কোনো প্রলোভন, কোনো ষড়যন্ত্র বা হুমকি তাঁকে জীবনের শেষ দিন অবধি আপোসের পথ বেছে নিতে বাধ্য করতে পারেনি। তিনি বরাবর থেকে গেছেন দেশের মানুষের পাশে। তিনি বলতেন, “বিদেশে আমাদের বন্ধু আছে, প্রভু নেই”।’

খালেদা জিয়া জনগণের কল্যাণে একের পর এক যুগান্তকারী কর্মসূচি নিয়েছিলেন মন্তব্য করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ এ নেতা বলেন, ‘উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনে তাঁর সাফল্য বাংলাদেশকে বিশ্ব চিনেছিল “ইমার্জিং টাইগার” হিসেবে। জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনবার। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে একজন ব্যক্তি যতটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে, তিনি তা করেছেন এবং নির্বাচনে ৫টি করে এবং শুধু ২০০৮ সালে ৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কয়টি আসনে বিজয়ী হয়েছেন তিনি। জনগণের প্রকৃত সমর্থনে নির্বাচনে পরাজয়ের গ্লানি তাকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়েছে বারবার। জনপ্রিয়তার এমন দৃষ্টান্ত শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বে বিরল।’

পায়ে হেঁটে তিনি (খালেদা জিয়া) কারাগারে প্রবেশ করেছিলেন, কিন্তু নির্জন কারাগার থেকে তিনি বের হলেন চরম অসুস্থতা নিয়ে। দেশ-বিদেশের চিকিৎসকদের মতে, পরবর্তীতে গৃহবন্দিত্বের ৪ বছর বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ না দেওয়ায় তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর ফলশ্রুতিতে অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মানতে হলো এই অপরাজেয় নেত্রীর।

নজরুল ইসলাম খান আরও বলেন, ‘তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম এবং মুসলিম বিশ্বে দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী। গণতন্ত্রকে ভালোবেসে তিনি গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন এবং দায়িত্ব পেয়ে গণতন্ত্রকে কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছেন বলেই দেশ-বিদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ তাকে “গণতন্ত্রের মাতা” বলে সম্মানিত করেছে। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে গৃহীত তার কর্মসূচি ছিল অসংখ্য। নারী শিক্ষার প্রসারে উপবৃত্তি প্রথা ও শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচি, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবাসীদের কল্যাণের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা ছিল তার মাঝে অন্যতম।’

খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক সক্ষমতা ও দেশের স্বার্থে অনমনীয়তার কারণে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে তাঁকে প্রতিপক্ষরা ’ব্যক্তি শত্রু’ হিসেবে গণ্য করা শুরু করে– এমন অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা, স্বৈরাচারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, এমনকি তথাকথিত ১/১১ সরকারের সময়ও দেশনেত্রীকে কারারুদ্ধ করা হয়। ফ্যাসিবাদী হাসিনা স্রেফ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য দেশনেত্রীকে তাঁর শহীদ স্বামীর স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি থেকে উৎখাত করে এবং মিথ্যা মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ বছরের বেশি সময় অন্ধকার কারাগারে আবদ্ধ থাকার সময় উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে দেশনেত্রী দারুণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।’

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘সমগ্র দেশবাসী সাক্ষী, পায়ে হেঁটে তিনি (খালেদা জিয়া) কারাগারে প্রবেশ করেছিলেন, কিন্তু নির্জন কারাগার থেকে তিনি বের হলেন চরম অসুস্থতা নিয়ে। দেশ-বিদেশের চিকিৎসকদের মতে, পরবর্তীতে গৃহবন্দিত্বের ৪ বছর বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ না দেওয়ায় তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর ফলশ্রুতিতে অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মানতে হলো এই অপরাজেয় নেত্রীর। তাই এই মৃত্যুর দায় থেকে ফ্যাসিবাদী হাসিনা কখনো মুক্তি পাবে না।’

সারা দেশের মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও দোয়ায় খালেদা জিয়া আজ বিদায় নিচ্ছেন জানিয়ে বলা হয়, ‘তিনি পেছনে রেখে গেলেন এক মহীয়সী নারী, এক সংগ্রামী রাজনীতিবিদ, এক দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়কের অনন্য কর্মজীবনের উদাহরণ— যা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জন্য।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত