leadT1ad

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ‘নির্বাসন’ ও ‘কামব্যাক’ সংস্কৃতি

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

স্ট্রিম গ্রাফিক

দীর্ঘ ১৭ বছর যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত থাকার পর দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে মঞ্চ। রাজধানীর পূর্বাচলের ৩০০ ফুট এলাকা সংলগ্ন সড়কে এটি তৈরি করা হচ্ছে।

নির্বাসনের এই দীর্ঘ সময়ে বিএনপিকে নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে। দল মাঠে কোণঠাসা ছিল, শীর্ষ নেতৃত্ব ছিল কারাবন্দী বা চাপের মুখে; সাংগঠনিকভাবেও ছিল দুর্বল। এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমান বিদেশে থেকেও পুরোপুরি রাজনীতির বাইরে ছিলেন না। লন্ডন থেকেই তিনি দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; ভার্চ্যুয়াল বৈঠক, বার্তা ও নির্দেশনার মাধ্যমে দলীয় রাজনীতিতে প্রভাব রাখার চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ এটি ছিল দূরবর্তী নেতৃত্বের রাজনীতি—মাঠে না থাকলেও কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়ার চেষ্টা।

রাজনৈতিক ‘নির্বাসন’ ও ‘কামব্যাক’ কী

রাজনীতিতে ‘নির্বাসন’ বলতে এমন পরিস্থিতিকে বোঝায়, যেখানে কোনো রাজনৈতিক নেতা রাষ্ট্রীয় চাপ, সামরিক শাসন, মামলা, গ্রেপ্তার-ভয় বা নিরাপত্তাহীনতার কারণে নিজ দেশে থেকে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারেন না। বাধ্য হয়ে দীর্ঘ সময় বিদেশে অবস্থান করেন।

নির্বাসনের ক্ষেত্রে মূলত নেতার সামনে বাস্তবিক কোনো পছন্দ থাকে না। দেশে ফিরলে হয়রানি, কারাবাস বা সহিংসতার ঝুঁকি থাকে। আর তাই বিদেশে থাকা একধরনের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়।

অন্যদিকে রাজনৈতিক ‘কামব্যাক’ হলো সেই নির্বাসন বা দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর আবার দেশে ফিরে সক্রিয় রাজনীতিতে ফেরা। এই ফেরা জনসমর্থন, দলীয় নেতৃত্ব কিংবা ক্ষমতার রাজনীতিতে পুনরায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া।

অনেক ক্ষেত্রে কামব্যাক মানে আবার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া, আবার কখনো সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছে যাওয়া। এটি ঘটে সাধারণত রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন, শাসনব্যবস্থার পতন কিংবা দীর্ঘদিনের জনচাপের ফলে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নির্বাসন ও কামব্যাক প্রায়ই একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত।

বেনজির ভুট্টো

বেনজির ভুট্টোকে পাকিস্তানে সামরিক শাসনের কারণে রাজনৈতিক নির্বাসনে যেতে হয়। ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউল হক ক্ষমতা দখলের পর তাঁর বাবা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ১৯৭৯ সালে ফাঁসি দেওয়া হয়, আর বেনজির ভুট্টো নিজে বারবার গ্রেপ্তার ও হয়রানির শিকার হন। এই পরিস্থিতিতে দেশে থাকা নিরাপদ না থাকায় তিনি বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়েন।

বেনজির ভুট্টো। ছবি: সংগৃহীত
বেনজির ভুট্টো। ছবি: সংগৃহীত

বেনজির ভুট্টো মূলত যুক্তরাজ্যে স্বেচ্ছানির্বাসিত ছিলেন এবং ১৯৮৪ সালে দেশ ছেড়ে যান। ১৯৮৬ সালের ১০ এপ্রিল তিনি দেশে ফেরেন। অর্থাৎ প্রায় দুই বছর (১৯৮৪-১৯৮৬) দেশের বাইরে কাটান।

এই সময়ে তাঁর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) দমন-পীড়নের মধ্যে থাকলেও পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি। বেনজির ভুট্টো বিদেশে থেকেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেন, আন্তর্জাতিক সমর্থন গড়েন এবং দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। সামরিক শাসন দুর্বল হলে তিনি দেশে ফেরেন। এই কামব্যাক পাকিস্তানের রাজনীতিতে বড় ঘটনা ছিল। ফেরার দুই বছরের মধ্যেই ১৯৮৮ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন।

পারভেজ মুশাররফ

পারভেজ মুশাররফ পাকিস্তানে সামরিক শাসনের অবসানের পর রাজনৈতিক ও আইনি চাপে পড়েই কার্যত নির্বাসনে যান। ২০০৮ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘন, জরুরি অবস্থা জারি, বিচারপতি অপসারণসহ একাধিক মামলা সামনে আসে। এই পরিস্থিতিতে দেশে থাকা মানেই ছিল গ্রেপ্তার ও বিচার মোকাবিলা করা। এ কারণেই তিনি বিদেশে চলে যান।

পারভেজ মুশাররফ তাঁর নির্বাসিত জীবন মূলত দুবাই ও লন্ডনে কাটিয়েছেন। তিনি ২০০৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত (প্রায় চার বছর) দেশের বাইরে ছিলেন।

নির্বাসনে থাকাকালে তিনি ২০১০ সালে অল পাকিস্তান মুসলিম লীগ গঠন করেন; তবে দলটি দ্রুতই প্রভাবহীন হয়ে পড়ে। দলটির মাঠপর্যায়ের সংগঠন ছিল না বললেই চলে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে দলটি কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে এবং মুশাররফের অনুপস্থিতিতে দল সক্রিয়ভাবে রাজনীতি চালাতে পারেনি।

বিদেশে থাকাকালে মুশাররফ সরাসরি রাজনীতিতে খুব একটা সক্রিয় ছিলেননা। মাঝে মাঝে বিবৃতি দিয়েছেন, সাক্ষাৎকারে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু মাঠের আন্দোলন বা শক্ত কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালনা করেননি। বলা যায়, তাঁর নির্বাসনকাল ছিল বেশি আত্মরক্ষামূলক ও নীরব।

২০১৩ সালে তিনি দেশে ফেরেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং রাজনীতিতে কামব্যাক করা। কিন্তু দেশে ফেরার পরপরই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি মামলা ও আদালতের প্রক্রিয়ায় আটকে পড়েন। ফলে তাঁর এই কামব্যাক রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়। এরপর চিকিৎসার জন্য আবার বিদেশে যাওয়ার অনুমতি পান (২০১৬ সালের মার্চে)। পরবর্তী সময়ে তিনি আর সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরতে পারেননি। ২০২৩ সালে পারভেজ মুশাররফ মারা যান।

নওয়াজ শরিফ ও শাহবাজ শরিফ

নওয়াজ শরিফ ও শাহবাজ শরিফ দুজনই পাকিস্তানে ১৯৯৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। জেনারেল পারভেজ মুশাররফ ক্ষমতা দখল করলে শরিফ পরিবারকে রাজনীতি থেকে সরাতে মামলা ও দমন শুরু হয়। এই অবস্থায় ২০০০ সালে দুজনকেই সৌদি আরবে পাঠানো হয়।

তাঁরা প্রায় সাত বছর (২০০০-২০০৭) নির্বাসনে ছিলেন। এই সময়ে তাঁদের দল পিএমএল-এন দমনের মধ্যে থাকলেও পুরো ভেঙে পড়েনি; নেতাকর্মীদের মাধ্যমে দল টিকে ছিল। নওয়াজ ও শাহবাজ বিদেশে থেকে সরাসরি রাজনীতি করতে পারেননি, তবে দলীয় যোগাযোগ বজায় রাখেন।

২০০৭ সালে সামরিক শাসন দুর্বল হলে নওয়াজ শরিফ প্রথমে ১০ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরলেও তাঁকে সেদিনই আবার নির্বাসনে পাঠানো হয়। পরে ২৫ নভেম্বর তিনি শাহবাজ শরিফসহ দেশে ফেরেন। কামব্যাকের পর নওয়াজ শরিফ ২০১৩ সালে আবার প্রধানমন্ত্রী হন, আর শাহবাজ শরিফ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে পরে ২০২২ সালে (এবং ২০২৪ সালে পুনরায়) প্রধানমন্ত্রী হন।

চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা

চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার নির্বাসন হয়েছিল জীবনের নিরাপত্তার কারণে। শ্রীলঙ্কার রাজনীতি তখন ভয়াবহ সহিংসতায় ভরা। তাঁর বাবা ও স্বামী—দুজনই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। বিশেষ করে ১৯৮৮ সালে স্বামী বিজয়া কুমারাতুঙ্গা নিহত হওয়ার পর চন্দ্রিকার নিজের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে তিনি ১৯৮৮ সালে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।

তিনি মূলত যুক্তরাজ্যে ছিলেন এবং ১৯৮৮ সালে সেখানে আশ্রয় নেন। ১৯৯০ সাল থেকে দেশে যাতায়াত শুরু করে ১৯৯১ সালে স্থায়ীভাবে দেশে ফেরেন। অর্থাৎ প্রায় তিন বছর (১৯৮৮-১৯৯১) নিরাপত্তাজনিত কারণে দেশের বাইরে ছিলেন। এই সময়ে তাঁর দল শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি ক্ষমতার বাইরে ও দুর্বল অবস্থায় থাকলেও পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি। চন্দ্রিকা বিদেশে থেকেও দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, তবে প্রকাশ্য রাজনীতি করেননি।

১৯৯৪ সালে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হলে তিনি দেশে ফেরেন। তাঁর কামব্যাক ছিল নাটকীয়। ফেরার পরপরই তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং পরে প্রেসিডেন্ট হন।

গিরিজা প্রসাদ কৈরালা

গিরিজা প্রসাদ কৈরালা নেপালে রাজতান্ত্রিক শাসনের দমননীতির কারণে রাজনৈতিক নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। ১৯৬০ সালে রাজা মহেন্দ্র দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করলে তাঁর পক্ষে দেশে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। পরে কারাবরণ শেষে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ১৯৬৭ সালে ভারতে নির্বাসনে যান।

তিনি প্রায় ১২ বছর (১৯৬৭-১৯৭৯) দেশের বাইরে ছিলেন। এই সময়ে তাঁর দল নেপালি কংগ্রেস নিষিদ্ধ থাকলেও ভেঙে পড়েনি; ভারতের মাটি থেকেই গোপনে সংগঠন ও আন্দোলন চালানো হতো। গিরিজা প্রসাদ কৈরালা নির্বাসনে থেকেও সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেছেন এবং গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলন সংগঠিত করেছেন।

গিরিজা প্রসাদ কৈরালা। ছবি: সংগৃহীত
গিরিজা প্রসাদ কৈরালা। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭৯ সালে তিনি দেশে ফেরেন। কামব্যাকের পর তিনি নেপালের গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্যতম প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন এবং পরে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী হন। ২০১০ সালে তিনি মারা যান। তাঁর নির্বাসন ও প্রত্যাবর্তন নেপালের গণতন্ত্রে ফেরার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

শেখ হাসিনা

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাসন শুরু হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর। সে সময় বাংলাদেশে চরম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। শেখ হাসিনা তখন বিদেশে ছিলেন। দেশে ফিরলে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত না থাকায় তিনি বিদেশে থেকে যান। মূলত ভারতে অবস্থান করে তিনি প্রায় ছয় বছর (১৯৭৫-১৯৮১) দেশের বাইরে ছিলেন।

এই সময়ে আওয়ামী লীগের অবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। দল ছত্রভঙ্গ, অনেক নেতা জেলে বা আত্মগোপনে, সংগঠন কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল। শেখ হাসিনা নির্বাসনে থেকেও দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, নেতাদের সঙ্গে কথা বলতেন এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের শাসন ও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টি তুলে ধরতেন। তিনি প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে না পারলেও দলকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়েছিলেন।

১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ তাঁকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করে। এরপর ১৭ মে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এই প্রত্যাবর্তন আওয়ামী লীগের জন্য ছিল নতুন শুরুর মুহূর্ত। দেশে ফিরে তিনি দল পুনর্গঠন করেন ও আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

Ad 300x250

সম্পর্কিত