leadT1ad

জলপাইগুড়ির ‘ঘরের মেয়ে পুতুলের’ জন্য শোকের ছায়া

স্ট্রিম সংবাদদাতা
স্ট্রিম সংবাদদাতা
জলপাইগুড়ি

প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩: ০৯
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া

বুধবার সকাল। জলপাইগুড়ির নয়াবস্তি পাড়া। এদিনের শীতের সকালটা যেন একটু বেশিই মলিন, কুয়াশাচ্ছন্ন। খুব কাছের কারো চলে যাওয়ার খবরে পাড়ার আকাশে-বাতাসে যেন প্রিয়জন হারানোর ব্যথা। কারণটা নিছক কোনো রাজনৈতিক নেত্রী কিংবা কোনো দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু নয়, বরং এই পাড়ারই ধুলোমাটিতে খেলে বড় হওয়া এক মেয়ের চলে যাওয়া।

কাঁটাতার দিয়ে দেশ ভাগ হয়েছে কবেই, কিন্তু নাড়ির টান যে ভাগ করা যায় না, বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবরে শোকস্তব্ধ জলপাইগুড়ি যেন সেটাই প্রমাণ করল আবার।

পুরো বাংলাদেশ সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জন্য শোকাহত, তখন পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির এই ছোট পাড়াটি কাঁদছে তাদের হারিয়ে যাওয়া ‘পুতুল’-এর জন্য। এমন খবরই উঠে এসেছে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে।

শৈশবের স্মৃতি ও নয়াবস্তির দিনগুলো

গল্পটা শুরু দেশভাগের দুই বছর আগে ১৯৪৫ সালে। এই শহরেই জন্ম হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়ার। পুতুলের মতই আদুরে আর সুন্দরী ছিলেন বলে পরিবারসহ পাড়া-প্রতিবেশীরা তাকে আদর করে ডাকতেন ‘পুতুল’ নামে। বাবা ইস্কান্দার আলী মজুমদার কাজ করতেন শহরের নামকরা ‘দাশ অ্যান্ড কোম্পানি’তে। পরে জড়িয়েছিলেন চায়ের ব্যবসায়। নয়াবস্তি এলাকায় ছিল তাঁদের ছিমছাম সংসার। এই শহরের ধুলোমাখা পথেই কেটেছে খালেদা জিয়ার শৈশব।

খালেদা জিয়ার আদিবাড়ির ঠিক উল্টোদিকে জলপাইগুড়ি জেলা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক ভোলা মণ্ডলের বাড়ি। ডিএসএ সচিব ভোলা মণ্ডলের স্মৃতিতে অমলিন খালেদা জিয়ার শৈশবের কথা। ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ‘আমার মায়ের কোলে-পিঠে চড়ে বড় হয়েছেন খালেদা। মায়ের কাছে শুনেছি তিনি দেখতে ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী।’

ইতিহাসবিদ ডক্টর আনন্দ গোপাল ঘোষ ও শহরের প্রবীণ বাসিন্দাদের তথ্যমতে, ১৯৪৭-এর দেশভাগের পরেও বেশ কিছুদিন জলপাইগুড়িতেই ছিল খালেদা জিয়ার পরিবার। কিন্তু ১৯৫০-এর পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। অধিকাংশ আত্মীয়স্বজন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে চলে যাওয়ায়, একসময় খালেদার বাবা ইস্কান্দার সাহেবও সিদ্ধান্ত নেন ওপার বাংলায় পাড়ি দেওয়ার।

জলপাইগুড়ি শহরের অমরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও মুখার্জি পরিবারের সঙ্গে সম্পত্তি বিনিময় করে তাঁরা চলে যান। তবে দেশ ছাড়লেও জলপাইগুড়ির মায়া কোনোদিন কাটাতে পারেননি খালেদা জিয়ার পরিবার।

এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়েও বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে এপার বাংলার পরিচিতরা ওপারে গিয়েছেন, আতিথিয়েতা পেয়েছেন।

স্মৃতির পাতায় জলপাইগুড়ির পুতুল

বর্তমানে খালেদা জিয়ার পৈতৃক ভিটার এক অংশে বাস করছেন চক্রবর্তী ও গোপ পরিবার। তাদের পুরোনো বাগানবাড়ির একটা অংশ কিনে এখন সেখানে থাকেন ঝর্না গোপ ও নীলকণ্ঠ গোপ। খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবরে তাঁরাও আজ শোকাহত।

পাশের বাড়ির বাসিন্দা চামেলী বিশ্বাস বা উৎপল গোপদের কণ্ঠেও একই সুর। রাজনীতি বা সীমান্তের বেড়া তাঁদের আবেগে বাধা হতে পারেনি। চামেলী বিশ্বাসের কথায়, ‘রাজনীতি নয়, মানুষের টানটাই বড়। আজ মনটা খুব খারাপ।’

গত ৩০ ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হলে জলপাইগুড়ির নয়াবস্তি এলাকার মানুষেরা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। দেশকাল কিংবা রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে তাদের স্মৃতির কোণে ভেসে ওঠে ছোট্ট একটি শিশুকন্যার কথা যে হয়ত এই পাড়ার পথ ধরেই বাবার হাত ধরে স্কুলে যেত, এই পাড়াতেই খেলাধুলা করত, এ পাড়ার মানুষের ভালোবাসায় শৈশব কাটিয়ে পরম মমতায় আর যত্নে।

নয়াবাস্তি এলাকার আরেক বাসিন্দা জানালেন, পুতুলরা যে বাড়িতে থাকতেন, তার পাশের বাড়িটিই তাঁর। ইদানিং বাংলাদেশ থেকে আত্মীয়রা এলে তাঁর বাড়িতে ওঠেন। আগের বাড়িটি দেখেশুনে ফিরে যান। আজ তাই খালেদা জিয়ার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তাঁদের মনখারাপ।

তিনি বলেন, ‘রাজনীতির কিছু ব্যাপার নয়। আমাদের এখানকারই বাসিন্দা ছিল ওরা। তাই আজ আমাদের মন ভারাক্রান্ত।’

জলপাইগুড়ির সেই ছোট্ট ‘পুতুল’ পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম প্রধান মুখ। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তাঁর ভূমিকা ছিল আপোসহীন। দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি যেমন রাজপথে সোচ্চার ছিলেন, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনেও সয়েছেন অনেক ঝড়ঝাপটা। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্বের দ্বিতীয় মুসলিম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের রাজনীতিতে এনেছেন পরিবর্তনের ছোঁয়া, নারীর ক্ষমতায়নে রেখেছেন অভূতপূর্ব অবদান।

জলপাইগুড়ির করলা নদীর জল অনেক দূর গড়িয়েছে, তাঁদের ছোট্ট পুতুলও হাঁটি হাঁটি পা পা করে খালেদা জিয়া হিসেবে সারাবিশ্বের কাছে সমাদৃত হয়েছেন। কিন্তু নয়াবস্তির মানুষের মনে ‘ছোট্ট পুতুল’-এর স্মৃতি আজও অমলিন। রাজনীতি, ক্ষমতা আর দেশের সীমানার ঊর্ধ্বে উঠে আজ তাই জলপাইগুড়ি স্মরণ করছে তাদের ঘরের মেয়েকে।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত