leadT1ad

খালেদা জিয়ার বিএনপিই কেন মধ্যপন্থী রাজনীতির ‘ভরসাস্থল’

প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২৬
স্ট্রিম গ্রাফিক

‘দুঃখজনক হচ্ছে বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে বিএনপিকে সবচেয়ে প্রগতিশীল মনে হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রগতিশীলেরা এখন মোটামুটি বিলুপ্ত। মধ্যপন্থীরাও দিন দিন সংকুচিত হচ্ছেন।’—এসব কথা মৃত্যুর আগে এক সমাবেশে বলেছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দীন উমর।

বাংলাদেশের রাজনীতি ঐতিহাসিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত। এক প্রান্তে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, অন্য প্রান্তে রয়েছে ধর্মীয় রাজনীতি। এই দুই মেরুর মাঝখানে একটি বিশাল শূন্যতা বিরাজমান ছিল। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ স্বভাবত ধর্মপরায়ণ, কিন্তু তারা ধর্মান্ধ নয়। আবার তারা আধুনিকতায় বিশ্বাসী, কিন্তু শিকড়বিচ্ছিন্ন নয়। এই মনস্তত্ত্বকে ধারণ করেই বিএনপির জন্ম হয় ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর।

আওয়ামী লীগের রাজনীতির ভিত্তি ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’। এটি মূলত ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক। এতে বাংলাদেশের অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিচয়ের সংকট তৈরি হয়। আবার জামায়াত ইসলামী শুধু ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান প্রবর্তন করেন ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’। এটি একটি ভূখণ্ডভিত্তিক পরিচয়। দর্শনে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে এই ভূখণ্ডের সবাই ‘বাংলাদেশি’। এটি উগ্র জাতিসত্তা বা উগ্র ধর্মান্ধতা—উভয়কেই নাকচ করে। এটি সকলকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসে।

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে দেশের বিভাজিত সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার একটি মধ্যম পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। এটি সংকীর্ণতামুক্ত একটি উদার ধারণা। এছাড়াও রাজনৈতিক দর্শনের জায়গা থেকে বিবেচনা করলে আমাদের দেশে বিএনপি একটি মধ্যপন্থার দল, বা কিছু বামে সরে আসা মধ্যবামও বলা যায়। রাজনৈতিক চিন্তার জায়গা থেকে বিএনপি খুব একটা কট্টর অবস্থানে ছিল না। উদারপন্থীদের সঙ্গে যেমন সখ্য ছিল, তেমনি ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখেছে বিএনপি।

ধর্ম ও রাজনীতির ভারসাম্য

বিএনপিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় ‘সেন্টার-রাইট’ বা মধ্য-ডানপন্থী দল বলা হয়। বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে রাজনীতি করা অসম্ভব। আবার রাষ্ট্রকে পুরোপুরি ধর্মভিত্তিক করাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। বিএনপি এই দুইয়ের সমন্বয় করেছে। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন ছিল সেই সমন্বয়ের প্রতিফলন। এটি মানুষকে ধর্মীয় স্বস্তি দিয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কট্টরপন্থার দিকে নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের গবেষণায় দেখা যায়, বিএনপি ইসলামি মূল্যবোধকে ধারণ করে কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় আধুনিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে, যা তাদের মধ্যপন্থী চরিত্রকে স্পষ্ট করে।

যেভাবে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে

স্বাধীনতার পর দেশে মিশ্র অর্থনীতি চালু ছিল। এতে ব্যক্তিউদ্যোগ স্থবির হয়ে পড়ে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে এই ধারা থেকে সরে আসেন। তবে তিনি পুরোপুরি পুঁজিবাদের পথ ধরেননি। ব্যক্তিখাত বিকাশের ওপর জোর দিয়েছিলেন। জনকল্যাণে রাষ্ট্রের ভূমিকাও তিনি নিশ্চিত করেন। খাল খনন কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষির উন্নয়ন ও কৃষিজীবীদের কল্যাণে তিনি এগিয়ে আসেন। কৃষির পাশাপাশি শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তিনি বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়া জোরদার করেন। গবেষক স্ট্যানলি এ. কোচেক তাঁর ‘প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট পলিটিক্স অ্যান্ড বিজনেস ইন বাংলাদেশ’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘জিয়ার আমলেই বাংলাদেশে সত্যিকারের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে এবং বেসরকারি খাতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।’ পরে জিয়ার এই পদক্ষেপগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যান খালেদা জিয়া।

বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সহনশীলতা

১৯৭৫ সালে বাকশালের মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসন কায়েম হয়েছিল। এক্ষেত্রে ভিন্নমতের কোনো স্থান ছিল না। জিয়াউর রহমান সেই অচলায়তন ভেঙে দেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। আওয়ামী লীগসহ সকল দলকে রাজনীতির সুযোগ করে দেন। জিয়াউর রহমান দেখিয়েছিলেন, ভিন্নমতাবলম্বীদের সঙ্গে নিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামানের মতে, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘পলিটিক্যাল প্লুরালিজম’ বা রাজনৈতিক বহুত্ববাদ ফিরিয়ে এনেছিলেন, যা গণতন্ত্রের প্রাণ। পরবর্তীতে খালেদা জিয়াও এই বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা করেছেন।

সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে অবস্থান

বিএনপিকে প্রায়ই তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ উগ্রবাদের সঙ্গে জড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। বাংলাদেশে জেএমবির মতো জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর উত্থান যখন ঘটেছিল, তখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারই তাদের দমন করেছিল। শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলাভাইয়ের মতো শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের গ্রেপ্তার ও বিচার খালেদা জিয়ার শাসনামলেই হয়েছিল। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)-র রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছিল, বিএনপি সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছিল এবং এটি তাদের মধ্যপন্থী অবস্থানই প্রকাশ করে।

পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য

বিএনপির পররাষ্ট্রনীতি হলো—‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’। এটি একটি মধ্যপন্থী অবস্থান। বিএনপি সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়। আবার চীনের সঙ্গেও অর্থনৈতিক বন্ধুত্ব গভীর করতে চায়। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গেও বিএনপির সুসম্পর্ক রয়েছে। কোনো একটি নির্দিষ্ট ব্লকের দিকে ঝুঁকে না পড়া বিএনপির কৌশল। এটি দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্থরক্ষার জন্য জরুরি। নতজানু পররাষ্ট্রনীতি যেমন কাম্য নয়, তেমনি অহেতুক সংঘাতও কাম্য নয়। বিএনপি এই ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে চায়।

ভিশন ২০৩০ ও আগামীর রাজনীতি

খালেদা জিয়া ২০১৭ সালে ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করেছিলেন। সেই দলিলে তিনি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানোর কথা বলেছিলেন। তিনি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এটি ছিল একটি আধুনিক ও সংস্কারমনা চিন্তা। তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা এবং আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে বিএনপি যে প্রস্তুত, ভিশন ২০৩০ তার প্রমাণ। এটি প্রমাণ করে বিএনপি সময়ের সঙ্গে নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে, যা মধ্যপন্থী দলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

মধ্যবিত্তের আস্থার প্রতীক

বাংলাদেশের সমাজকাঠামোর মেরুদণ্ড হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এই শ্রেণিটি উগ্রতা পছন্দ করে না। তারা স্থিতিশীলতা, সন্তানের শিক্ষা এবং জীবনের নিরাপত্তা চায়। বিএনপি সবসময় এই শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করার চেষ্টা করেছে। শিক্ষাবিস্তার এবং নারীশিক্ষার প্রসারে খালেদা জিয়ার অবদান অনস্বীকার্য। অবৈতনিক নারীশিক্ষা চালু করার ফলে সামাজিক বিপ্লব ঘটেছিল। এই গঠনমূলক পরিবর্তনই মধ্যপন্থার সৌন্দর্য।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সমাজ চরমভাবে বিভক্ত। এই বিভক্তি দূর করার সুযোগ রয়েছে বিএনপির হাতে। কারণ বিএনপি ডানেও নেই, বামেও নেই; বিএনপি আছে মাঝখানে। বিএনপি মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলে, আবার সামাজিক সুরক্ষা চায়। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, আগামীর বাংলাদেশে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বিএনপির ওপর ভরসা করা ছাড়া মধ্যপন্থীদের সামনে আর কোনো বিকল্প সম্ভবত নেই।

Ad 300x250

সম্পর্কিত