leadT1ad

কোনো ব্যক্তি কতদিন নিখোঁজ থাকলে গুম বলা যাবে, কী আছে অধ্যাদেশে

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ১৪
গুম বিষয়ক অধ্যাদেশ। স্ট্রিম গ্রাফিক

সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার গুম বা এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স প্রতিরোধে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। গত বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের এক বৈঠকে ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই অধ্যাদেশ গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারকে আইনি ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে শক্তিশালী আইনি কাঠামো হিসেবে কাজ করবে।

এতদিন গুম হওয়া ব্যক্তিদের আইনি মর্যাদা ও তাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে যে জটিলতা ছিল, এই অধ্যাদেশ তা নিরসনের পথ দেখিয়েছে। বিশেষ করে, কোনো ব্যক্তি পাঁচ বছরের বেশি সময় নিখোঁজ থাকলে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ডিসএপিয়ার্ড’ বা ‘গুম’ ঘোষণা করার বিধান রাখা হয়েছে। এর ফলে ভুক্তভোগী পরিবার তাদের স্বজনের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অধ্যাদেশ বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।

এই অধ্যাদেশে গুমের বিচার প্রক্রিয়া, ট্রাইব্যুনাল গঠন, ক্ষতিপূরণ এবং ভুক্তভোগীদের অধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত বিধান রাখা হয়েছে। জানা যাক, কী কী আছে এই অধ্যাদেশে।

গুমের সংজ্ঞা ও অপরাধের পরিধি

অধ্যাদেশে গুমের সংজ্ঞাকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩-এর অধীনে ‘ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি’ বা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গুমকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

কোনো ব্যক্তি যদি সরকারি বাহিনী বা তাদের মদদপুষ্ট কারো দ্বারা অপহৃত বা আটক হয়ে নিখোঁজ থাকেন এবং রাষ্ট্র তার আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে, তবে তা গুম বলে গণ্য হবে। এই অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

ট্রাইব্যুনাল গঠন ও বিচার প্রক্রিয়া

গুমের ঘটনার দ্রুত ও নিরপেক্ষ বিচারের জন্য একটি বিশেষ ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করা হবে। এই ট্রাইব্যুনাল গুমের অভিযোগ তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করবে। ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারকদের নিয়োগ দেওয়া হবে।

মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার এই ট্রাইব্যুনালের জন্য পাবলিক প্রসিকিউটর বা সরকারি কৌঁসুলি নিয়োগ দেবে। তবে, ভুক্তভোগী পরিবার বা অভিযোগকারী চাইলে তাদের পছন্দমতো আইনজীবী নিয়োগ করে মামলা পরিচালনা করতে পারবে। বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ট্রাইব্যুনালকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

গুম হওয়া ব্যক্তির মর্যাদা ও সম্পত্তি ব্যবহার

এই অধ্যাদেশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হলো গুম হওয়া ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত জটিলতার অবসান। পূর্বে গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবার তার সম্পত্তি ব্যবহার বা বিক্রি করতে পারত না, কারণ নিখোঁজ ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করতে হলে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হতো।

নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি পাঁচ বছর বা তার বেশি সময় গুম থাকেন ও জীবিত ফিরে না আসেন, তবে ট্রাইব্যুনাল তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গুম’ ঘোষণা করতে পারবে। এর ফলে তার স্ত্রী বা নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যরা কমিশনের পূর্বানুমতি ছাড়াই গুম হওয়া ব্যক্তির স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ব্যবহার এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবেন। যা ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করবে।

গোপন আটক কেন্দ্র পরিদর্শন ও তথ্য অধিকার

গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশনের ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়েছে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কমিশন বা ট্রাইব্যুনাল দেশের যেকোনো কারাগার, হাজতখানা, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র, থানা বা গোপন আটক কেন্দ্র (আয়নাঘর-সদৃশ জায়গা) আচমকা পরিদর্শনের ক্ষমতা রাখবে।

সেখানে আটক ব্যক্তিদের তালিকা, পরিচয় এবং তাদের প্রতি কী আচরণ করা হচ্ছে, তা তদন্ত করার এখতিয়ার কমিশনের থাকবে। এমনকি সন্দেহজনক কোনো স্থান বা স্থাপনায় প্রবেশ করে তল্লাশি চালানোর ক্ষমতাও তাদের দেওয়া হয়েছে। যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিত করবে।

ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন

অধ্যাদেশে গুমের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের বিধান রাখা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল যদি মনে করে যে ভুক্তভোগী পরিবার আর্থিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে তারা অপরাধীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ দিতে পারবে।

এছাড়া গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসন, চিকিৎসা ও আইনি সহায়তার জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের কথাও বলা হয়েছে। সরকার এই তহবিলে অর্থ বরাদ্দ করবে ও কমিশন তা পরিচালনা করবে।

ভুয়া বা মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

গুমের অভিযোগ তুলে কেউ যাতে মিথ্যা মামলা দিয়ে কাউকে হয়রানি করতে না পারে, সেজন্য অধ্যাদেশে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যদি কোনো অভিযোগ তদন্তে মিথ্যা বা ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়, তবে অভিযোগকারীকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। একই সঙ্গে, গুমের শিকার ব্যক্তিদের বা সাক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ ‘শিল্ড ল’ বা সুরক্ষা আইনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে তারা ভীতিমুক্ত হয়ে সাক্ষ্য দিতে পারেন।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

অধ্যাদেশটিতে গুমের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পথও খোলা রাখা হয়েছে। যদি কোনো গুম হওয়া ব্যক্তির লাশ বা দেহাবশেষ অন্য কোনো দেশে পাওয়া যায় বা অপরাধীরা বিদেশে পালিয়ে যায়, তবে তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ সরকার সেই দেশের সঙ্গে আইনি সহায়তা বিনিময় করতে পারবে। যা গুমের মতো আন্তঃসীমান্ত অপরাধ মোকাবিলায় কার্যকর হবে।

‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় যুগান্তকারী সংযোজন। এটি কেবল অপরাধীদের শাস্তির বিধান করেনি, বরং ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর মানবিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক সুরক্ষাকেও প্রাধান্য দিয়েছে।

পাঁচ বছর নিখোঁজ থাকার পর সম্পত্তি ব্যবহারের অধিকার পাওয়া এবং গোপন আটক কেন্দ্র পরিদর্শনের ক্ষমতা—এগুলো গুমের সংস্কৃতি বন্ধে ও ভুক্তভোগীদের জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত