দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে আজ বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) দেশে ফিরেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে তাঁকে বহনকারী উড়োজাহাজটি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ২০০৮ সালে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশ ছাড়ার পর এটিই তাঁর প্রথম স্বদেশে ফেরা।
তারেক রহমান কেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে দেশ ছেড়েছিলেন
তারেক রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে সংকটময় সময় শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর। তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘বিরাজনীতিকরণ’ বা ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসেবে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে তাঁর সেনানিবাসের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময় তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে অন্তত এক ডজন মামলা করা হয়েছিল। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, রিমান্ডে থাকাকালে তাঁর ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, যার ফলে তাঁর মেরুদণ্ডের হাড় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
টানা ১৮ মাস কারাগারে থাকার পর তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি জামিন পান। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের নির্বাহী আদেশে ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। সে সময় বিষয়টিকে কেবল ‘চিকিৎসা সফর’ হিসেবে দেখা হলেও পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তা দীর্ঘ নির্বাসনে রূপ নেয়।
প্রবাসে থাকা অবস্থায় তিনি যেভাবে দল পরিচালনা করেছেন
লন্ডনে অবস্থানকালেও তারেক রহমান বিএনপির রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। ২০০৯ সালের কাউন্সিলে তাঁকে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়। তবে তাঁর নেতৃত্বে বড় পরিবর্তন আসে ২০১৮ সালে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
লন্ডনে বসেই তিনি স্কাইপ, জুম ও অন্যান্য ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপের মাধ্যমে দলের নীতিনির্ধারণী সভা পরিচালনা করতেন। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা ও ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে তিনি দলের কমান্ড বজায় রাখেন। সমালোচকেরা একে ‘রিমোট কন্ট্রোল রাজনীতি’ বললেও বিএনপির নেতা-কর্মীরা মনে করেন, তাঁর এই সক্রিয়তার কারণেই দীর্ঘ দেড় দশকের দমন-পীড়নের মধ্যেও দল ঐক্যবদ্ধ থাকতে পেরেছে।
তারেক রহমানের সামনে যেসব আইনি বাধা ছিল
তারেক রহমানের দেশে ফেরার পথে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল তাঁর বিরুদ্ধে থাকা বিভিন্ন মামলার রায়। এর মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তাঁকে যাবজ্জীবন এবং জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া মুদ্রা পাচার মামলাসহ সারা দেশে তাঁর বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এসব মামলা ও সাজাকেই তাঁর ফেরার পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা হতো।
৫ আগস্টের পট-পরিবর্তন যেভাবে তারেকের ফেরার পথ সুগম করল
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ও প্রশাসনিক কাঠামোতে ব্যাপক রদবদল নিয়ে আসে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা মামলাগুলো পুনর্বিবেচনার সুযোগ তৈরি হয়। বিএনপির দাবি অনুযায়ী, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে থাকা সব মামলাই ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক। ৫ আগস্টের পর উচ্চ আদালতে তাঁর কয়েকটি মামলার সাজা স্থগিত ও জামিন মঞ্জুরের প্রক্রিয়া শুরু হলে তাঁর ফেরার পথ সুগম হয়।
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন বিএনপির জন্য একটি বিশাল সাংগঠনিক মাইলফলক। সশরীরে উপস্থিত থেকে দল পরিচালনা করার ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এখন দ্রুত হবে। নেতা-কর্মীদের কাছে তাঁর ফেরা একটি ‘রাজনৈতিক বিজয়’ হিসেবে দেখা দিচ্ছে, যা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কর্মীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা জোগাবে।
তারেক রহমানের ফেরা দেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকায় বিএনপিই এখন প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চায়। ইতিমধ্যে তারেক রহমান ‘৩১ দফা’ রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন। তাঁর সরাসরি উপস্থিতিতে এই সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে জনমত গঠন করা সহজ হবে। এ ছাড়া ভারতসহ প্রতিবেশী দেশ ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে।
তারেক রহমানের সামনে চ্যালেঞ্জগুলো কী কী
তবে দেশে ফেরার পর তাঁর সামনে আইনি ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও কম নয়। প্রথমত, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সব মামলা থেকে স্থায়ীভাবে খালাস পাওয়া তাঁর জন্য জরুরি। দ্বিতীয়ত, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেড়েছে। পুরোনো ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া তাঁর জন্য বড় পরীক্ষা। একই সঙ্গে দীর্ঘ সময় পর সরাসরি নেতৃত্বে ফিরে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা তাঁর অন্যতম প্রধান কাজ হবে।
তারেক রহমানের বাংলাদেশে ফেরা কেবল একজন নেতার ঘরে ফেরা নয়, বরং এটি একটি নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের সূচনা। ২০০৭ সালের সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, আর ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁর সামনে একদিকে যেমন রাষ্ট্র পরিচালনার সম্ভাবনা রয়েছে, অন্যদিকে জনমানুষের প্রত্যাশার বিশাল চাপও রয়েছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় তারেক রহমান এখন কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন, তার ওপরই নির্ভর করছে দেশের আগামীর রাজনীতির গতিপথ।