leadT1ad

যে জীবন চার্লি চ্যাপলিনের, কেন তিনি আজও এত জনপ্রিয়

আজ ২৫ ডিসেম্বর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মূকাভিনেতা ও কৌতুকাভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনের মৃত্যুদিন। এই কিংবদন্তি অভিনয়শিল্পী দর্শককে মুগ্ধ করে গেছেন জীবনভর। আজও তাঁর অভিনয় বিনোদনের অন্যতম খোরাক। আজও তিনি জনপ্রিয়। কিন্তু কেন? কী জাদুকরী শক্তি লুকিয়ে আছে সময়কে জয় করা এই অভিনেতার মধ্যে? চার্লি চ্যাপলিনের কর্মময় জীবনের গভীরে গিয়ে সেই উত্তর খোঁজা যাক।

ফাবিহা বিনতে হক
ফাবিহা বিনতে হক

প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭: ৩৪
চার্লি চ্যাপলিন। ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

মাথায় কালো বাউলার হ্যাট, গায়ে বেমানান ঢিলেঢালা প্যান্ট, পায়ে বিশাল সাইজের জুতো, হাতে একটি ছড়ি আর ঠোঁটের ওপর অদ্ভুত গোঁফ। তিনি যখন পর্দায় আসেন, তখন কোনো সংলাপ ছাড়াই হাসির রেশ ছড়িয়ে পড়ে দর্শকের মাঝে। সেই মানুষটি স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন, সংক্ষেপে চার্লি চ্যাপলিন।

চলচ্চিত্রের ইতিহাসে পার হয়ে গেছে শত বছরেরও বেশি সময়। প্রযুক্তির কল্যাণে সিনেমা নির্বাক চলচ্চিত্র থেকে থ্রি-ডি আর ভিএফএক্স-এর যুগে প্রবেশ করেছে। তবুও চার্লি চ্যাপলিনের আবেদন কমেনি বিন্দুমাত্র। বর্তমান যুগের দর্শকদের কাছেও তিনি সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

কিন্তু কেন? কী জাদুকরী শক্তি লুকিয়ে আছে সময়কে জয় করা এই অভিনেতার মধ্যে? চার্লি চ্যাপলিনের কর্মময় জীবনের গভীরে গিয়ে সেই উত্তর খোঁজা যাক।

লন্ডনের বস্তি থেকে বিশ্বমঞ্চে

পর্দায় চার্লি চ্যাপলিনের যে হাসি আমরা দেখি, তার পেছনের গল্পটা কিন্তু চরম বেদনার। ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল লন্ডনের এক দরিদ্র পরিবারে তাঁর জন্ম। শৈশব কেটেছে চরম দারিদ্র্য আর কষ্টের মধ্যে। বাবা ছিলেন মদ্যপ, মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। ছোট চার্লিকে একাধিকবার আশ্রয় নিতে হয়েছে এতিমখানা বা ‘ওয়ার্কহাউসে’।

চলচ্চিত্র নির্মাতা চার্লি চ্যাপলিন। সংগৃহীত ছবি
চলচ্চিত্র নির্মাতা চার্লি চ্যাপলিন। সংগৃহীত ছবি

পেটের দায়ে চার্লি চ্যাপলিন নানান ধরণের কাজ করেছেন। এভাবেই কেটেছে তাঁর শৈশব। এই কঠিন বাস্তবতাই তাঁকে শিখিয়েছিল কীভাবে কান্নাকে হাসিতে রূপান্তর করতে হয়। ভাগ্য বদলাতে ১৯১৩ সালে পাড়ি জমান আমেরিকায় এবং সেখানে কি-স্টোন স্টুডিওতে যোগ দেন। এরপর থেকেই তাঁর ভাগ্য বদলাতে শুরু করে। ১৯১৪ সালে তিনি তৈরি করেন সেই অমর চরিত্র ‘দ্য লিটল ট্র্যাম্প’ বা ভবঘুরে। বাকিটা ইতিহাস।

কেন তিনি আজও এত জনপ্রিয়?

চার্লি চ্যাপলিনের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার পেছনে রয়েছে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কারণ, যা তাঁকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে।

চ্যাপলিনের জনপ্রিয়তার সবচেয়ে বড় কারণ হলো তাঁর অসাধারণ ‘নির্বাক’ অভিনয়। তিনি এমন সময়ে সিনেমা বানিয়েছেন যখন সিনেমায় শব্দের ব্যবহার ছিল না। তাই তিনি অভিনয় করতেন ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’ বা অঙ্গভঙ্গি দিয়ে। একজন মানুষ কলার খোসায় পা পিছলে পড়ে গেলে তা দেখে হাসার জন্য ইংরেজি বা ফরাসি ভাষা জানার দরকার হয় না। তিনি ছিলেন ‘বিশ্বনাগরিক’, যার একটাই ভাষা, আর তা হলো হাসি।

১৯১৩ সালের একটি কমেডি শো'র পোস্টার। উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া ছবি
১৯১৩ সালের একটি কমেডি শো'র পোস্টার। উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া ছবি

চার্লি চ্যাপলিন মানুষের ভেতরকার টানাপড়েন ভালোমত বুঝতেন। তাঁর সৃষ্ট ‘দ্য ট্র্যাম্প’ চরিত্রটি ছিল একজন নিঃস্ব, গৃহহীন ভবঘুরে মানুষের। কিন্তু তাঁর আভিজাত্যবোধ ও আত্মসম্মানও ছিল। সে পুলিশের তাড়া খায়, বড়লোকদের লাথি খায়, কিন্তু ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে টাই ঠিক করে আবার হাঁটতে শুরু করে। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই জীবনযুদ্ধে কোনো না কোনোভাবে লড়াই করেছে। সাধারণ মানুষ চ্যাপলিনের এই ভবঘুরে চরিত্রটির মধ্যে নিজেদের সংগ্রামের ছায়া দেখতে পায়। তাঁর অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন যে পকেট খালি থাকলেও মনটা রাজার মতো হতে পারে।

চার্লি চ্যাপলিন দর্শকদের শুধু হাসাননি, কাঁদিয়েছেনও। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘জীবনটা ক্লোজ-আপে দেখলে ট্র্যাজেডি, কিন্তু লং-শটে দেখলে কমেডি।’ তাঁর ‘দ্য কিড’ সিনেমায় যখন পুলিশ পালিত সন্তানকে কেড়ে নিয়ে যায়, তখন তার করুণ চাউনি দেখে দর্শকদের চোখে জল চলে আসে। আবার পরক্ষণেই তার কান্ড দেখে দর্শক হাসিতে লুটিয়ে পড়েন। মানুষের আবেগের এই জায়গাটুকু তিনি খুব গভীরভাবে স্পর্শ করতে পারতেন। কমেডির আড়ালে এই মানবিক আবেদনই অমর করেছে তাঁকে।

এছাড়া কমেডির ভেতরেই চ্যাপলিন দিয়েছেন সমাজ সংস্কারের বার্তা। ‘মডার্ন টাইমস’ (১৯৩৬) সিনেমায় তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে শিল্পবিপ্লব ও যন্ত্রসভ্যতা মানুষকে মেশিনে পরিণত করছে এবং গরিবরা আরও গরিব হচ্ছে। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন হিটলারের ভয়ে সারা বিশ্ব কাঁপছে, তখন তিনি বানালেন ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ (১৯৪০)। সেখানে তিনি হিটলারকে ব্যঙ্গ করে দাঁড়ালেন মানবতার পক্ষে। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এমন সিনেমা বানানো ছিল চরম সাহসিকতার কাজ।

প্রভাববিস্তারী চ্যাপলিন

চ্যাপলিনের জনপ্রিয়তা যে কত বিশাল ছিল, তা ইতিহাস ঘাটলেই বোঝা যায়। একবার বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে চ্যাপলিনের দেখা হয় একটি সিনেমার প্রিমিয়ারে। সেখানে তাঁদের কথোপকথনের একটি গল্প খুবই ‘প্রচলিত’।

চার্লি চ্যাপলিন কালেকশন। ইনস্ট্রাগ্রাম থেকে নেওয়া ছবি
চার্লি চ্যাপলিন কালেকশন। ইনস্ট্রাগ্রাম থেকে নেওয়া ছবি

সেখানে আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘আমি আপনার কাজ খুব পছন্দ করি, কারণ আপনি কোনো কথা বলেন না, তবুও সারা পৃথিবী আপনাকে বোঝে।’ উত্তরে চ্যাপলিন হেসে বলেছিলেন, ‘কিন্তু স্যার, আপনার জনপ্রিয়তা আরও বিস্ময়কর। কারণ পৃথিবীর কেউ আপনার থিওরি বোঝে না, তবুও সবাই আপনাকে পছন্দ করে!’

শোনা যায়, হিটলার নাকি ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ সিনেমাটি দুইবার দেখেছিলেন। যদিও তিনি সিনেমাটি নিষিদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু চ্যাপলিনের প্রতি তাঁর এক ধরণের গোপন কৌতুহল ছিল।

১৯৭২ সালে যখন চ্যাপলিনকে একাডেমি সম্মাননা (অস্কার) দেওয়া হয়, তখন উপস্থিত দর্শকরা তাঁকে সম্মান জানিয়ে টানা ১২ মিনিট দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছিলেন। অস্কারের ইতিহাসে এটি এখন পর্যন্ত দীর্ঘতম ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’।

আজকের আধুনিক কমেডিয়ানদের সবাই কোনো না কোনোভাবে চ্যাপলিনের দ্বারা প্রভাবিত। কারণ অত্যন্ত প্রতিভাবান এই মানুষটি ছিলেন ‘পারফেকশনিস্ট’। একটি দৃশ্য নিখুঁত করার জন্য তিনি শতবার রি-টেক নিতেন। তিনি নিজেই লিখতেন, পরিচালনা করতেন, অভিনয় করতেন এবং সংগীত পরিচালনা করতেন। প্রযুক্তি পাল্টেছে, পাল্টেছে মানুষের রুচিবোধ কিন্তু মানুষের মৌলিক আবেগ যেমন হাসি, কান্না, ক্ষুধা কিংবা ভালোবাসার অনুভূতি, কখনও পাল্টায় না। চার্লি চ্যাপলিন এই ধ্রুব সত্যগুলোকে ধারণ করে নির্মাণ করেছেন তাঁর সিনেমাগুলো। তাই যতদিন মানুষ হাসতে চাইবে, ততদিন চার্লি চ্যাপলিন বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত