leadT1ad

১৬ ডিসেম্বর ঢাকাকে যেমন দেখেছিলেন নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন সাতজন বিদেশি সাংবাদিক। তাঁদের একজন নিউইয়র্ক টাইমস-এর বিশেষ প্রতিনিধি সিডনি এইচ. শ্যানবার্গ। পরের দিন ১৭ ডিসেম্বর তাঁর চোখে দেখা সেই দিনটির বিবরণ নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায় ছাপা হয়।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সংগৃহীত ছবি

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ঢাকার আশেপাশে তখনও থামেনি যুদ্ধ। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যখন পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি চলছে, শহরের প্রান্তে তখনও শোনা যাচ্ছিল কামানের গর্জন, মেশিনগানের শব্দ।

সেদিন ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন সাতজন বিদেশি সাংবাদিক। তাঁদের একজন নিউইয়র্ক টাইমস-এর বিশেষ প্রতিনিধি সিডনি এইচ. শ্যানবার্গ। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর তাঁর চোখে দেখা সেই দিনটির বিবরণ নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায় ছাপা হয়।

শ্যানবার্গের চোখে ১৬ ডিসেম্বরের ঢাকা

ঢাকার দিকে আসার পথে শ্যানবার্গ দেখেছিলেন যুদ্ধ তখনও চলছে। গ্রামের ধানক্ষেতে গোলা আছড়ে পড়ছে, পাকিস্তানি ঘাঁটিতে কামানের আঘাতে আগুন জ্বলছে। গোলা নিশানায় লাগলে আশপাশের গ্রামবাসী হাততালি দিয়ে উঠছিল। একজন অফিসার চেঁচিয়ে বলেছিলেন, ‘সাবাশ! নিশানায় লেগেছে। ওদের কয়েকটা গাড়ি উড়ে গেছে।’

ঢাকার বাইরে তখনও অনেক মুক্তিযোদ্ধা জানতেন না যে শহরে আত্মসমর্পণের আয়োজন চলছে। ডেমরার দিকে শত্রুপক্ষের ঘাঁটিতে আঘাত হানার দৃশ্য শ্যানবার্গ নিজের চোখে দেখেন। শীতলক্ষ্যার ওপারে শুরু হয় প্রবল গোলাবর্ষণ। টানা ২০ মিনিট গোলা ছোড়ার পর মেশিনগানের গুলি চলে।

১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর। সংগৃহীত ছবি
১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর। সংগৃহীত ছবি

বেলা সাড়ে বারোটার দিকে সাংবাদিকরাও সেনাদের সঙ্গে এগোতে থাকেন ঢাকায়। হঠাৎ পাকিস্তানি মেশিনগান গর্জে ওঠে। সবাই বাঁধের আড়ালে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাথার ওপর দিয়ে সাঁই সাঁই করে উড়ে যায় গুলি। সেই গোলাগুলিতে একটি নিরীহ ছাগলছানা মারা পড়ে পড়ে থাকে। হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগোতে হয় তাঁদের সবাইকে।

দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে পরিস্থিতি কিছুটা বদলায়। পাকিস্তানিরা আরও প্রায় এক ঘণ্টা লড়াই চালিয়ে যায়। বেলা ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে নদীর ওপারে এক পাকিস্তানি সেনা বেরিয়ে আসে, শ্যানবার্গের মনে হচ্ছিল তিনি একজন অফিসার। তাঁর হাতে ছিল একটি বড় সাদা রুমাল। তিনি সেটি নাড়াতে থাকেন।

ভারতীয় মেজর এম এস ধিলোন দেয়ালের আড়াল থেকে চিৎকার করে নির্দেশ দেন, অস্ত্র ফেলে নৌকায় করে সামনে আসতে। সাংবাদিকরা তখন তাঁর ঠিক পেছনে। মেজরই পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন, ‘সাদা রুমাল মানে তাঁরা হার মেনেছে।’ তাঁর ধারণা অনুযায়ী, বাকি পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে গেছে।

যুদ্ধ থামার পরও দূরে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু সংগঠিত প্রতিরোধ আর ছিল না। সাধারণ মানুষের চোখে মুখে আনন্দে। কামানের গাড়ি ঠেলতে সাহায্য করছিল তাঁরা।

শ্যানবার্গ দেখেছিলেন, রাস্তায় নেমে আসছে মানুষের ঢল। ট্যাংক, ট্রাক, রিকশা, সাইকেল—যা পাওয়া যায়, তাতেই চড়ে সবাই ঢাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যটা কোনো সামরিক বহরের মতো নয়, বরং এক বিজয় মিছিল। পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবারা তাঁদের কোলের শিশুদের তুলে ধরছিলেন সেনাদের দেখানোর জন্য।

১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতার ছবি।
১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতার ছবি।

শীতলক্ষ্যা পার হয়ে শ্যানবার্গ ওঠেন ব্রিগেডিয়ার মিশ্রের জিপে। ঢাকার দিকে এগোতে গিয়ে তিনি দেখেন পাকিস্তানি বাহিনী পালানোর সময় ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে। একটি দৃশ্য বারবার চোখে পড়ছিল তাঁর। তিনি দেখছিলেন রাস্তায় পরাজিত পাকিস্তানি সেনাদের। এখন তাঁদের চোখেমুখে আতঙ্ক। কেউ হাত নাড়ালেও ভয় পাচ্ছিল।

ব্রিগেডিয়ার মিশ্র একটি পাকিস্তানি ব্যারাকের সামনে থেমে কড়া নির্দেশ দেন, রাস্তায় বেরোনো নিষেধ। কারণ মুক্তিবাহিনী পেলেই প্রতিশোধ নিতে পারে। সঙ্গে থাকা এক অফিসার বলেন, যদি প্রটেকশন না দেওয়া হয়, মুক্তিবাহিনী তাঁদের কচুকাটা করবে।

ঢাকায় ঢোকার সময় একদল মানুষ ‘স্বাগতম’ স্লোগান দিতে দিতে জিপের দিকে এগিয়ে আসে। ঠিক তখন উল্টো দিক থেকে আসা একটি পাকিস্তানি জিপ আতঙ্কে গুলি চালায়। দুইজন বাঙালি গুলিতে লুটিয়ে পড়েন। জনতা দ্রুত তাঁদের সরিয়ে নেয়। ভারতীয় অফিসাররা পাকিস্তানিদের অস্ত্র কেড়ে নেন এবং পাহারায় নিয়ে যান।

বিমানবন্দরের দিকে আসার পথে বড় বড় গর্ত। রানওয়ের পাশে পড়ে আছে ধ্বংস হওয়া যুদ্ধবিমান। জনশূন্য বাড়িঘর। হঠাৎ করেই মানুষের ঢল নেমে আসে। তাঁরা গাড়ি ঘিরে ধরে, ‘ভাই’ বলে ডাকে, ছুঁয়ে দেখতে চায়।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সূর্য ডোবার আগেই ১০টি ভারতীয় হেলিকপ্টার নামে বিমানবন্দরে। জেনারেল অরোরা আসেন। সই হয় আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক দলিলে।

রাত নেমে আসে ঢাকায়। পাকিস্তানি সেনাদের চোখেমুখে তখন একধরনের স্বস্তি, অন্তত ক্ষুব্ধ জনতার হাত থেকে প্রাণে বাঁচা গেছে।

এই ছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক সিডনি এইচ. শ্যানবার্গের দেখা ঢাকা।

Ad 300x250

সম্পর্কিত