leadT1ad

দ্য লাস্ট ফ্লাইট বিফোর সানশাইন: আত্মসমর্পণের আগে হেলিকপ্টারে পালানো পাকিস্তানি সেনারা

১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে এবং ১৬ ডিসেম্বর দুপুরে পাকিস্তান বাহিনীর ৪ আর্মি এভিয়েশন স্কোয়াড্রনের পাইলট এবং বেশ কিছু সেনা কর্মকর্তা বার্মার (মায়ানমার) উদ্দেশ্যে সপরিবারে হেলিকপ্টারে করে পালিয়েছিলেন।

সুমন সুবহান
সুমন সুবহান

প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪: ০২
১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের অ্যালিউট-৩ হেলিকপ্টার। ১৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে এবং ১৬ ডিসেম্বর দুপুরে পালানোর ক্ষেত্রে এই হেলিকপ্টার ছিল পাকিস্তানিদের ভরসা। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তাক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। তবে তার আগে পরাজয় নিশ্চিত জেনে এই দেশের সেরা মানুষগুলোকে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে, সম্পদ লুট করেছে, পুড়িয়ে ছাই করেছে ব্যাংক নোট।

পাশাপাশি একদম অন্তিম মুহুর্তে নিজেরা পালাতে চেষ্টাও করেছে। তবে সবাই না, কেউ কেউ সফল হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে এবং ১৬ ডিসেম্বর দুপুরে ৪ আর্মি এভিয়েশন স্কোয়াড্রনের পাইলট এবং বেশ কিছু সেনা কর্মকর্তা বার্মার (মায়ানমার) উদ্দেশ্যে সপরিবারে হেলিকপ্টারে করে পালিয়েছিলেন। এদের মধ্যে কুখ্যাত খুনি মেজর জেনারেল মোহাম্মদ রহিম খানও ছিলেন।

ডিসেম্বরের ৩-৪ তারিখেই উপর্যুপরি এয়ার স্ট্রাইকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অধিকাংশ যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়ে যায়। বোমার আঘাতে রানওয়ে হয়ে পড়ে উড্ডয়নের অনুপযোগী। এর মধ্যে জাতিসংঘের কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারকে ঢাকা থেকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে জাতিসংঘের মহাসচিব দু’পক্ষকে আহ্বান জানান। এজন্য ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্সের একটি সি-১৩০ বিমান ৭ ডিসেম্বর তেজগাঁ বিমানবন্দরের ওপর চক্কর দিলেও নামতে পারেনি। ভারত জাতিসংঘের আহ্বানে সায় দিয়ে আক্রমণ স্থগিত রাখলেও পাকিস্তান অস্বীকৃতি জানানোর কারণে সেটি ব্যাংককে ফিরে যায়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সংগৃহীত ছবি
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সংগৃহীত ছবি

১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর রাতে রাও ফরমান আলীসহ শীর্ষ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে নিতে ছয়টি এয়ারক্রাফট তেজগাঁয় ল্যান্ড করবে, এমন তথ্য গোয়েন্দাদের মাধ্যমে মিত্রবাহিনী জানতে পারে। তাদের এই পরিকল্পনাটা বানচাল করতে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বোমাবর্ষণ তীব্রতর করা হয়। তুমুল বোম্বিং-এর কারণে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ে অকেজো হয়ে যায়।

কুর্মিটোলা ও তেজগাঁয় সেদিন রাত আড়াইটা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত আটটি ক্যানবেরা বোমারু চার হাজার পাউন্ড ওজনের বিধ্বংসী বোমা ফেলে। আর চার টা মিগ ও দুইটা ক্যারিবাস পর্যায়ক্রমে চক্কর দেয়। পরের দিন ১২ ডিসেম্বরে একটি হারকিউলিস বিমানে সাড়ে চার শ বিদেশি নাগরিক ঢাকা ত্যাগ করেন। এরপর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড ভারতের সাথে সমঝোতায় আসার জন্য জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠাতে থাকে। তবে ভারত নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের দাবী জানায়।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর লে. জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। সেজন্য ১৫ ডিসেম্বর রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আত্মসমর্পনের তোরজোর শুরু হয়ে যায়। আর্টিলারি গান, ট্যাঙ্ক, হেলিকপ্টার ইত্যাদি ভারী সামরিক সরঞ্জামগুলো যেন রক্ষা করা যায় সেজন্য ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকী, চীফ অফ স্টাফ, ইস্টার্ণ কমান্ড সেসব ধ্বংস করার নির্দেশ দেন।

১৬ ডিসেম্বরে দুপুর একটার দিকে মেজর জারিফ, মেজর তৌহিদ উল হক এবং মেজর এজাজ ইস্টার্ণ কমান্ডের জন্য স্ট্যান্ড বাই করে রাখা অ্যালিউট-৩ হেলিকপ্টার এবং আগের দিন রাতে ফ্লাই করতে না পারা অ্যালিউট-৩ হেলিকপ্টার নিয়ে মেজর মাসুদ আনোয়ার এবং মেজর সাগির ঢাকা থেকে ফ্লাই করে চারটা ৩০ মিনিটে আকিয়াবে ল্যান্ড করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় আত্মসমর্পণের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয়া হলে লে. জেনারেল নিয়াজী তা বাড়াতে আবেদন জানান। মিত্রবাহিনী তাদের সেই অনুরোধ মেনে নিয়ে যুদ্ধবিমানগুলো ফিরিয়ে নেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৪ আর্মি এভিয়েশন স্কোয়াড্রনের পাইলটরা যেন ঠিক এই সময়টির অপেক্ষাতেই ছিল।

যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পূর্ব রণাঙ্গনে বলতে গেলে আকাশে ওড়ানোর মতো কিছুই অবশিষ্ট ছিলনা। রানওয়ে অনুপযোগী থাকায় কোন যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা যাচ্ছিল না। তবে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ৪ আর্মি এভিয়েশন স্কোয়াড্রন, রাশিয়ান এমআই-৮ এবং ফ্রান্সের তৈরি অ্যালিউট-৩ হেলিকপ্টার নিয়ে তারা রাতের আঁধারে সাপ্লাই ও ইভ্যাকুয়েশনের মতো জরুরি কাজগুলো সারতে চেষ্টা করতো।

জানা যায় যে, আর্মি এভিয়েশনের কয়েকটা হেলিকপ্টার ১৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে ঢাকা সেনানিবাসের কুর্মিটোলা গলফ কোর্স থেকে বার্মার আকিয়াবের উদ্দেশ্যে ফ্লাই করেছিল। এরপর ১৬ ডিসেম্বর দুপুরে আরো দু’টি। তবে হেলিকপ্টারের সঠিক সংখ্যাটা নিয়ে বেশ বিভ্রান্তি আছে। একেকজনের ভাষ্য অনুযায়ী সংখ্যাটা একেকরকম।

সিদ্দিক সালিকের ভাষ্য অনুযায়ী, মাঝরাতে ৪ আর্মি এভিয়েশন স্কোয়াড্রনের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল লিয়াকত আসরার বুখারিকে ডেকে ২৮টি পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তাদের পরিবার ও আটজন নার্সকে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর দিয়ে আকিয়াবে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। তার লেখায় মাত্র তিনটা হেলিকপ্টারের কথা জানা যায়।

তবে আত্মসমর্পণের ঘণ্টাকয়েক আগে দুপুর একটার দিকে যে দুইটি হেলিকপ্টার ঢাকা ছেড়েছে তার একটির পাইলট ছিলেন মেজর মাসুদ আনোয়ার। তার হিসেব অনুযায়ী হেলিকপ্টারের মোট সংখ্যা ছয়টি, এরমধ্যে তিনটি ছিল রাশিয়ান এমআই-৮ আর অন্য তিনটা ছিল ফ্রান্সের তৈরি অ্যালিউট-৩।

আবার অ্যালিউট-৩ হেলিকপ্টারের পাইলট মেজর জারিফের হিসাব অনুযায়ী সংখ্যাটা আসলে সাত, এরমধ্যে তিনটা এমআই-৮ আর চারটা অ্যালিউট-৩ হেলিকপ্টার। এগুলোকে কুর্মিটোলা গলফ কোর্সের ভেতরে এবং সেনানিবাসের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে রাখা হয়েছিল। লে. কর্নেল বুখারির হিসেবের সঙ্গে অবশ্য এই সংখ্যাটা মিলে যায়। মেজর জারিফ, মেজর তৌহিদুল হক এবং ইএমই কোরের একজন ইঞ্জিনিয়ার, মেজর এজাজকে একটি অ্যালিউট-৩ সহ ইস্টার্ণ কমান্ডের প্রয়োজনে ঢাকায় স্ট্যান্ড বাই রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

তবে আগের রাতে যে ছয়টি হেলিকপ্টার বার্মার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার কথা, তাতে মেজর সাগির এবং মেজর মাসুদ আনোয়ারের অ্যালিউট-৩ হেলিকপ্টারটা ব্যাটারির ত্রুটির কারণে সেদিন রাতে আকিয়াবে যেতে পারেনি। একটা এমআই-৮ হেলিকপ্টারের অতিরিক্ত জ্বালানীসহ ধারণ ক্ষমতা ১০ জন যাত্রী হলেও তাদেরকে এরচেয়ে অনেকবেশি, ৩০জন করে যাত্রী বহন করতে হয়েছিল।

তবে আকিয়াবে পৌঁছে দেখেন তারা সেদিন যাত্রী-ক্রু মিলে মোট ১২৩ জনকে বহন করেছিলেন। ঢাকা থেকে আকিয়াব পর্যন্ত ফ্লাইট টাইম আড়াই ঘন্টা হলেও পাইলটদেরকে ৩ ঘন্টা ফ্লাই করার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়।

রাত দুইটার দিকে পাইলটরা গলফ কোর্স এবং সেনানিবাসের বিভিন্ন স্থানে পার্ক করে রাখা হেলিকপ্টারের দিকে যান। লে. কর্নেল লিয়াকত আসরার বুখারির ভাষ্য অনুযায়ী ১৬ ডিসেম্বর ভোররাতে তিনি মেজর রিয়াজ উল হক এবং মেজর আলি খান প্রথম এমআই-৮ হেলিকপ্টার নিয়ে কুর্মিটোলা গলফ কোর্স থেকে ফ্লাই করেছিলেন। তার পরপরই মেজর আকরাম এবং মেজর জাওয়াহার দ্বিতীয় হেলিকপ্টারে ফ্লাই করেন।

মেজর নোমান রাত তিনটায় এবং মেজর পেট্রিক টিয়ের্নি রাত তিনটা ৩৫ মিনিটে তাদের অ্যালিউট-৩ হেলিকপ্টার নিয়ে ফ্লাই করেছিলেন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে উপকূল বরাবর বার্মার আকিয়াব সহজ পথ হলেও নিরাপত্তার খাতিরে পাইলটরা তা এড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা নারায়ণগঞ্জে নিয়োজিত বিমান প্রতিরক্ষা মেশিনগান এড়ানোর জন্য ঢাকা থেকে ২০ মাইল দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে এবং পরবর্তীতে আগরতলা রাডার স্টেশন থেকে দূরে থাকার জন্য দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ঘুরে ফেনী নদী অতিক্রম করে উজানের দিকে উপকূলরেখার সমান্তরালে পার্বত্যরেঞ্জ বরাবর আকিয়াবে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন।

এই রুটে কর্ণফুলী নদীর উপর রেলওয়ে ব্রিজটি ছিল তাদের সর্বশেষ চেক পয়েন্ট, যেখান থেকে পাইলটদের কম্পাসের কাঁটা ধরে ঘন বন-জঙ্গল বেষ্টিত উঁচু পাহাড়ের উপর দিয়ে যেতে হবে। মেজর বাজওয়াকে সার্চ এন্ড রেসকিউ করার প্রয়োজনে শেষ ফ্লাইটটা পরিচালনা করতে নির্দেশ দেয়া হয়।

১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৪ আর্মি এভিয়েশন স্কোয়াড্রন একমাত্র সেনা ইউনিট যাদের আংশিক জনবল আত্মসমর্পণ এড়িয়ে পালাতে পেরেছিল।

মেজর বাজওয়া বলেন, দীর্ঘপথ তিন ঘণ্টা ফ্লাইট টাইমের জন্য তার এমআই-৮ হেলিকপ্টারের ভেতরে আলাদা জ্বালানী ট্যাঙ্কে অতিরিক্ত এক টন জ্বালানী নেয়া হয়। অতিরিক্ত জ্বালানী বহনের কারণে তাকে ১১টা সীট সরিয়ে ফেলতে হয়েছিল, তারপরও ১০ যাত্রী ও তিনজন ক্রুসহ হেলিকপ্টারের মোট ১৩ জন বহন করার ক্ষমতা ছিল।

তবে তার কো-পাইলট মেজর জহুর আহমেদকে ককপিটের জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়েছিল। অ্যালিউট-৩ হেলিকপ্টারের ক্ষেত্রে ঢাকা থেকে আকিয়াব পর্যন্ত ফ্লাইট টাইম সাড়ে তিন ঘণ্টার উপরে হওয়ার কারণে তাদেরকে পথিমধ্যে কোথাও রি-ফুয়েলিং এর জন্য জেরিক্যানে অতিরিক্ত জ্বালানী বহন করতে হয়েছিল।

১৬ ডিসেম্বরে দুপুর একটার দিকে মেজর জারিফ, মেজর তৌহিদ উল হক এবং মেজর এজাজ ইস্টার্ণ কমান্ডের জন্য স্ট্যান্ড বাই করে রাখা অ্যালিউট-৩ হেলিকপ্টার এবং আগের দিন রাতে ফ্লাই করতে না পারা অ্যালিউট-৩ হেলিকপ্টার নিয়ে মেজর মাসুদ আনোয়ার এবং মেজর সাগির ঢাকা থেকে ফ্লাই করে চারটা ৩০ মিনিটে আকিয়াবে ল্যান্ড করেছিলেন।

মিত্রবাহিনী যুদ্ধবিরতি উপলক্ষ্যে এয়ার স্ট্রাইক সিজড করায় এবং সিজ ফায়ার বলবৎ থাকার কারণে পাকিস্তানিদের পক্ষে এভাবে আকিয়াবে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। বঙ্গোপসাগরে যুদ্ধজাহাজ আইএস বিক্রান্তের টহলের কথা বলা হলেও হেলিকপ্টারগুলো নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়ার ফলে জাহাজের রাডারে ধরা পড়ার কথা না। এছাড়া বাড়তি সতর্কতা হিসেবে হেলিকপ্টারের জানালার গ্লাস কাদা দিয়ে লেপে দেয়া হয়েছিল।

এরপর ১৯৭২ সালে জানুয়ারির শুরুতে বার্মার আমন্ত্রণে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একদল পাইলট রেঙ্গুন যায়। সেখান থেকে ব্যাংকক হয়ে করাচিতে হেলিকপ্টারগুলো ফিরিয়ে আনা হয়। তবে হেলিকপ্টারের সঠিক সংখ্যাটা আজও জানা যায়নি। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৪ আর্মি এভিয়েশন স্কোয়াড্রন একমাত্র সেনা ইউনিট যাদের আংশিক জনবল আত্মসমর্পণ এড়িয়ে পালাতে পেরেছিল।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত