leadT1ad

মুক্তিযুদ্ধের সময় এ কে খন্দকারের হাত ধরে যেভাবে যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর

মুক্তিযুদ্ধের উপসেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আবদুল করিম খন্দকার (এ কে খন্দকার) বীরউত্তম মারা গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর হাত ধরেই যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর। দেশ স্বাধীনের পর তিনিই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথম প্রধান ছিলেন। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের পুর্বাপর কথোপকথন: এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান, এস আর মীর্জা’ বই থেকে এ কে খন্দকারের বয়ানে শোনা যাক মুক্তিযুদ্ধের সময় যেভাবে গড়ে উঠছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনী।

এ কে খন্দকার
এ কে খন্দকার

এ কে খন্দকারের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর। ছবি: বাংলাদেশ বিমান বাহিনী

সত্যি কথা বলতে কি, বিমানবাহিনী আমিই গড়ে তুলি। এখানে এর পটভূমি প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি একসময় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বলেছিলাম, আমাদের বিমানবাহিনী গঠন করা দরকার। এটা একটা পর্যায়ে কাজে আসবে এবং একটা সময় পুরো যুদ্ধের গতিকে ঘুরিয়ে দিতে পারবে। আমি তাঁকে আরও বলেছিলাম যে পাকিস্তান বিমানবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা এই পাইলট যদি বসে থাকেন, তাহলে তাঁদের পেশাগত দক্ষতা কমে যেতে বাধ্য। তাঁদের উড্ডয়ন করার সুযোগ দিলে তাঁরা তাঁদের ব্যবহারিক জ্ঞানের ধারা অব্যাহত রাখতে পারবেন।

তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে তখন আমার এই কথাগুলো শুনেছিলেন। এর কিছুদিন পর তিনি একদিন আমাকে তাঁর দপ্তরে ডেকে পাঠান। খবর পেয়ে আমি তখনই তাঁর দপ্তরে গেলাম। গিয়ে দেখি তাঁর দপ্তরে কয়েকজন বসে আছেন। কে কে উপস্থিত ছিলেন, তা আমার এখন মনে পড়ছে না। তাঁদের মধ্যে খুব সম্ভবত ভারতীয় প্রতিরক্ষাসচিব কে বি লালও ছিলেন।

যা-ই হোক, তাজউদ্দীন আহমদ আমাকে বললেন, ‘ওনারা এসেছেন, ওনাদের সঙ্গে আপনি আলাপ করেন।’ তাঁরা আমার সঙ্গে যুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বললেন। আলোচনার একপর্যায়ে আমি বিমানবাহিনী গঠনের কথা বলতেই কে বি লাল বললেন, এই মুহূর্তে তাঁদের পক্ষে কোনো বিমান আমাদের দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁদের নিজেদেরই যুদ্ধবিমানের স্বল্পতা রয়েছে। তবে একটা কাজ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের পাইলটরা ভারতীয় স্কোয়াড্রনে উড্ডয়ন করতে পারেন। আমি তাঁকে বললাম যে পাইলটদের বিমান উড্ডয়নের কতগুলো নিয়ম আছে। কতগুলো কোড আছে। কতগুলো আইনগত ব্যাপার আছে। তাঁরা যে ভারতীয় বিমানে উড্ডয়ন করবেন, তখন কোন দেশের কোড ব্যবহার করবেন। ভারত, না বাংলাদেশ।

এ কে খন্দকারের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর। ছবি: বিমান বাহিনী
এ কে খন্দকারের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর। ছবি: বিমান বাহিনী

আমার এই কথায় অবশ্য তাদেরও কোনো উত্তর ছিল না। কে বি লাল বললেন, বাংলাদেশের পাইলটদের ভারতীয় কোড ও নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হবে। তিনি আরও বললেন যে মাস দেড়েকের মধ্যে এ ব্যাপারে কাজ শুরু করা যায়। এভাবে কথা হওয়ার পর আমি তাজউদ্দীন আহমদকে একান্তে বললাম যে বাস্তবিক পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। আমরা একটি স্বাধীন দেশ, আমরা অন্য দেশের কোড বা নিয়মকানুন অনুসরণ করতে পারি না। তারপর আমি আবার কে বি লালকে বললাম এবং অনুরোধ করলাম, যদি সম্ভব হয় তাহলে বাংলাদেশের পাইলটদের যেন কাজে লাগানো হয়। এটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য সহায়ক হবে।

এর কিছুদিন পর আমি জানতে পারলাম যে ভারত সরকার বাংলাদেশকে একটি ডিসি থ্রি বিমান দিচ্ছে। আর প্রশিক্ষণের জন্য জায়গা দিচ্ছে ভারতের পূর্বাঞ্চলের প্রদেশ নাগাল্যান্ডের একটা প্রত্যন্ত এলাকায়-জঙ্গলবেষ্টিত একটি স্থানে। স্থানটির নাম হলো ডিমাপুর। সেটা একটা প্রায় অব্যবহৃত বিমানক্ষেত্র। কয়েক দিনের মধ্যেই আমাকে বলা হলো বিমানবাহিনী গঠনের উদ্যোগ নিতে। এরপর আমি তখন ওখানে, অর্থাৎ ভারতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। সুলতান মাহমুদ ওখানে ছিলেন না। আমার পর সুলতান মাহমুদই ছিলেন জ্যেষ্ঠ। একটা যুদ্ধে ওঁর পায়ে গুলি লেগেছিল। সুলতান মাহমুদ ছাড়া বাকি সবাইকে নিয়ে গেলাম ডিমাপুরে।

কলকাতায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের আগেই সেখানে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর নিয়ে গেলাম ফ্লাইট লে. শামসুল আলমকে। পরে চট্টগ্রাম সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে সুলতান মাহমুদকে তুলে নিয়ে ডিমাপুরে গেলাম। ওখানে যেদিন বিমানবাহিনীর কার্যক্রম শুরু হয়, সেদিন ছিল ২৮ সেপ্টেম্বর। সেই হিসেবে এ দিনটিকে আমরা স্বাধীনতার পর থেকে বিমানবাহিনী দিবস হিসেবে পালন করে থাকি।

এ কে খন্দকার। সংগৃহীত ছবি
এ কে খন্দকার। সংগৃহীত ছবি

যা-ই হোক, সেখানে আমি তিনটি আলাদা শাখা প্রতিষ্ঠা করি। প্রত্যেকের নেতৃত্ব ও কাজ আলাদা করে দিই। নির্দেশ দিই কেউ কারও কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। তাদের সঠিকভাবে বিন্যাস করে আমি ফিরে আসি। তার পরও আমি মাঝেমধ্যে ডিমাপুরে যেতাম। আমি সম্ভবত তিন-চারবার ডিমাপুরে গিয়েছি। যাওয়ার পরপরই তাদের সঙ্গে জরুরিভাবে মিলিত হতাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। আমাদের তৎপরতা চালাতে হবে রাতের বেলা। তা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। দ্বিতীয় হচ্ছে, রাতের বেলায়ও আমাদের উড্ডয়ন করতে হবে অত্যন্ত নিচু দিয়ে, যাতে রাডার যন্ত্রে আমরা ধরা না পড়ি। ডিমাপুরে যে পরিত্যক্ত বিমানক্ষেত্র ছিল, তার চারপাশে তখন ছিল গভীর জঙ্গল। ওখানকার বড় গাছগুলো ২৫ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত উঁচু ছিল। ওখানে এত ঘন গাছ যে ওপর থেকে পড়লে গাছেই আটকে থাকতে হবে, মাটিতে পড়বে না।

তখন আরেকটি সমস্যা হয়। সেটা হলো আমরা লক্ষ্যবস্তু কোথায় করি। মুক্তিযুদ্ধের বছরটা ছিল বৃষ্টির বছর। আকাশ মেঘে ঢাকা। অন্ধকার রাত। আমরা ঠিক করলাম যে পাহাড়ের চূড়ায় একটা সাদা প্যারাসুট ফেলে দেব। এটাই হবে আমাদের লক্ষ্যবস্তু। চারদিকে অন্ধকারের মধ্যে এটাকে দেখা যাবে। ওই সাদা প্যারাসুট লক্ষ্য করে তারা অ্যাটাক ড্রাইভ দিত। আমি আমার অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে একটা কথা বলতে পারি যে আমি নিজেও এত ঝুঁকিপূর্ণ ডিগবাজি কম করেছি। আকাশের মেঘ আর গাছের মধ্যে ব্যবধান এত অল্প যে অত্যন্ত সাবধানে ডিগবাজি দিতে হতো। কারণ মেঘের মধ্যে চলে গেলে বিমান অবতরণ করার জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর কোনো কারণে একটু নিচে চলে এলে গাছে আঘাত লাগবে। এই অন্ধকারের মধ্যে ডিগবাজি দিয়ে ফিরে আসা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল।

এখানে আরও একটি কথা বলে রাখি, যখন ৩ ডিসেম্বর রাতে এঁরা আক্রমণ চালালেন, একজন অভিজ্ঞ পাইলট হিসেবে বলতে পারি-অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থার ভেতর দিয়ে অত দূর থেকে এসে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ও ঢাকার উপকণ্ঠে গোদনাইলের তেল ডিপো আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেওয়া বিশাল একটা সফলতা। আমি এর জন্য, এই সফলতার জন্য তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করি। এসব পাইলট সারা রাত ধরে এই সব আক্রমণ পরিচালনা করতেন। কারণ আমাদের ট্রেনিং হতো রাতের বেলায়। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গড়ে ওঠে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে। তাদের মধ্যে একটি নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

(লেখাটি ২০০৯ সালে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের পুর্বাপর কথোপকথন: এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান, এস আর মীর্জা’ বই থেকে নেওয়া)

Ad 300x250

সম্পর্কিত