leadT1ad

গণতন্ত্রের প্রসঙ্গ এলেই ভেসে উঠবে খালেদা জিয়ার নাম

প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ৪৫
স্ট্রিম গ্রাফিক

গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হলো সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি, স্বাধীন গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এ দেশে বিএনপির মাধ্যমে ‘সমন্বয়ের রাজনীতির’ নতুন ধারা চালু করেছিলেন। আর তা সম্প্রসারিত হয়েছে খালেদা জিয়ার মাধ্যমে। মূলত বেগম খালেদা জিয়ার বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই বিএনপি ভীষণ জনপ্রিয় দলে পরিণত হয়।

খালেদা জিয়ার শাসনকালেই বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ‘ইমার্জিং টাইগার’ খেতাবে ভূষিত হয়। তিনি ছিলেন একাধারে স্বৈরশাসকদের আতঙ্ক, বিএনপির জন্য একটি প্রতিষ্ঠান, এমনকি ‘দানব’ হাসিনার বিরুদ্ধে আমরণ লড়াকু গণতন্ত্রী যোদ্ধা।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি শেখ মুজিব হঠাৎ ঘোষণা দিলেন ‘বাকশাল’ ছাড়া দেশে আর কোনো দলের রাজনীতি থাকবে না। শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন ভোটারদের ভোট ছাড়াই ‘স্বনির্বাচিত’ আজীবনের রাষ্ট্রপতি। তিনি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তিন বাহিনী, বর্ডার গার্ড বাহিনী, আনসার ও ভিডিপির সকল সদস্য, বিচারপতি থেকে জজ এবং সকল অ্যাডমিন ক্যাডারকে ‘জাতীয় দল’ বাকশালের সদস্য হওয়ার জন্য ৩০ দিনের সময় বেঁধে দেন। কে কার আগে জাতীয় দলের সদস্য হবে, তা নিয়ে শুরু হয় তুমুল প্রতিযোগিতা। প্রায় ১ বছর ১০ মাস দেশে বাকশাল ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল না।

এর মধ্যে যদিও তিনটি অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান হয়েছে, কিন্তু কেউই বাকশাল দলটি বিলুপ্ত করেনি। দীর্ঘ ২২ মাস পর দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে স্ব-স্ব দলের অধীন রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। মজার বিষয় হলো, তখন কেউই বাকশালকে জীবিত না করে বরং আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করে।

খালেদা জিয়া ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন দেখে মরতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তা দেখেছেন। শেষ দিকে এক বছর পরিবারের সঙ্গে ভালো সময় কাটিয়েছেন; শেষ নিশ্বাসের সময়ও তাঁর ছেলে ও পরিবার উপস্থিত ছিল। এমন সৌভাগ্য সবার হয় না।

সব দলের জন্য রাজনীতি করার বন্ধ দরজা খুলে দিয়ে জিয়াউর রহমান পরিচিত হন ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক’ হিসেবে। তাই তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) হয়ে ওঠে গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক। ১৯৮১ সালের ৩০ মে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সেনাঅভ্যুত্থানে শহীদ হন।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর ৯ মাস পর (১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি) গণতন্ত্রের সেই মশাল হাতে তুলে নেন খালেদা জিয়া, প্রবেশ করেন বিএনপির রাজনীতিতে। এর কিছু দিন পর অর্থাৎ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ গণতন্ত্র হরণ করে দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘নো ইলেকশন আন্ডার এরশাদ’।

সামরিক শাসক এরশাদ তাঁর দীর্ঘ প্রায় ৯ বছরে পাঁচটি নির্বাচন ও গণভোট (ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, জাতীয় সংসদ নির্বাচন) দিয়েছিলেন, যেখানে শেখ হাসিনা, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশসহ এখনকার অনেক দল অংশ নিয়েছিল। কিন্তু বেগম জিয়া কোনো নির্বাচনে অংশ নেননি, আর তাই তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধি পান।

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়। খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে ১৪১টি সংসদীয় আসনে জয়লাভ করে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন এবং গণতন্ত্রকে সাংগঠনিক কাঠামোর ওপর দাঁড় করান। এরপর দুটি নির্বাচন সংসদীয় কায়দায় হয় এবং শত ব্যর্থতা সত্ত্বেও দেশে একধরনের রাজনৈতিক সুবাতাস বইছিল। কিন্তু সেই সুস্থ ধারার রাজনীতির ব্যাঘাত ঘটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান কে হবে—এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে। ফলে ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দীন জুটির কম্বো সরকার আসে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি। এককথায় দেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। দেশ চলে যায় প্রথমদিকে বিরাজনীতিকরণের দিকে। তারপর ঢুকে যায় একটানা সাড়ে ১৫ বছরের জন্য গণতন্ত্রহীন এক ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ যুগে।

উভয় যুগের কারিগরদের একমাত্র নিশানা ছিল খালেদা জিয়াকে দেশছাড়া করা এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী শক্তির কবর রচিত করা। কারাবাস, এক কাপড়ে ঘর থেকে বের করে দেওয়া, গৃহবন্দী করা, এতিমের টাকা মেরে খাওয়ার অপবাদ দেওয়া, বিনা চিকিৎসায় ‘স্লো পয়জনিং’ করে মেরে ফেলা, পদ্মা সেতুর ওপর থেকে টুস করে ফেলে দেওয়ার মতো তাচ্ছিল্য—কোনো নির্যাতন ও অপমান খালেদা জিয়াকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।

খালেদা জিয়া ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন দেখে মরতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তা দেখেছেন। শেষ দিকে এক বছর পরিবারের সঙ্গে ভালো সময় কাটিয়েছেন; শেষ নিশ্বাসের সময়ও তাঁর ছেলে ও পরিবার উপস্থিত ছিল। এমন সৌভাগ্য সবার হয় না।

হাসিনা তারেক রহমানকে বিদেশেই নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল। শোনা যায়, বিদেশের মাটিতে তারেক রহমানকে হত্যার চক্রান্তও চলেছে। খালেদা জিয়া তাঁর সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে ছেলেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন; কিন্তু নিজে থেকেছেন জেলের ভেতর। তাঁর লক্ষ্য সফল হয়েছে। যতদিন দেশে গণতন্ত্র থাকবে, ততদিন মানুষ তাঁকে স্মরণ করবে। আপসহীন, আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন, শক্তিশালী ও মানবতার অংশীজন হিসেবে ইতিহাস তাঁকে বসাবে অক্ষয় আসনে। খালেদা জিয়া বেঁচে থাকবেন কোটি কোটি মানুষের মনে।

লেখক: অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

Ad 300x250

সম্পর্কিত