leadT1ad

৬২ বছরে বিটিভি: জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে কতটা সফল

দেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে স্মরণীয় দিন ২৫ ডিসেম্বর। ৬২ বছরে পা দিলো রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। দীর্ঘ ছয় দশকের পথচলায় এটি শুধু সম্প্রচার মাধ্যম থাকেনি। হয়ে উঠেছে বাংলাদেশিদের শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে প্রশ্ন রয়েই গেছে, বিটিভি কতটা পূরণ করতে পেরেছে জনগণের আকাঙ্ক্ষা?

মুজাহিদুল ইসলাম
মুজাহিদুল ইসলাম
ঢাকা

শুভ জন্মদিন বিটিভি। স্ট্রিম গ্রাফিক

প্রতিষ্ঠার পটভূমি ও সূচনালগ্ন

১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৎকালীন ডিআইটি (বর্তমানে রাজউক) ভবনের নিচতলার ছোট্ট কক্ষে সম্প্রচার শুরু হয় পাকিস্তান টেলিভিশন (পিটিভি) নামে। সূচনায় প্রযুক্তি ছিল সীমাবদ্ধ, সম্পদও নগণ্য। কিন্তু উদ্যম আকাশচুম্বী। ডিআইটি ভবনের স্টুডিও থেকে সাদা-কালো পর্দায় প্রথম যে ছবি ভেসে ওঠে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের কাছে তা ছিল অপার বিস্ময়ের। প্রথম দিকে সম্প্রচার এলাকা ছিল ঢাকা ও আশেপাশের কিছু অঞ্চল। পরে ধীরে ধীরে বাড়ে পরিধি।

টানা ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মানচিত্রে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। এরপর ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিটিভির পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্র রামপুরায় স্থানান্তরিত হয়, যা আজও প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ইতিহাসের অনবদ্য সাক্ষী

বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে বিটিভির নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে সত্তরের নির্বাচন এবং ১৯৭১-এর উত্তাল দিনগুলোতে বিটিভি (তৎকালীন পিটিভি ঢাকা কেন্দ্র) এ দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেছিল। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিটিভির শিল্পী ও কলাকুশলীরা দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করেন। তারা পাকিস্তানের সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশাত্মবোধক গানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’ নামে নতুন জীবন লাভ করে। তৎকালীন সরকার বিটিভিকে গণমানুষের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রামপুরায় আধুনিক টেলিভিশন কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। সেই সময়ে নবজন্ম লাভ করা বিটিভি এখন পৌঁছে গেছে গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বে।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও স্বর্ণালী যুগ

বিটিভির ৬১ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় এর নাটক ও সঙ্গীতানুষ্ঠান। আশি ও নব্বইয়ের দশকে বিটিভির নাটক দেখার জন্য রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে যেত—এমন দৃশ্য এখনকার প্রজন্মের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। হুমায়ূন আহমেদ, সেলিম আল দীন, আবদুল্লাহ আল মামুন ও মমতাজউদ্দীন আহমদের মতো কালজয়ী নাট্যকারদের সৃষ্টি বিটিভির মাধ্যমেই সাধারণ মানুষের ড্রয়িংরুমে পৌঁছেছিল।

‘কোথাও কেউ নেই’, ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘এইসব দিনরাত্রি’ বা ‘বহুব্রীহি’র মতো নাটকগুলো কেবল বিনোদন দেয়নি বরং সামাজিক মূল্যবোধ গঠনে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। ‘বাকের ভাই’ চরিত্রটির ফাঁসি না দেওয়ার জন্য রাজপথে মিছিল ছিল বিটিভির আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার অকাট্য প্রমাণ। এছাড়া ‘নতুন কুঁড়ি’র মতো মেধা অন্বেষণমূলক অনুষ্ঠান দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে কয়েক প্রজন্ম ধরে শিল্পী সরবরাহ করে আসছে।

শিক্ষা, কৃষি ও জনসচেতনতায় অনন্য

বিটিভি কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি ছিল একটি বিশাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যখন দেশে স্বাক্ষরতার হার কম ছিল, তখন বিটিভির ‘এসো পড়তে শিখি’র মতো অনুষ্ঠান মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছে। স্বাস্থ্য সচেতনতা, পরিবার পরিকল্পনা এবং টিকাদান কর্মসূচির প্রসারে বিটিভির বিজ্ঞাপন ও প্রামাণ্যচিত্রগুলো সাফল্য এনে দিয়েছে।

বাংলাদেশের কৃষি বিপ্লবে বিটিভির ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের অবদান অনস্বীকার্য। শাইখ সিরাজের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানটি কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করেছে, যার ফলে বাংলাদেশ আজ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। গ্রামীণ জনপদ থেকে শুরু করে শহরের শিক্ষিত সমাজকে কৃষিমুখী করার এই কৃতিত্ব বিটিভির প্রাপ্য।

তথ্য ও সংবাদের নির্ভরযোগ্যতা

দীর্ঘদিন ধরে বিটিভি ছিল এ দেশের মানুষের তথ্যের একমাত্র উৎস। যদিও বেসরকারি চ্যানেলের ভিড়ে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবুও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখনো বিটিভির খবরের ওপর সবচেয়ে বেশি আস্থা রাখে। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা বা মহামারির সময় বিটিভির মাঠপর্যায়ের সংবাদ ও সতর্কতা বার্তা কোটি মানুষের প্রাণ ও সম্পদ রক্ষায় ঢাল হিসেবে কাজ করেছে।

উপগ্রহ যুগের চ্যালেঞ্জ ও আধুনিকায়ন

১৯৮০ সালে রঙিন সম্প্রচার শুরু করার মাধ্যমে বিটিভি আধুনিক যুগে প্রবেশ করে। ২০০৪ সালে ‘বিটিভি ওয়ার্ল্ড’ চালুর মাধ্যমে বিটিভি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যুক্ত হয়। বর্তমানে বিটিভি ঢাকা কেন্দ্রের পাশাপাশি বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্র পূর্ণাঙ্গভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশন জাতীয় সংসদের কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইউটিউবে বিটিভির উপস্থিতি এখন সরব। আধুনিক স্টুডিও, উন্নত গ্রাফিক্স এবং বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা চলছে।

প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা

অনেকের প্রশ্ন, অসংখ্য বেসরকারি চ্যানেলের ভিড়ে বিটিভির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? কিন্তু বিটিভি কেবল একটি চ্যানেল নয়, এটি রাষ্ট্রের কণ্ঠস্বর। বাণিজ্যিক ধারার চ্যানেল যখন রেটিং বা টিআরপির পেছনে ছোটে, বিটিভি তখন কৃষ্টি, লোকজ সংস্কৃতি ও উন্নয়নমূলক সংবাদকে অগ্রাধিকার দেয়। প্রান্তিক মানুষের সুখ-দুঃখের কথা এবং জাতীয় সংহতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। বিটিভি বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার সবচেয়ে শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হলো এই প্রতিষ্ঠান।

সাফল্য ও আগামীর সম্ভাবনা

৬১ বছরের পথচলায় বিটিভির অর্জন বিশাল। তবে এই দীর্ঘ যাত্রায় কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল। অত্যাধিক সরকারি নিয়ন্ত্রণ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সৃজনশীলতার অভাব মাঝেমধ্যে এর গতি মন্থর করেছে। তবে বিটিভি এখন তার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের রপ্ত। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের শক্তি, নতুন প্রজন্মের চাহিদা বুঝা, আধুনিক মানসম্পন্ন স্ক্রিপ্ট নির্বাচন এবং উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বিটিভিকে নতুনভাবে প্রাণবন্ত করে তুলছে।

যদিও গত বছরের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় কর্তৃপক্ষের বিতর্কিত ভূমিকায় জনরোষে পড়ে প্রতিষ্ঠান বিটিভি। বাংলাদেশ যাত্রার পর প্রথম তাকে মুখোমুখী হতে হয় হামলা-আগুনের।

৬২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিটিভির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ–ক্ষয় হওয়া গৌরব পুনঃরুদ্ধার ও তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া। একইসঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং ওভার-দ্য-টপ (ওটিটি) প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে পাল্লা দেওয়াও অন্যতম চ্যালেঞ্জ। মানুষ এখন কেবল টেলিভিশনের সামনে বসে থাকতে চায় না, তারা নিজের পছন্দমতো সময়ে অনুষ্ঠান দেখতে চায়। বিটিভি যদি তার আর্কাইভকে আরও সমৃদ্ধ করে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে উন্মুক্ত করে দেয় এবং বিশ্বমানের কন্টেন্ট নির্মাণে বিনিয়োগ করে, তবে এটি কেবল বাংলাদেশে নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম সেরা গণমাধ্যমে পরিণত হতে পারে।

বিটিভি এদেশের মানুষের শৈশব, কৈশোর আর প্রৌঢ়ত্বের চিরসাথী। সাদা-কালো টেলিভিশন সেটের সামনে পুরো পাড়া মিলে বসে নাটক দেখার সেই নির্মল আনন্দ আজও আপ্লুত করে। ৬১ বছরের দীর্ঘ যাত্রায় বিটিভি দেশের প্রতিটি বাঁকবদলের সাক্ষী। মানুষ প্রত্যাশা করে, বিটিভি তার ‘সবার জন্য সবখানে’ নীতিতে অটল থাকবে। আরও বেশি জনমুখী, আধুনিক ও সৃজনশীল হবে। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে পথপ্রদর্শক হবে। শুভ জন্মদিন বিটিভি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত