leadT1ad

২০২৫ সালে বাংলাদেশ: নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক খেলা এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বাসযোগ্যতার লড়াই

রাজিয়া সুলতনা ও মুহাম্মদ মাজেদুল হক
রাজিয়া সুলতনা ও মুহাম্মদ মাজেদুল হক

প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩: ৫৬
স্ট্রিম গ্রাফিক

রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রশ্নে জনগণের প্রবল আকাঙ্ক্ষাই ছিল গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ঘটনাবহুল সময়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ২০২৬ সালের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গতিপথ নিয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন প্রকট হয়ে উঠছে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে সংস্কার, নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি জোরদার করার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার কি কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছে? আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কি শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার মতো যথেষ্ট অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে?

২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ-আন্দোলনের পর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত গণভোটের জন্য বাংলাদেশ যখন প্রস্তুত হচ্ছে, তখন দেশটির রাজনৈতিক মঞ্চ আবারও জোট পরিবর্তন, কৌশলী চাল ও আদর্শিক অবস্থান পরিবর্তনের রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রথমবারের মতো ভোট দেবে বলে আশা করা হচ্ছে ও বিপুলসংখ্যক তরুণ ভোটারের অন্তর্ভুক্তির ফলে ঐতিহাসিক নির্বাচন হতে যাচ্ছে।

তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাটকীয় প্রস্থানের ১৬ মাস পরেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক রূপান্তর অসম্পূর্ণ ও সংস্কার কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে। নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে অর্থনীতি স্থিতিশীল করা, প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনআস্থা ফিরিয়ে আনা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রস্তুতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন শুরুতে ব্যাপক অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সমর্থন পেলেও, ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, চ্যালেঞ্জের মাত্রা তাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি ছিল এবং এই ভিশন বাস্তবায়নে তারা ক্রমাগত পাহাড়সম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।

হাসিনা-পরবর্তী সময় সংস্কার ও নবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর পরিবর্তে যা উঠে এসেছে তা হলো সুবিধাবাদ, অস্থিরতা এবং দেশে ও বিদেশে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার ভঙ্গুর রাজনৈতিক দৃশ্যপট। প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পাশাপাশি ছোট ছোট কুশীলবরা অভ্যন্তরীণ সংস্কারের প্রতি কোনো প্রকৃত প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেনি।

সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রীভূত প্রবণতা, দুর্বল জবাবদিহিতা, অস্বচ্ছ অর্থায়ন এবং রাজনীতিতে শিকড় গেড়ে বসা পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতি—এই কাঠামোগত দুর্বলতাগুলোই বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করছে। এর ফলে এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে যেখানে দূরদর্শিতা বা যোগ্যতার চেয়ে আনুগত্য ও সান্নিধ্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দলগুলো এখন গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার বদলে পর্যবেক্ষকদের ভাষায় ‘রাজনৈতিক খেলায়’ লিপ্ত। ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান যে জঞ্জাল সরাতে চেয়েছিল, পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি এবং অভিজাতদের তাৎক্ষণিক স্বার্থসিদ্ধির অদূরদর্শী খেলা সেই জঞ্জালকেই আবার স্থায়ী করার উপক্রম করেছে।

অধিকন্তু, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের এই অভাব নাগরিকদের কার্যকরভাবে প্রতিনিধিত্ব করার সক্ষমতাকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং আরও অসন্তোষ ও অস্থিরতার ক্ষেত্র তৈরি করছে। তৃণমূল পর্যায়ের অনেক দলীয় সদস্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ার কারণে হতাশা প্রকাশ করছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় কেউ কেউ দলাদলির রাজনীতির দিকে ঝুঁকছেন, যা অভ্যন্তরীণ ফাটল আরও তীব্র করছে। উদাহরণস্বরূপ, ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনায় এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও, বিএনপি প্রজন্মগত বিভাজন ও নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধের সঙ্গে লড়াই করছে। এদিকে, জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের মতো ধর্ম ও পরিচয়ভিত্তিক দলগুলো তরুণ ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনপ্রিয়তা পেলেও অভ্যন্তরীণ ভাঙনের মুখে পড়ছে। সামগ্রিক চিত্র এমন ব্যবস্থাকে প্রকাশ করে, যা পরিবর্তন ও ধারাবাহিকতার মাঝখানে আটকে আছে।

ঐকমত্য, সংঘাত ও অসহিষ্ণুতার প্রত্যাবর্তন

২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলনের সময় সংলাপ ও সহনশীলতার ভিত্তিতে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে প্রতিশ্রুতি জোরালোভাবে উচ্চারিত হয়েছিল, তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। ড. ইউনূসের বারবার দলগুলোর মধ্যে সহযোগিতার জন্য আহ্বান জানালেও ঐকমত্য গড়ে তোলা ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। এমনকি নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা বা রাজনৈতিক সমাবেশের আচরণের মতো ছোটখাটো বিষয়ে সমঝোতাও পারস্পরিক অবিশ্বাসের ভারে ভেঙে পড়েছে। অসহিষ্ণুতাই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিরোধী ও শাসক উভয় পক্ষই তাদের প্রতিপক্ষকে বৈধ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে না দেখে অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে চিত্রিত করে। রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর ক্রমশ উসকানিমূলক হয়ে উঠছে ও সহিংসতা নিত্যনৈমিত্তিক ঝুঁকি হিসেবে রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে মতবিরোধ দ্রুতই প্রকাশ্য অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে রূপ নেয়; বিএনপি দাবি করে যে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার প্রতিশ্রুতিগুলো বেছে বেছে প্রয়োগ করছে, অন্যদিকে জামায়াত ও এনসিপি অভিযোগ করে যে বিএনপি আলোচনায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বারবার সংঘর্ষ এবং নির্বাচনী প্রচারণায় হামলা ও সহিংসতা প্রাক-নির্বাচনী পরিবেশের অস্থিরতার দিকেই ইঙ্গিত করে।

এই সহনশীলতার অভাব কার্যত রাজনৈতিক সহিংসতাকে দরকষাকষির হাতিয়ারে পরিণত করেছে। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও আসন্ন নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদির ওপর সাম্প্রতিক গুলিবর্ষণের ঘটনার পর যা আরও স্পষ্ট হয়েছে। দলগুলো শক্তি প্রদর্শন, প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানো ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রভাবিত করতে রাজপথের শক্তি ব্যবহার করে। এই ধরনের কৌশল রাজনৈতিক অভিজাত ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্কের ব্যবধান আরও বাড়িয়ে তুলেছে। সংঘাত-ক্লান্ত নাগরিকরা ক্রমেই সন্দিহান হয়ে পড়ছেন যে আসন্ন নির্বাচন কি প্রকৃত পরিবর্তন আনবে, নাকি কেবল অভিজাতদের পুনর্বিন্যাসের আরেকটি রাউন্ড হবে।

জোটের রাজনীতি ও কৌশলী চাল

জোট গঠন ২০২৫ সালের রাজনৈতিক খেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তবে এই মৈত্রী পরিবর্তনশীল ও সুবিধাবাদী। বর্তমানে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দল হিসেবে বিবেচিত বিএনপি এই পর্যায়ে বড় আকারের কোনো আনুষ্ঠানিক অংশীদারিত্ব গড়ার ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। জোটের প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে, তারা মধ্যপন্থী ও ইসলামপন্থী উভয় দলের সঙ্গে নিভৃত সংলাপে যুক্ত হয়েছে। যাতে নির্বাচনী সুবিধার সঙ্গে আদর্শিক সংহতি বজায় রাখতে পারে। একসময় রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা জামায়াতে ইসলামী কৌশলগত মধ্যপন্থা ও তৃণমূল সংগঠনের মাধ্যমে মূলধারার আলোচনায় ফিরে এসেছে। সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের জন্য তাদের আহ্বান ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

এদিকে, সদ্য গঠিত এনসিপি বা ছাত্রদের দল নিজেদের আধুনিক, দূরদর্শী ও বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের শক্তিশালী উপস্থিতি ও শহুরে তরুণদের কাছে তাদের আবেদন নজর কেড়েছে, কিন্তু তাদের সাংগঠনিক বিস্তৃতি এখনো সীমিত। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, এনসিপি হয়তো হাতেগোনা কয়েকটি আসনের বেশি জিততে পারবে না। তবে তারা গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলোতে ভোট ভাগ বা ক্ষমতার ভারসাম্য প্রভাবিত করে ‘স্পয়লার’ বা পণ্ডকারী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, আদর্শ প্রায়শই কৌশলের অধীন হয়ে পড়ে। জোটগুলো অভিন্ন নীতির ভিত্তিতে নয়, বরং বাস্তবসম্মত হিসাব-নিকাশের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠছে। নির্বাচনী এলাকার নিয়ন্ত্রণ, তহবিলের জোগান ও বাইরের সমর্থন এমন অনেক হিসাব-নিকাশই জোটগুলোর ভিত্তি। বলা যেতে পারে, আজকের বাংলাদেশে জোটের রাজনীতি একসঙ্গে দেশ শাসনের জন্য নয়; বরং একসঙ্গে টিকে থাকার লড়াই।

বাইরের প্রভাব ও আন্তর্জাতিক মাত্রা

২০২৫ সালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির মিথস্ক্রিয়া ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলো তীব্রভাবে সচেতন যে তাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি দেশে তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী বা দুর্বল করতে পারে। ফলে, বিদেশি সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা, এমনকি প্রবাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে লবিং জোরদার হয়েছে। বিএনপি পশ্চিমা অংশীদারদের গণতান্ত্রিক শাসন ও মানবাধিকারের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের বিষয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে এবং নিজেদের এমন একটি মধ্যপন্থী শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে, যারা প্রধান শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনে সক্ষম। এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের ওপর নির্ভরতা অব্যাহত রেখেছে, যদিও কৃচ্ছ্রসাধন নীতি দরিদ্র মানুষের মধ্যে অসন্তোষ উসকে দিয়েছে।

ভারতের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতির জন্য ঢাকার গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে, এই পর্যায়ে নয়াদিল্লি সতর্ক ও কৌশলী অবস্থান নিচ্ছে, যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে নয়াদিল্লি উন্মুক্ত যোগাযোগ বজায় রাখছে, কিন্তু বিএনপির সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি তারা সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে, কারণ ঐতিহাসিকভাবে দলটির সঙ্গে ইসলামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী উপাদানগুলোর সখ্য রয়েছে। আন্তসীমান্ত অভিবাসন ইস্যুতে মাঝেমধ্যেই দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে ও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে আচরণের বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার বয়ানগুলো ইঙ্গিত দেয়, দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সতর্ক কূটনৈতিক যোগাযোগ প্রয়োজন। অতি সম্প্রতি ২০২৫ সালের নভেম্বরে ভারতের নির্বাসনে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আদালতের রায় ঘোষণার পর রাজনৈতিক দৃশ্যপট আবারও বদলে গেছে।

এখন প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো, হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়ে নয়াদিল্লি কী সিদ্ধান্ত নেবে? রাজনৈতিক উচ্চতা এবং বাংলাদেশ ও ভারত—উভয় দেশের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক গভীর সম্পর্কের কারণে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের ইস্যুকে অনুপ চেটিয়ার ঘটনার সঙ্গে তুলনা করা যাচ্ছে না। রায়ের বিষয়ে ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান ও বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ করার ঘোষিত অভিপ্রায় ইঙ্গিত দেয়, এই ইস্যুতে নয়াদিল্লি সতর্ক পদক্ষেপ নেবে। তবে, হাসিনার জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় ভারত তাঁকে ফেরত পাঠানো থেকে বিরত থাকার সম্ভাবনাও রয়েছে। এমনকি নয়া দিল্লি যদি তাঁকে ঢাকায় ফেরত পাঠাতে রাজিও হয়, তবুও আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক সদস্য ও ভোটারের সমর্থনের কথা বিবেচনা করে প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া সামলানো বাংলাদেশ সরকারের জন্য কঠিন হবে।

বিপরীতে, চীন বাংলাদেশে তাদের ‘নীরব কূটনীতি’ বা কুইয়েট ডিপ্লোমেসি সম্প্রসারিত করেছে। তারা অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে, যার মাধ্যমে বেইজিং এই বার্তা দিচ্ছে, ক্ষমতায় যে দলই আসুক না কেন, তারা দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত অংশীদার হতে চায়। পাকিস্তানও সতর্কভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠন করেছে এবং ২০২৪ সালের আন্দোলনের সময় তাদের সমর্থনসূচক অবস্থানের কারণে সৃষ্ট সদিচ্ছাকে কাজে লাগাচ্ছে। বাইরের সম্পর্কের এই জাল স্পষ্ট করে দেয়, দেশের ক্রান্তিকালীন রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ বৈধতা ও পররাষ্ট্রনীতি কীভাবে ক্রমশ একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি বড় দল দেশে ভোটের জন্য প্রচার চালাচ্ছে, আবার একই সঙ্গে বিদেশেও স্বীকৃতি চাইছে—এই দ্বৈত প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথকে আরও জটিল করে তুলছে।

ছাত্র রাজনীতির পুনর্বিন্যাস

২০২৫ সালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির রূপান্তর। একসময় যাকে দলীয় লেজুড়বৃত্তির দুর্নীতিগ্রস্ত রূপ হিসেবে বাতিল করে দেওয়া হতো, সেই যুব মোবিলাইজেশন বা তরুণদের সংগঠিত করার বিষয় এখন নির্বাচনী গতিপ্রকৃতির এক শক্তিশালী চালিকাশক্তি হিসেবে পুনরায় আবির্ভূত হচ্ছে। গ্রামীণ বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো তরুণ ভোটারদের সম্পৃক্ত করতে প্রচুর বিনিয়োগ করছে ও তৃণমূল সংগঠনের প্রধান বাহন হিসেবে ছাত্র সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করছে।

বিএনপির অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এ ক্ষেত্রে বিশেষত সক্রিয়। ঢাকার কেন্দ্রীয় নেতারা গ্রামীণ ভিত্তি শক্ত করতে স্থানীয় যুবনেতাদের তৈরি করেছেন, যার ফলে গ্রামের সক্রিয়তা কার্যকরভাবে জাতীয় কৌশলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তাদের অবিচার-বিরোধী বয়ান তরুণ ভোটারদের মধ্যে, বিশেষ করে যেসব জেলায় বেকারত্ব ও হতাশা বেশি, সেখানে জোরালোভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তবে, এই মোবিলাইজেশন বা সংগঠিতকরণ দ্বিমুখী তলোয়ারের মতো। এটি যেমন যুব অংশগ্রহণকে উজ্জীবিত করে, তেমনি রাজপথে সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়ায়। প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপগুলো, বিশেষ করে জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে যুক্তরা, ক্যাম্পাস ও এলাকাগুলোতে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা করছে, যা মাঝেমধ্যে সহিংস সংঘর্ষে রূপ নিচ্ছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র সহিংসতা বৃদ্ধির আশঙ্কা নিরাপত্তা সংস্থা ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২৬-এর পথে: সম্ভাবনা ও শঙ্কা

যদিও ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে, তবুও রাজনৈতিক দৃশ্যপট অনিশ্চিতই রয়ে গেছে। পূর্ববর্তী সরকারের ওপর জনগণের ক্ষোভ ও অর্থনৈতিক কষ্টের কারণে সৃষ্ট অসন্তোষের সুযোগে বিএনপি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ২০৩৪ সালের মধ্যে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি গড়া ও এককোটি কর্মসংস্থান তৈরির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভোটারদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে। তবে সমালোচকরা সতর্ক করছেন, অর্থবহ সংস্কার ছাড়া এই প্রতিশ্রুতিগুলো অবাস্তব প্রমাণিত হতে পারে।

বিএনপির জন্য আসল পরীক্ষা হবে তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী ‘পোষণ ও মক্কেলতন্ত্রী’ রাজনৈতিক সংস্কৃতি ত্যাগ করে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসনের প্রতি নতুন করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারে কি না। ২০২৪-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবেশ এমন এক ভোটারগোষ্ঠী তৈরি করেছে, যারা এখন অনেক বেশি সন্দেহপ্রবণ ও ভুল ক্ষমা করতে নারাজ। বিশ্বাসযোগ্য সংস্কার উপহার দিতে ব্যর্থ হলে নির্বাচনে জিতলেও দলটির বৈধতা দ্রুত ক্ষয়ে যেতে পারে।

এদিকে, জামায়াতে ইসলামী নিশব্দে নির্বাচনে বড় ধরনের সাফল্যের জন্য নিজেদের অবস্থান তৈরি করছে। তাদের বিস্তৃত যুব ভিত্তি, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও সামাজিক ইস্যুগুলোর ওপর ফোকাস ইঙ্গিত দেয়, তারা সংসদে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারে। যদি বাস্তবে তা ঘটে, তবে নির্বাচনী রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ হওয়ার পর এটি হবে জামায়াতের সবচেয়ে বড় প্রত্যাবর্তন।

ছাত্রদের দল হিসেবে এনসিপির উত্থান, যদিও পরিসরে সীমিত, তবুও বিএনপি-আওয়ামী লীগ বাইনারি বা দ্বিমেরুর বাইরে রাজনৈতিক বিকল্পের প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহকেই নির্দেশ করে। এনসিপি শহুরে নির্বাচনী এলাকাগুলোতে সীমাবদ্ধ থাকলেও, তাদের উপস্থিতি হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রজন্মগত পরিবর্তনের সূচনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

সবশেষে, বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইঙ্গিত দেয়, ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে সরকারি দল হিসেবে সামগ্রিক অপরাধের দায়ভারের কারণে ২০২৬ সালের আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়ার সম্ভাবনা কম। এই সিদ্ধান্ত ও নয়া দিল্লি হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করবে কি না—এই দুটি বিষয়ই প্রাক ও নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার গতিপথ এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ধারণ করবে।

২০২৫ সাল শেষ হওয়ার পথে, বাংলাদেশ আবারও এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। আসন্ন নির্বাচন কেবল সরকার পরিবর্তন নয়, বরং দেশটি দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অসহিষ্ণুতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতার চক্র ভাঙতে পারবে কি না, তার পরীক্ষা। কৌশলগত জোট, অস্বচ্ছ অর্থায়ন ও বাইরের লবিং দ্বারা চালিত বর্তমান রাজনৈতিক খেলা জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা আরও গভীর করেছে।

কর্মসূচি-ভিত্তিক প্রতিযোগিতার বদলে যুব মোবিলাইজেশন এবং জোটের চালবাজির ওপর নির্ভরতা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে নীতি-চালিত শাসনের চেয়ে স্বার্থ-চালিত রাজনীতিই এখনো টিকে আছে। তবুও এই অস্থিরতার মধ্যে আশার আলো এখনো টিমটিম করে জ্বলছে। তরুণ ভোটারদের সক্রিয়তা, স্বচ্ছতার আহ্বান ও জবাবদিহিতার ক্রমবর্ধমান দাবি ইঙ্গিত দেয় যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা এখনো নিভে যায়নি। দেশের নেতারা এই প্রত্যাশা পূরণে এগিয়ে আসবেন, নাকি আবারও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারকে ছাপিয়ে স্বল্পমেয়াদী স্বার্থকে প্রাধান্য দেবেন—তা কেবল ২০২৬ সালের নির্বাচনের ফলাফলই নির্ধারণ করবে না, বরং আগামী কয়েক দশকের জন্য বাংলাদেশের গণতন্ত্রের গতিপথ ও স্থায়ী সম্প্রীতির অন্বেষণও ঠিক করে দেবে।

লেখক:

  • রাজিয়া সুলতানা, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ(বিআইআইএসএস)।
  • মুহাম্মদ মাজেদুল হক, রিসার্চ অফিসার, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ(বিআইআইএসএস)।
  • সাউথ এশিয়ান ভয়েসে প্রকাশিত। অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ
Ad 300x250

সম্পর্কিত