leadT1ad

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বামীর পাশে সমাহিত খালেদা জিয়া

মা খালেদা জিয়াকে দাফনের পর শ্রদ্ধা জানান তারেক রহমান। ছবি বিএনপির মিডিয়া সেল

স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন খালেদা জিয়া। বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) বিকেলে শেরেবাংলা নগরের জিয়া উদ্যানে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয়।

খালেদা জিয়ার কবরে সবার আগে নামেন বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। নিজ হাতে মায়ের মরদেহ কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত করেন তিনি। এরপর পরিবারের সদস্য, অন্যান্য স্বজন, সরকারের উপদেষ্টা, কর্মকর্তা থেকে বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী কবরে মাটি দেন।

খালেদা জিয়ার দাফনের পর সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে তাঁকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। তারেক রহমান ছাড়াও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও তিন বাহিনীর প্রধানরা কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

খালেদা জিয়ার জানাজাস্থল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে ১৯৮১ সালের ২ জুন তাঁর স্বামী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জানাজা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত সেই জানাজার উপস্থিতি ইতিহাস হয়ে রয়েছে। পরে জিয়াউর রহমানকে সমাহিত করা হয় চন্দ্রিমা উদ্যানে, যার বর্তমান নাম জিয়া উদ্যান।

১৯৬০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয় খালেদা জিয়ার। বুধবার খালেদা জিয়ার জানাজার উপস্থিতি নতুন ইতিহাস গড়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে।

খালেদা জিয়ার দাফন প্রক্রিয়ার পর তারেক রহমানের স্ত্রী জুবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমান, ছোট ভাই আরাফাত রহমানের স্ত্রী শামিলা রহমান, তাঁর ছোট মেয়ে জাফিরা রহমানসহ পরিবারের সদস্য, বিএনপির নেতাকর্মী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা দাঁড়িয়ে শোক ও শ্রদ্ধা জানান।

এর আগে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামাজে জানাজা হয়। জানাজার নামাজ পড়ান বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব আবদুল মালেক। জানাজা শেষে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকে লাল-সবুজ পতাকায় মোড়া লাশবাহী গাড়িতে করে খালেদা জিয়ার মরদেহ জিয়া উদ্যানে নেওয়া হয়।

খালেদা জিয়ার জানাজার নামাজে উপস্থিতির একাংশ। ছবি বিএনপির মিডিয়া সেল
খালেদা জিয়ার জানাজার নামাজে উপস্থিতির একাংশ। ছবি বিএনপির মিডিয়া সেল

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধির কাছাকাছি পৌঁছে খালেদা জিয়ার মরদেহবাহী কফিন কাঁধে নিয়ে যান সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরা। তারেক রহমানও এ সময় খাটিয়া কাঁধে নেন। এরপর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে খালেদা জিয়াকে দাফন করা হয়।

খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ছেলে তারেক রহমান, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ বিশিষ্টজন। ছবি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং
খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ছেলে তারেক রহমান, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ বিশিষ্টজন। ছবি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

জনসমুদ্রে পরিণত হওয়া রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে নামাজে জানাজার আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কাউকে আঘাত দিয়ে থাকলে তাঁর পক্ষে সবার কাছে ক্ষমা চান তারেক রহমান। একইসঙ্গে মাকে দেওয়া ঋণের জন্য যোগাযোগ করলে তা পরিশোধের কথা জানান তিনি।

তারেক রহমান বলেন, ‘আমি মরহুমা খালেদা জিয়ার বড় সন্তান তারেক রহমান। আমি আজ এখানে উপস্থিত ভাই এবং বোনেরা যারা উপস্থিত আছেন... মরহুমা খালেদা জিয়া জীবিত থাকাকালীন অবস্থায় যদি আপনাদের কারও কাছ থেকে কোনো ঋণ নিয়ে থাকেন, দয়া করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আমি সেটি পরিশোধের ব্যবস্থা করব, ইনশাআল্লাহ।’

তিনি আরও বলেন, ‘একইসঙ্গে উনি জীবিত থাকাকালীন অবস্থায় উনার কোনো ব্যবহারে, উনার কোনো কথায় যদি কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে মরহুমার পক্ষ থেকে আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী। দোয়া করবেন আল্লাহ তায়ালা যাতে উনাকে বেহেশত দান করেন। আসসালামু আলাইকুম।’

জানাজা শুরুর আগে খালেদা জিয়ার জীবনী পড়ে শোনান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তুলে ধরেন আপসহীন এই নেত্রীর রাজনৈতিক, পারিবারিক ও সংগ্রামী জীবনের কথা। শুরুতেই নজরুল ইসলাম বলেন, ‘খালেদা জিয়া খুব পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন। ফুলের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ অনুরাগ। এ কারণে তাঁর বিভিন্ন সমাবেশ থাকতো সুশোভিত।’

গতকাল মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) খালেদা জিয়া সব বন্ধন ছিন্ন করে পাড়ি জমান অনন্তকালের পথে। আপসহীন এই নেতার মৃত্যুর খবরে গোটা দেশে শোক নেমে আসে। প্রায় ৮০ বছর বয়সী তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন হৃদরোগ ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস, কিডনির জটিলতাসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। গত ২৩ নভেম্বর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন।

খালেদা জিয়ার জানাজার নামাজ পড়ান বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব আবদুল মালেক। ছবি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং
খালেদা জিয়ার জানাজার নামাজ পড়ান বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব আবদুল মালেক। ছবি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুঁড়ির নয়াবস্তি এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন খালেদা জিয়া। বাবা ইস্কান্দার মজুমদারের বাড়ি ফেনীর ফুলগাজীতে হলেও তিনি জলপাইগুঁড়িতে বোনের বাসা থেকে পড়ালেখা করেন। বাবা ইস্কান্দর মজুমদার ও মা বেগম তৈয়বা মজুমদারের সন্তানদের মধ্যে তৃতীয় খালেদা জিয়া। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের পরিবারে বেড়ে ওঠা পুতুলই পরে দেশের রাজনীতির অন্যতম দৃঢ়চেতা নেত্রী হিসেবে পরিচিত হন।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর খালেদা জিয়ার পরিবার বাংলাদেশের দিনাজপুর শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। সেখানে মিশনারি স্কুলে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরানোর পর দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন খালেদা জিয়া।

১৯৬০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বিয়ে হয়। পরে স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। স্বাধীনতার পর ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি গঠন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

স্বামী জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবেই জীবনের বড় সময় কাটিয়েছেন খালেদা জিয়া। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শাহাদাত বরণের পরই রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন। এক বছরের মধ্যেই দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে খালেদা জিয়া কারাবন্দিও হন। নব্বইয়ের স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ‘আপসহীন নেত্রী’ হয়ে ওঠা খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের বড় সময় কেটেছে রাজপথের আন্দোলনে। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেল খেটেছেন; তবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি।

১৯৯১ সালে তাঁর নেতৃত্বে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে কখনো হারেননি খালেদা জিয়া। তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

২০০৮ সালের পর বিরোধীদলীয় নেতার ভূমিকা পালন করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় কারাবন্দি থাকা; এই সময়গুলোতে তিনি সক্রিয় রাজনীতির বাইরে থাকলেও দলের সিদ্ধান্তে প্রভাব রাখেন।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে কারাবন্দি ও পরবর্তী সময়ে শর্তসাপেক্ষ মুক্তির পর খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। দীর্ঘদিন এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। লিভার সিরোসিসসহ একাধিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। ২০২০ সালে সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষ মুক্তি পান।

এরপর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর খালেদা জিয়া পুরোপুরি মুক্তি পান। এরপর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে দণ্ড মওকুফ হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডন যান; সেখানে ছেলে তারেক রহমানের কাছে থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরেন।

Ad 300x250

সম্পর্কিত