সৌমিত্র থেকে তাহসান– বাংলার আর্বান মেয়েদের পছন্দের রোম্যান্টিক পুরুষের একটি ‘আদর্শ’ ও প্যাটার্ন দেখা যায়। এই ‘আদর্শ’ আকর্ষণীয় পুরুষের ধারণা গড়ে ওঠা ও প্রাসঙ্গিক রুচির অধিপতিশীল হয়ে ওঠা নিয়ে এই লেখা।
শতাব্দীকা ঊর্মি
রোমান্টিক পুরুষরে কোন নারীই বা না চায়! রোমান্টিক পুরুষের কথা ভাবতে গেলে মাথায় আসে কত সুন্দর সুন্দর ব্যাডা। মনে পড়ে অপুর সংসারের সৌমিত্রের আওলাবাওলা কবি কবি চেহারা । ‘আলো আলো তুমি কখনো আমার হবে না’ গাইতে গাইতে মনে পড়ে তাহসানের কিউটের ডিব্বা থেইকা মোস্ট হ্যান্ডসাম হয়ে ওঠা। এসবের মধ্যে তাহসান সাহেবের বিয়াও হইল, হইলো ডিভোর্সও। ইন্টারেস্টলিং, তাহসান আর মিথিলার ছাড়াছাড়ির গসিপে পার্টিসিপেট করে নাই এমন মানুষ খুব কমই ছিল। স্টারদের ব্যাপারে আমাদের তো অনেক পাগলামিই থাকে। আর সুদর্শন স্টার হইলে তো কথাই নাই। সে যাই হোক, এই ঘটনায় ব্যাটারা ব্যাপক দুঃখী আর ভিক্টিমাইজড মোডে চলে গেলেও নারীরা মৃদু খুশিই হইছে। এত হ্যান্ডসাম একটা ছেলে সিঙ্গেল দেখাই তো আরাম, নাকি? আমার এক বান্ধবীর মোবাইলের ওয়ালপেপারেও সেইভ করা ছিল তাহসানের ছবি। তার মনে হইছিলো অন্যায়টা তাহসানের সাথেই হইছে, এত সুন্দর আর কিউট একটা পোলা নিশ্চয়ই বউ এর ওপর অত্যাচার করতে পারে না!
আবার আমার মা-খালাদের স্বপ্নের নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্টাইলের মহিমা ছিল বাপ-খালুদের বেহুদা মেজাজের সমানুপাতিক। সৌমিত্রের হাঁটাচলা, কথা বলা, মিষ্টি হাসি, বউ এর পাশাপাশি বসা— এইগুলাই চিরকাল আকাঙ্ক্ষা করে আমাদের মায়েরা পাইতো না। অতিব্যস্ত অফিস ফেরত স্বামীর ধমকের পাশে এমন কল্পনাই তো বেশি ভালো লাগার কথা। আরবান জীবনে এমনেই থাকে না বন্ধু, তার ওপর স্বামীরা হয় না মনের মতো রোমান্টিক। সৌমিত্র বা তাহসান ছাড়া কারেইবা কল্পনা করা উত্তম? থাক। বরং একটা কামের কথা ভাবা যাক চলেন। কথা হইলো, আর্বান নারীদের রোমান্টিকতায় ড্রিমবয় হিসাবে সৌমিত্র-তাহসান আদর্শ (সুদর্শন, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, অ্যাস্থেটিক, গুডবয় ইমেজের তারকা) তৈরি হওয়ার মাজেজা কী? নারীদের রোমান্টিকতা আইডেন্টিফাই করলে কি সেইটা বোঝা যাবে?
নারীদের রোমান্টিকতার ধারণা একটা ঘোলা জিনিস। রোমান্টিকতা অস্তিত্বের স্বাধীন অনুভূতিগুলার একটা। স্বাধীন অনুভুতি বলতে বুঝাইতেছি, নিজেরে কাউন্ট করার প্রেক্ষিতে যেইসব অনুভূতি আপনি আপনার তরে প্রকাশ করতে পারেন। আর নারীরা একটা সত্ত্বা হিসাবে কাউন্ট হওয়ার লড়াই করতে করতে কেটে যাইতেছে অনেকগুলা যুগ। এসবের ভেতর থেইকা যে নারীর যে রোমান্টিকতা মন্থন করা হইলো, সেইটা কি আসলে নারীর নিজের হইয়া উঠতে পারলো কিনা সেইটা বিরাট প্রশ্ন।
মন্থনে যেটুকু পাওয়া গেল তা তো এক অরাজনৈতিক স্বাধীনতা। যা ব্যাটাদের রাজনীতিরই মোয়া। যেমন, উপনিবেশের আমলে ভিক্টোরিয়ান আদলে আরবান নারীকে প্যাকেট করা হইলো ‘ভদ্রতা’ দিয়া। পোশাকে বা আচরণে তাঁরে দেওয়া হলো ‘দ্য লেডি’ হইয়া ওঠার স্ট্যান্ডার্ড। ব্রিটিশদের পার্টিতে ঠাকুরবাড়ির নারীর ব্লাউজ ছাড়া ঢুকতে না পারার ঘটনা নিশ্চয়ই সুধী সমাজের মনে আছে। খেয়াল কইরা দেখবেন নারীদের সাজ-পোশাক সেই যে একটা মোড় নিল, আর যে স্ট্যান্ডার্ড স্ট্যাব্লিশড হইলো, রোমান্টিক নারীর চেহারাও কিন্তু তার ওপরেই দাঁড়ায় গেল। সো, সুতির শাড়ি, লম্বা চুল আর চোখে কাজল দেওয়া নারীদের আমরা পাইলাম রোমান্টিকতার মূর্তি হিসাবে। তারপর কী ঘটলো?
এরকম নারীরাই এলো সৌমিত্রদের নায়িকা হইয়া। অপুর সংসার, মহানগর , চারুলতা– নারীরা অ্যাস্থেটিক এবং প্রেমিক বা স্বামীর নানান ব্যর্থতার একমাত্র আশ্রয়। স্বামীর দারিদ্র্যের সাথে মানায় নেওয়া আর যত্নে রাখার সিনগুলার মধ্যে রোমান্টিকতা ইনপুট দেওয়া হইল। সৌমিত্রের মতো সুদর্শন আর ইন্টেলেকচুয়াল হইলেই যে তার সাথে মানায়ে নিয়া জীবন কাটানো যাবে, এমন সব কল্পনা নিয়া আমাদের নারীরা হইয়া উঠতে লাগলেন রোমান্টিক। শর্মিলাদের দেখানো হইলো বকলম ও বিপদগ্রস্ত। ফলত কিঞ্চিৎ বোহেমিয়ানিজমরে ফ্যান্টাসাইজ কইরাও রোমান্টিকতার এরোস হইয়া উঠলেন সৌমিত্ররা।
এবার আসি তাহসান আমলে। মিউচুয়াল ডিভোর্সের পরেও মিথিলা যেরকম অর্থনৈতিক (গাড়ির অভাব নিয়া প্রথম আলোর এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন মিথিলা) ও সামাজিক গ্যাঞ্জামে পড়লেন, তার থেইকা গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠছিল মিথিলার আগের প্রেমিক কয়টা। সোশ্যাল মিডিয়ায় এখনো চলে মহাসমারোহে স্লাটশেমিং। তাহসানের ক্লিন ইমেজ আর মিথিলার একাধিক প্রেমিকের দাড়িপাল্লায় মিথিলার পাল্লা যে কতখানি ভারি তা তো শুরুতে আমার বান্ধবীর অবস্থা দেখে বুঝছেনই।
এক যুগ আগেই তাহসান সুমধুর কণ্ঠ আর ইনোসেন্ট সেইন্ট ভাইব মেয়েদের স্বপ্নের পুরুষ হইয়া উঠার নয়া ক্রাইটেরিয়া তৈরি করলো। তার ওপর ডিভোর্সের পরেও নিজের সন্তানের দেখাশোনা তাহসানকে বানায় দিলো পার্ফেক্ট ‘হাজবেন্ড ম্যাটেরিয়াল’ও। আরও আছে নেশাপাতি না করা, বাউন্ডুলে না হওয়া এক জেন্টেলম্যানসুলভ স্টারডম।
তাহসান-মিথিলার দোষগুণের বাইরে লক্ষ্য করেন নারীদের রোমান্টিক পুরুষ হবার ক্রাইটেরিয়াগুলা। যার মধ্যে বড় হইয়া উঠলো সুদর্শন চেহারা আর কেয়ারিং পার্সোনালিটি। এই সৌন্দর্য আর কেয়ারের তাহসানমূলক মানদণ্ড নারীদের নিকট তৈরি হইলো কেমনে?
নারীবাদী তাত্ত্বিক জুডিথ বাটলার তাঁর জেন্ডার ট্রাবল বইয়ে বলতেছেন, লিঙ্গ কোনো স্থির পরিচয় না। এইটা একটা পারফরমেটিভ আচরণ। কোনো একটা লিঙ্গের আচরণ ও অনুভূতি সময় ও স্থানের নিয়ম ও রাজনৈতিক ফিলোসফি দ্বারাই শেইপ হইতে থাকে। সৌমিত্র থেকে তাহসানের সময়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে তাকাইলে খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় নারী কতখানি ‘অপর’। আর নারীর রোমান্টিক ধারণায় তাহসান বা সৌমিত্র নায়ক হইতে হইলে তারে কতরকম কগনিটিভ বায়াসনেসের মধ্যে দিয়ে যাইতে হইছে। ফলে নারীর স্বাধীন অনুভূতি তৈরি হইতে এবং নিজের আদর্শ রোমান্টিক পুরুষের স্ট্যান্ডার্ড সেট হইতে যে সাবভারসিভ পারফরম্যান্স দরকার, তা তো আমাদের মেয়েরা পারলো না। মূলত পারতে দেওয়া হইলো না। কারণ ‘সিন্ডারেলা সিন্ড্রোম’-কে (নির্ভরশীল হওয়া ও উদ্ধারকর্তা বা প্রিন্স চার্মিং-এর আকাঙ্খা করা) আদর্শ ধরে মেয়েদের বড় করা হইলো। অন্যদিকে ‘কলচর’ কিং কলকাতার বাবু সমাজের অ্যাস্থেটিজম তো ঢাকাকে দখল করলোই।
এসব তো রইলোই। দুঃখজনক ব্যাপার হইলো সৌমিত্র-তাহসানপ্রেমীদের জীবনে কিন্তু প্রিন্স চার্মিং আসে ভিন্নভাবে। তাদের কাছে থাকে রূপ আর ইন্টেলেকচুয়ালিটির সেই জুতা। যে জুতা কেউ আইসা পরায় দিবে। যে কারণে নারীদের আশৈশব সেইটা নিজে খুঁজে পায়ে দিতে দেওয়া হবে না। বোঝানো হইতো ‘বিয়ের পরে যাইও/কইরো’। অর্থাৎ নির্ভরতার পাশাপাশি সুন্দর ছেলের ইন্টেলেকচুয়ালিটি এক আহামরি টাইপ দেবার্ঘ্য হইয়া উঠল।
আমরা দেখি যে, ‘সাধারণ’ ব্যাপার হইলো ডিসিশন মেকিং কিংবা ইন্টেলেকচুয়াল পার্টিসিপেশন থেকে নারীরে বেশ আয়োজন কইরা দূরে রাখা হইতো। এমনকি নারীর মনের ভেতর কি চলে তাও কওয়া লাগল প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথদের বয়ানে। সো, সৌমিত্রের সুন্দর কইরা কথা বলা আর কবি কবি ভাব, অথবা তাহসানের ইনোসেন্ট সেইন্ট ভাইব নারীদের মুগ্ধ করলো। নারীর পার্সোনাল জাজমেন্টের বয়ামও ভরে উঠল কালচারাল অপরায়ন দিয়া। তা ছাড়া তাহসানের যে ‘ভালো ছেলে’ হয়ে ওঠার সামাজিক ক্রাইটেরিয়া–সবগুলাতেই সে সুযোগ্য। এই সুপাত্র বা ভালো ছেলের ক্রাইটেরিয়া প্রতিষ্ঠা করতে যে সফট ব্যাটাতান্ত্রিক ম্যানিপুলেশন, তা গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় কী নারীর থাকে? ব্যক্তিসত্তার ত্রুটি নিয়ে আপত্তি করলেও তা তো টিকে না। কারণ আইবিএ গ্র্যাজুয়েট, আইএলটিএসে ভালো স্কোর, ভালো প্রফেশনাল স্কিল, ভালো গান গাওয়া, স্টারডম, কেয়ারিং পার্সোনালিটি এইসব কিছু যার থাকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললে বাড়াবাড়ি ওই মেয়েরই! ব্যাটাতান্ত্রিক কালচারাল প্র্যাক্টিসের এই বিপত্তিতে পইড়া সামাজিকভাবে এব্যান্ডানড না হয়ে তাহসানরে রোমান্টিকতার আদর্শ ধইরা নিলেই মেবি সেইফ থাকা গেল! ফলে কেবলি রইলো একটা ডিজঅউনড হওয়ার মতো ‘রোমান্টিকতা’র শোপিস। অন্যের হাতে তৈরি রোমান্টিকতার মোয়া তারে ধরায় দেওয়া হইলো। যাতে নারীর স্বাধীন অনুভূতির নবধারাজলে শেইপ হওয়া রোমান্টিক দেবতাদের ভাসান না হইতে পারে।
আবার ফিরি বাটলারের কাছে। লিঙ্গের পারফর্ম্যান্সমূলক স্বভাবকে স্বীকার কইরা বাটলার জেন্ডার ট্রাবল বইয়ে প্রস্তাব করছিলেন, আমরা সব নিয়মরেই বদলাইতে পারি আর বদল অনুযায়ী নর্মস ইনপুট দিতে পারি। লিঙ্গ-ভূমিকার যে সীমা এখন বহাল আছে, সেই সীমার ভেতর থেকে আমাদের নারীরা যে গুডবয়দের পাইলো, তারাই আমাদিগের প্রিন্স চার্মিং হইয়া থাকবে? নাকি লিঙ্গব্যবস্থার ভ্রম থেইকা যে রোমান্টিকতার উদগীরণ হইলো সেইটারে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে? সেইটার দিকে চক্ষু নিবন্ধিত রাখার জরুরত বোধ করলাম আর আমাদের পুকি তাহসান আর সৌমিত্রের রূপমহিমার প্রতি মোহাব্বত কা ইজহার নিয়াই আশার বাণী সকল শেষ করিলাম।
রোমান্টিক পুরুষরে কোন নারীই বা না চায়! রোমান্টিক পুরুষের কথা ভাবতে গেলে মাথায় আসে কত সুন্দর সুন্দর ব্যাডা। মনে পড়ে অপুর সংসারের সৌমিত্রের আওলাবাওলা কবি কবি চেহারা । ‘আলো আলো তুমি কখনো আমার হবে না’ গাইতে গাইতে মনে পড়ে তাহসানের কিউটের ডিব্বা থেইকা মোস্ট হ্যান্ডসাম হয়ে ওঠা। এসবের মধ্যে তাহসান সাহেবের বিয়াও হইল, হইলো ডিভোর্সও। ইন্টারেস্টলিং, তাহসান আর মিথিলার ছাড়াছাড়ির গসিপে পার্টিসিপেট করে নাই এমন মানুষ খুব কমই ছিল। স্টারদের ব্যাপারে আমাদের তো অনেক পাগলামিই থাকে। আর সুদর্শন স্টার হইলে তো কথাই নাই। সে যাই হোক, এই ঘটনায় ব্যাটারা ব্যাপক দুঃখী আর ভিক্টিমাইজড মোডে চলে গেলেও নারীরা মৃদু খুশিই হইছে। এত হ্যান্ডসাম একটা ছেলে সিঙ্গেল দেখাই তো আরাম, নাকি? আমার এক বান্ধবীর মোবাইলের ওয়ালপেপারেও সেইভ করা ছিল তাহসানের ছবি। তার মনে হইছিলো অন্যায়টা তাহসানের সাথেই হইছে, এত সুন্দর আর কিউট একটা পোলা নিশ্চয়ই বউ এর ওপর অত্যাচার করতে পারে না!
আবার আমার মা-খালাদের স্বপ্নের নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্টাইলের মহিমা ছিল বাপ-খালুদের বেহুদা মেজাজের সমানুপাতিক। সৌমিত্রের হাঁটাচলা, কথা বলা, মিষ্টি হাসি, বউ এর পাশাপাশি বসা— এইগুলাই চিরকাল আকাঙ্ক্ষা করে আমাদের মায়েরা পাইতো না। অতিব্যস্ত অফিস ফেরত স্বামীর ধমকের পাশে এমন কল্পনাই তো বেশি ভালো লাগার কথা। আরবান জীবনে এমনেই থাকে না বন্ধু, তার ওপর স্বামীরা হয় না মনের মতো রোমান্টিক। সৌমিত্র বা তাহসান ছাড়া কারেইবা কল্পনা করা উত্তম? থাক। বরং একটা কামের কথা ভাবা যাক চলেন। কথা হইলো, আর্বান নারীদের রোমান্টিকতায় ড্রিমবয় হিসাবে সৌমিত্র-তাহসান আদর্শ (সুদর্শন, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, অ্যাস্থেটিক, গুডবয় ইমেজের তারকা) তৈরি হওয়ার মাজেজা কী? নারীদের রোমান্টিকতা আইডেন্টিফাই করলে কি সেইটা বোঝা যাবে?
নারীদের রোমান্টিকতার ধারণা একটা ঘোলা জিনিস। রোমান্টিকতা অস্তিত্বের স্বাধীন অনুভূতিগুলার একটা। স্বাধীন অনুভুতি বলতে বুঝাইতেছি, নিজেরে কাউন্ট করার প্রেক্ষিতে যেইসব অনুভূতি আপনি আপনার তরে প্রকাশ করতে পারেন। আর নারীরা একটা সত্ত্বা হিসাবে কাউন্ট হওয়ার লড়াই করতে করতে কেটে যাইতেছে অনেকগুলা যুগ। এসবের ভেতর থেইকা যে নারীর যে রোমান্টিকতা মন্থন করা হইলো, সেইটা কি আসলে নারীর নিজের হইয়া উঠতে পারলো কিনা সেইটা বিরাট প্রশ্ন।
মন্থনে যেটুকু পাওয়া গেল তা তো এক অরাজনৈতিক স্বাধীনতা। যা ব্যাটাদের রাজনীতিরই মোয়া। যেমন, উপনিবেশের আমলে ভিক্টোরিয়ান আদলে আরবান নারীকে প্যাকেট করা হইলো ‘ভদ্রতা’ দিয়া। পোশাকে বা আচরণে তাঁরে দেওয়া হলো ‘দ্য লেডি’ হইয়া ওঠার স্ট্যান্ডার্ড। ব্রিটিশদের পার্টিতে ঠাকুরবাড়ির নারীর ব্লাউজ ছাড়া ঢুকতে না পারার ঘটনা নিশ্চয়ই সুধী সমাজের মনে আছে। খেয়াল কইরা দেখবেন নারীদের সাজ-পোশাক সেই যে একটা মোড় নিল, আর যে স্ট্যান্ডার্ড স্ট্যাব্লিশড হইলো, রোমান্টিক নারীর চেহারাও কিন্তু তার ওপরেই দাঁড়ায় গেল। সো, সুতির শাড়ি, লম্বা চুল আর চোখে কাজল দেওয়া নারীদের আমরা পাইলাম রোমান্টিকতার মূর্তি হিসাবে। তারপর কী ঘটলো?
এরকম নারীরাই এলো সৌমিত্রদের নায়িকা হইয়া। অপুর সংসার, মহানগর , চারুলতা– নারীরা অ্যাস্থেটিক এবং প্রেমিক বা স্বামীর নানান ব্যর্থতার একমাত্র আশ্রয়। স্বামীর দারিদ্র্যের সাথে মানায় নেওয়া আর যত্নে রাখার সিনগুলার মধ্যে রোমান্টিকতা ইনপুট দেওয়া হইল। সৌমিত্রের মতো সুদর্শন আর ইন্টেলেকচুয়াল হইলেই যে তার সাথে মানায়ে নিয়া জীবন কাটানো যাবে, এমন সব কল্পনা নিয়া আমাদের নারীরা হইয়া উঠতে লাগলেন রোমান্টিক। শর্মিলাদের দেখানো হইলো বকলম ও বিপদগ্রস্ত। ফলত কিঞ্চিৎ বোহেমিয়ানিজমরে ফ্যান্টাসাইজ কইরাও রোমান্টিকতার এরোস হইয়া উঠলেন সৌমিত্ররা।
এবার আসি তাহসান আমলে। মিউচুয়াল ডিভোর্সের পরেও মিথিলা যেরকম অর্থনৈতিক (গাড়ির অভাব নিয়া প্রথম আলোর এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন মিথিলা) ও সামাজিক গ্যাঞ্জামে পড়লেন, তার থেইকা গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠছিল মিথিলার আগের প্রেমিক কয়টা। সোশ্যাল মিডিয়ায় এখনো চলে মহাসমারোহে স্লাটশেমিং। তাহসানের ক্লিন ইমেজ আর মিথিলার একাধিক প্রেমিকের দাড়িপাল্লায় মিথিলার পাল্লা যে কতখানি ভারি তা তো শুরুতে আমার বান্ধবীর অবস্থা দেখে বুঝছেনই।
এক যুগ আগেই তাহসান সুমধুর কণ্ঠ আর ইনোসেন্ট সেইন্ট ভাইব মেয়েদের স্বপ্নের পুরুষ হইয়া উঠার নয়া ক্রাইটেরিয়া তৈরি করলো। তার ওপর ডিভোর্সের পরেও নিজের সন্তানের দেখাশোনা তাহসানকে বানায় দিলো পার্ফেক্ট ‘হাজবেন্ড ম্যাটেরিয়াল’ও। আরও আছে নেশাপাতি না করা, বাউন্ডুলে না হওয়া এক জেন্টেলম্যানসুলভ স্টারডম।
তাহসান-মিথিলার দোষগুণের বাইরে লক্ষ্য করেন নারীদের রোমান্টিক পুরুষ হবার ক্রাইটেরিয়াগুলা। যার মধ্যে বড় হইয়া উঠলো সুদর্শন চেহারা আর কেয়ারিং পার্সোনালিটি। এই সৌন্দর্য আর কেয়ারের তাহসানমূলক মানদণ্ড নারীদের নিকট তৈরি হইলো কেমনে?
নারীবাদী তাত্ত্বিক জুডিথ বাটলার তাঁর জেন্ডার ট্রাবল বইয়ে বলতেছেন, লিঙ্গ কোনো স্থির পরিচয় না। এইটা একটা পারফরমেটিভ আচরণ। কোনো একটা লিঙ্গের আচরণ ও অনুভূতি সময় ও স্থানের নিয়ম ও রাজনৈতিক ফিলোসফি দ্বারাই শেইপ হইতে থাকে। সৌমিত্র থেকে তাহসানের সময়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে তাকাইলে খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায় নারী কতখানি ‘অপর’। আর নারীর রোমান্টিক ধারণায় তাহসান বা সৌমিত্র নায়ক হইতে হইলে তারে কতরকম কগনিটিভ বায়াসনেসের মধ্যে দিয়ে যাইতে হইছে। ফলে নারীর স্বাধীন অনুভূতি তৈরি হইতে এবং নিজের আদর্শ রোমান্টিক পুরুষের স্ট্যান্ডার্ড সেট হইতে যে সাবভারসিভ পারফরম্যান্স দরকার, তা তো আমাদের মেয়েরা পারলো না। মূলত পারতে দেওয়া হইলো না। কারণ ‘সিন্ডারেলা সিন্ড্রোম’-কে (নির্ভরশীল হওয়া ও উদ্ধারকর্তা বা প্রিন্স চার্মিং-এর আকাঙ্খা করা) আদর্শ ধরে মেয়েদের বড় করা হইলো। অন্যদিকে ‘কলচর’ কিং কলকাতার বাবু সমাজের অ্যাস্থেটিজম তো ঢাকাকে দখল করলোই।
এসব তো রইলোই। দুঃখজনক ব্যাপার হইলো সৌমিত্র-তাহসানপ্রেমীদের জীবনে কিন্তু প্রিন্স চার্মিং আসে ভিন্নভাবে। তাদের কাছে থাকে রূপ আর ইন্টেলেকচুয়ালিটির সেই জুতা। যে জুতা কেউ আইসা পরায় দিবে। যে কারণে নারীদের আশৈশব সেইটা নিজে খুঁজে পায়ে দিতে দেওয়া হবে না। বোঝানো হইতো ‘বিয়ের পরে যাইও/কইরো’। অর্থাৎ নির্ভরতার পাশাপাশি সুন্দর ছেলের ইন্টেলেকচুয়ালিটি এক আহামরি টাইপ দেবার্ঘ্য হইয়া উঠল।
আমরা দেখি যে, ‘সাধারণ’ ব্যাপার হইলো ডিসিশন মেকিং কিংবা ইন্টেলেকচুয়াল পার্টিসিপেশন থেকে নারীরে বেশ আয়োজন কইরা দূরে রাখা হইতো। এমনকি নারীর মনের ভেতর কি চলে তাও কওয়া লাগল প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথদের বয়ানে। সো, সৌমিত্রের সুন্দর কইরা কথা বলা আর কবি কবি ভাব, অথবা তাহসানের ইনোসেন্ট সেইন্ট ভাইব নারীদের মুগ্ধ করলো। নারীর পার্সোনাল জাজমেন্টের বয়ামও ভরে উঠল কালচারাল অপরায়ন দিয়া। তা ছাড়া তাহসানের যে ‘ভালো ছেলে’ হয়ে ওঠার সামাজিক ক্রাইটেরিয়া–সবগুলাতেই সে সুযোগ্য। এই সুপাত্র বা ভালো ছেলের ক্রাইটেরিয়া প্রতিষ্ঠা করতে যে সফট ব্যাটাতান্ত্রিক ম্যানিপুলেশন, তা গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় কী নারীর থাকে? ব্যক্তিসত্তার ত্রুটি নিয়ে আপত্তি করলেও তা তো টিকে না। কারণ আইবিএ গ্র্যাজুয়েট, আইএলটিএসে ভালো স্কোর, ভালো প্রফেশনাল স্কিল, ভালো গান গাওয়া, স্টারডম, কেয়ারিং পার্সোনালিটি এইসব কিছু যার থাকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললে বাড়াবাড়ি ওই মেয়েরই! ব্যাটাতান্ত্রিক কালচারাল প্র্যাক্টিসের এই বিপত্তিতে পইড়া সামাজিকভাবে এব্যান্ডানড না হয়ে তাহসানরে রোমান্টিকতার আদর্শ ধইরা নিলেই মেবি সেইফ থাকা গেল! ফলে কেবলি রইলো একটা ডিজঅউনড হওয়ার মতো ‘রোমান্টিকতা’র শোপিস। অন্যের হাতে তৈরি রোমান্টিকতার মোয়া তারে ধরায় দেওয়া হইলো। যাতে নারীর স্বাধীন অনুভূতির নবধারাজলে শেইপ হওয়া রোমান্টিক দেবতাদের ভাসান না হইতে পারে।
আবার ফিরি বাটলারের কাছে। লিঙ্গের পারফর্ম্যান্সমূলক স্বভাবকে স্বীকার কইরা বাটলার জেন্ডার ট্রাবল বইয়ে প্রস্তাব করছিলেন, আমরা সব নিয়মরেই বদলাইতে পারি আর বদল অনুযায়ী নর্মস ইনপুট দিতে পারি। লিঙ্গ-ভূমিকার যে সীমা এখন বহাল আছে, সেই সীমার ভেতর থেকে আমাদের নারীরা যে গুডবয়দের পাইলো, তারাই আমাদিগের প্রিন্স চার্মিং হইয়া থাকবে? নাকি লিঙ্গব্যবস্থার ভ্রম থেইকা যে রোমান্টিকতার উদগীরণ হইলো সেইটারে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে? সেইটার দিকে চক্ষু নিবন্ধিত রাখার জরুরত বোধ করলাম আর আমাদের পুকি তাহসান আর সৌমিত্রের রূপমহিমার প্রতি মোহাব্বত কা ইজহার নিয়াই আশার বাণী সকল শেষ করিলাম।
তাহসানের প্রথম সলো অ্যালবাম ‘কথোপকথন’। জি সিরিজের ব্যানারে রিলিজ হয় ২০০৪ সালে। অর্থাৎ একুশ বছর আগে। হালচালে এসে যখন তিনি গান ছাড়ার ঘোষণা দেন; তখন জানান, এ বয়সে এসে ‘দূরে তুমি দাঁড়িয়ে’ আর গাইতে চান না।
৭ ঘণ্টা আগেগতকাল থেকে ফেসবুকে দেখতেছি, সবাই বন্ধু হইতে চায়। আমার বন্ধু হইতে চায় না। ডিয়ার রিডার, আপনারও বন্ধু হইতে চায় না, স্যরি; সবাই বন্ধু হইতে চায় স্বপ্নীলের।
১ দিন আগেজেন-জি’রা কর্মী হিসেবে অলস। এই অভিযোগ কর্পোরেট বস মহলে কমন। আসলেই কি তাই? জেন-জি’রা কর্মক্ষেত্রে ঢুকেছে অল্প কিছুদিন হল। কিন্তু এরই মধ্যে চাকরি ছাড়ার রেটে তারা এগিয়ে আছে, চাকরিতে তারা পুরো মনোযোগ দেয় না –এসব নালিশ তাদের বিরুদ্ধে প্রবল। আরেকদিকে জেন-জি টিকটকার, রিলমেকার, লেখকরা বলছে এই প্রবণতাগুলো সত
৩ দিন আগেআপনি হয়তো ভাবছেন দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি বা ডেঙ্গুই সমাজের প্রধান শত্রু। কিন্তু না, এই দেশে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জিনিস কিন্তু আপনার সিনেমার রুচি। ভুল সিনেমা দেখে ফেললে আপনি শুধু আজিব চিড়িয়াই নন, বরং চলমান সামাজিক কলঙ্ক।
৬ দিন আগে