অফিসে এক নতুন ভাইরাসের আবির্ভাব দেখছেন? সংক্রমণের লক্ষণ সময়মত অফিস থেকে বের হয়ে যাওয়া, উইকেন্ডে ইমেইলের রিপ্লাই না দেওয়া এবং প্রমোশনের পিছে জীবন-যৌবন না ঢেলে দেওয়া। এই ভাইরাসের উদ্ভাবক বলা হচ্ছে জেন-জিদের। কেউ বলছে তারা অলস, কেউ বলছে বিদ্রোহী। ভেসে আসছে ‘কোয়ায়েট কুয়িটিং’ এর মত টার্ম। এসব-ই কি নতুন মোড়কে পুরোনো কোনো আইডিয়া নাকি জেন-জির ইউনিক কোনো উদ্ভাবন? কেন জেন-জি সব জায়গার মত কর্মক্ষেত্রেও বিদ্রোহী? আবারও ঐ একই প্রশ্ন, জেন-জি কী চায়?
আদ্রিতা কবির

জেন-জি’রা কর্মী হিসেবে অলস। এই অভিযোগ কর্পোরেট বস মহলে কমন। আসলেই কি তাই? জেন-জি’রা কর্মক্ষেত্রে ঢুকেছে অল্প কিছুদিন হল। কিন্তু এরই মধ্যে চাকরি ছাড়ার রেটে তারা এগিয়ে আছে, চাকরিতে তারা পুরো মনোযোগ দেয় না –এসব নালিশ তাদের বিরুদ্ধে প্রবল। আরেকদিকে জেন-জি টিকটকার, রিলমেকার, লেখকরা বলছে এই প্রবণতাগুলো সত্যি হয়ে থাকে তবে এর দায় গিয়ে পড়ে বসদের ঘাড়ে, কর্মীদের ঘাড়ে নয়।
এসবের মধ্যে শোনা যায় জেন-জি দের নিয়ে নতুন অভিযোগ: তারা ‘কোয়ায়েট কুয়িটিং’ করছে। কী এই কোয়ায়েট কুয়িটিং? কেন এটা জেন-জিদের দিকে ছোঁড়া সিইওদের সর্বশেষ তীর? জেন-জিরা নিজেরা এই ট্রেন্ডকে কীভাবে দেখছে?
জেন-জির ঠিক আগের প্রজন্ম মিলেনিয়ালরা (জন্মসাল ১৯৮১-১৯৯৬) বিশ্বাসী ছিল ‘হাসেল কালচার’-এ। মানে অফিসে ওভারটাইম করা, নিজে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার চেষ্টা, ‘ফোর এ এম ক্লাব’ জাতীয় বই পড়ে সূর্যের আগে ভোর চারটায় ওঠা এবং তখন থেকেই কাজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা ইত্যাদি। এখনো নেটজগতে খুঁজলে এমন কন্টেন্ট পাওয়া যায় ভুরি ভুরি।
কিন্তু ঠিক তার পরের জেনারেশন জেন-জি চলছে পুরো উলটো মডেলে। তাদের অভিযোগ এত হাসেল করে মিলেনিয়ালদের তেমন কোনো ফায়দা হয় নি। অর্থনীতি বৈশ্বিকভাবেই ভেঙে পড়েছে, কেউ বাড়ি বা স্থাবর সম্পত্তি কিনতে পারছে না অস্বাভাবিক প্রপার্টি রেটের জন্য, আমেরিকান মিলেনিয়ালদের জীবন চলে যাচ্ছে স্টুডেন্ট লোন শোধ করতে করতে। মিলেনিয়ালরা তাদের অতিকাঙ্ক্ষিত প্রোমশন পাচ্ছে না এত কাজ করেও। আরেকদিকে কম বয়সী মিলেনিয়াল সিইও দেখে যারা উৎসাহী ছিল তাদের বেশিরভাগই কাছাকাছি এমনকি দূরবর্তী মাত্রায়ও সেই সফলতা পাচ্ছে না।
জেন-জি প্রজন্মকে অনেকেই বলেন ডিজইল্যুশনমেন্ট বা স্বপ্নভঙ্গের প্রজন্ম। তাদের জন্মলগ্নে ছিল ৯/১১ এবং তার পরবর্তী বিশ্বব্যাপী অভিবাসী-বিরোধী পলিসি, এয়ারপোর্টে গায়ের চামড়ার রং নিয়ে ভোগান্তি, বিশ্বমন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, ইনফরমেশন ওভারলোড, বারংবার বিভিন্ন দেশে ডানপন্থীদের জয়, রেশিয়াল ভায়োলেন্স, প্রায় দুই বছর ব্যাপী প্যানডেমিক ও লকডাউন, পুলিশি সহিংসতা, জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব ও বিপর্যয় এবং ইতিহাসের সবচেয়ে চড়া মাত্রায় সুদের লোন। জেন-জিদের অনেকেই তাই হতাশাবাদী এবং প্রচলিত সামাজিক প্র্যাক্টিসের ব্যপারে সন্দেহপ্রবণ। যেমন, ‘কর্মই জীবন’।
তারা বরং জীবন ও কর্মের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক মানে ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স চায়। জেন-জিরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা শুরু করেছে ২০২০ এর প্যান্ডেমিকের মধ্যে। এ সময় সবাই আসন্ন অসুস্থতা বা মৃত্যু নিয়ে চিন্তিত হওয়ায় এবং পরিবারের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পাওয়ায়, এক বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে কর্মীদের মানসিকতায়। জেন-জি এই বাস্তবতা দিয়েই কর্মজীবনের সূচনা করে। এটা তার ওয়ার্ক এথিকসের প্রেক্ষিত তৈরি করে।
উৎসর আলাপ শেষ, এবার আসি তর্জমা ও মাজেজায়।
কোয়ায়েট কুয়িটিং অর্থ শুধু চাকরির জন্য যা যা দরকার, তার চেয়ে একফোঁটা বেশি সময়, প্রচেষ্টা, বা আগ্রহ না দেখানো। এখানে কুইটিং মানে চাকরি ছেড়ে দেওয়া বোঝায় না, বরং চাকরিটা ধরে রেখে কেবল যতটুকু না করলেই নয়, ততটুকুই করাকে বোঝায়। সময়মত আসা, ঠিক সময়ে বের হয়ে যাওয়া, অফিসের বাইরে অফিসের কাজ না করা বা সে বিষয়ে চিন্তা না করা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনলাইন বা অফলাইন মিটিং না করা এবং নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে কর্মজীবন থেকে পুরোপুরি আলাদা রাখা এই ট্রেন্ডের অংশ।
২০২০ সালের প্রথম দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোয়ায়েট কুয়িটিং বিষয়ক আলোচনা যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিংস কলেজ লন্ডনের কর্মসংস্থান বিষয়ক অধ্যাপক কেটি বেইলি বলেন, মহামারীর সময় মানুষ যখন তাদের কাজ, নিয়োগকর্তার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এবং সাধারণভাবে তাদের জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে, তখন থেকেই কোয়ায়েট কুয়িটিং এর জনপ্রিয়তা শুরু হয়। অনেক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ট্রেন্ডের মতোই, এটিও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কারণ যাদের কথা সমাজের প্রবল বয়ান হয়ে ওঠে –যেমন শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং শ্রমশক্তির অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা, সবাই এ নিয়ে কথা বলছিলেন। তাই এটি আরও বেশি করে ট্রেন্ড হয়ে ওঠে। কোয়ায়েট কুয়িটিং শব্দটি বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে গ্রহণ ও ব্যবহার করেছে।’
তবে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এটি আসলে কতটা প্রচলিত? আর এটা কি সত্যিই কোনো নতুন ঘটনা? একজনের চাকরি যতটুকু সময়ের জন্য সে যদি ঠিক ততটুকু সময়ই কাজ করে তাহলে তার আলাদা নাম দেওয়ার কী আছে? কেন বেশি সময় অফিসে থাকাই স্বাভাবিক এবং এর ব্যতিক্রমকে ‘কুয়িটিং’ বলে ধরা হবে?
সবগুলো প্রশ্নই ভ্যালিড। পূর্বের হাসেল কালচার এবং কঠিন পুঁজিবাদী ওয়ার্ক এথিকের কারণে এই কোয়ায়েট কুয়িটিংকে ব্যতিক্রমী এক ট্রেন্ড হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এই ট্রেন্ডের তকমা একপাক্ষিক বললেও ভুল হবে। জেন-জিদের মধ্যে অনেকেই এই ট্রেন্ড ওন করছে এবং দাবি করছে তারাই এর প্রবর্তক বা অন্তত অ্যাক্টিভ চর্চাকারী।
কোয়ায়েট কুয়িটিং হ্যাশট্যাগের হাজার হাজার ভিডিও টিকটক ও ইন্সটাগ্রামে পাওয়া যায়। এমনকি তৈরি হয়েছে কোয়ায়েট কুয়িটিং ইনফ্লুয়েন্সার!
২০২২ সালে, হান্টার কাইমি যখন যুক্তরাষ্ট্রের একটি জনপ্রিয় টক শো ড. ফিল-এ আসেন, তখন প্রযোজকরা তার পুরো নামও ব্যবহার করেননি। তাকে শুধু ‘কোয়ায়েট কুয়িটার’ হিসেবে পরিচয় করানো হয়েছিল। কাইমি দর্শকদের উদ্দেশ্যে সেখানে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি কোয়ায়েট কুয়িটিং আসলে কর্মীদের অধিকারের জন্য একটি প্রতিবাদ। আমি মনে করি না কাজ আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, এবং আমার মনে হয় না এটা কারও জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হওয়া উচিত।’

কাইমির একটি ভিডিওতে বলেন, ‘যে চাকরি আমাকে একজন মানুষ হিসেবে গুরুত্ব দেয় না, তার জন্য আমি ৬০ ঘণ্টা ধরে কাজ করে নিজেকে শেষ করে দিতে পারি না।’ এই ভিডিওতে ৭ মিলিয়নেরও বেশি ভিউ, ৩৮,০০০ কমেন্ট এবং ভিডিওটি ৪৩,০০০ বারের বেশি শেয়ার হয়েছিল।
কাইমি আমেরিকার ওয়াশিংটন রাজ্যের একজন রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার ছিলেন, দ্রুত এই আন্দোলনের এক প্রধান ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। এই ট্রেন্ডও সাড়া ফেলে দ্রুত। কাইমি বলেন, এর কারণ হলো অসংখ্য মানুষ অনুভব করছিল যে তাদের মালিকরা তাদের সুযোগ নিচ্ছে।
হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউতে জ্যাক জেঙ্গার এবং জোসেফ ফোকম্যানের লেখা একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, অনেক মানুষই কর্মজীবনে এমন বসের অধীনে কাজ করেছেন, যারা তাদের কোয়ায়েট কুয়িটিং-এর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এর মূল কারণ হচ্ছে নিজেকে কম মূল্যবান মনে করা। এটা হতে পারে বসের পক্ষপাতিত্বের কারণে, অথবা তাদের অনুচিত আচরণের কারণে। যেমন, কাজের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে সময়মত প্রোমোশন না পাওয়া, বেতন না বাড়া, কাজের প্রশংসা না পাওয়া ইত্যাদি। কর্মীদের আগ্রহের অভাব আসলে বসের এসব কার্যকলাপের একটা প্রতিক্রিয়া।
১,১৩,০০০-এরও বেশি করপোরেট লিডারদের দেওয়া ডেটা বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছেন, একজন প্রতিষ্ঠান প্রধান তার দলের সদস্যদের প্রতি কতটা যত্নশীল এবং তাদের ভালো থাকা নিয়ে চিন্তিত, তা বোঝার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আচরণ আস্থা বা ট্রাস্ট। এই গবেষণা অনুযায়ী, এই আস্থা প্রতিষ্ঠান প্রধানের তিনটি আচরণের সাথে সম্পর্কিত।
প্রথমত, টিমের সবার সঙ্গে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা।
দ্বিতীয়ত, কনসিস্টেন্সি। ফ্রেন্ডলি হওয়ার পাশাপাশি, একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানকে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। অধিকাংশ বস নিজেদের যতটা কনসিস্টেন্ট মনে করেন, আসলে তারা ততটা নন।
তৃতীয়ত, দক্ষতা। এটা অবভিয়াস। কর্মীদের কাজ না বুঝে তাদের উপদেশ দেওয়া বা মূল্যায়ন করা সম্ভব না।
জেঙ্গার ও ফোকম্যানের মতে, এই আস্থার সম্পর্ক যেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে আছে সেগুলোতে কোয়ায়েট কুয়িটিং জাতীয় প্রবণতা কম, কর্মীরা প্রতিষ্ঠানের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করে এবং প্রতিষ্ঠানও তাদের এক্সপ্লয়েট করে না।
এখন প্রশ্ন হলো, এই ট্রেন্ড কি কর্মজীবনের একটি স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে আসবে, নাকি সময়ের সাথে সাথে এটিও পুরোনো হয়ে যাবে?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মুশকিল। জেন-জি এবং পরবর্তী জেন-আলফা (জন্মসাল ২০১০ থেকে ২০২৪) পুঁজিবাদী চাকরি ব্যবস্থা নিয়ে আগের প্রজন্মগুলোর মত মোটিভেটেড বোধ করে না। কিন্তু তারাও কি এক পর্যায়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেবে না? তারা কি জীবনান্দের মত শেষ পর্যন্ত বলে যেতে পারবে—

জেন-জি’রা কর্মী হিসেবে অলস। এই অভিযোগ কর্পোরেট বস মহলে কমন। আসলেই কি তাই? জেন-জি’রা কর্মক্ষেত্রে ঢুকেছে অল্প কিছুদিন হল। কিন্তু এরই মধ্যে চাকরি ছাড়ার রেটে তারা এগিয়ে আছে, চাকরিতে তারা পুরো মনোযোগ দেয় না –এসব নালিশ তাদের বিরুদ্ধে প্রবল। আরেকদিকে জেন-জি টিকটকার, রিলমেকার, লেখকরা বলছে এই প্রবণতাগুলো সত্যি হয়ে থাকে তবে এর দায় গিয়ে পড়ে বসদের ঘাড়ে, কর্মীদের ঘাড়ে নয়।
এসবের মধ্যে শোনা যায় জেন-জি দের নিয়ে নতুন অভিযোগ: তারা ‘কোয়ায়েট কুয়িটিং’ করছে। কী এই কোয়ায়েট কুয়িটিং? কেন এটা জেন-জিদের দিকে ছোঁড়া সিইওদের সর্বশেষ তীর? জেন-জিরা নিজেরা এই ট্রেন্ডকে কীভাবে দেখছে?
জেন-জির ঠিক আগের প্রজন্ম মিলেনিয়ালরা (জন্মসাল ১৯৮১-১৯৯৬) বিশ্বাসী ছিল ‘হাসেল কালচার’-এ। মানে অফিসে ওভারটাইম করা, নিজে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার চেষ্টা, ‘ফোর এ এম ক্লাব’ জাতীয় বই পড়ে সূর্যের আগে ভোর চারটায় ওঠা এবং তখন থেকেই কাজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা ইত্যাদি। এখনো নেটজগতে খুঁজলে এমন কন্টেন্ট পাওয়া যায় ভুরি ভুরি।
কিন্তু ঠিক তার পরের জেনারেশন জেন-জি চলছে পুরো উলটো মডেলে। তাদের অভিযোগ এত হাসেল করে মিলেনিয়ালদের তেমন কোনো ফায়দা হয় নি। অর্থনীতি বৈশ্বিকভাবেই ভেঙে পড়েছে, কেউ বাড়ি বা স্থাবর সম্পত্তি কিনতে পারছে না অস্বাভাবিক প্রপার্টি রেটের জন্য, আমেরিকান মিলেনিয়ালদের জীবন চলে যাচ্ছে স্টুডেন্ট লোন শোধ করতে করতে। মিলেনিয়ালরা তাদের অতিকাঙ্ক্ষিত প্রোমশন পাচ্ছে না এত কাজ করেও। আরেকদিকে কম বয়সী মিলেনিয়াল সিইও দেখে যারা উৎসাহী ছিল তাদের বেশিরভাগই কাছাকাছি এমনকি দূরবর্তী মাত্রায়ও সেই সফলতা পাচ্ছে না।
জেন-জি প্রজন্মকে অনেকেই বলেন ডিজইল্যুশনমেন্ট বা স্বপ্নভঙ্গের প্রজন্ম। তাদের জন্মলগ্নে ছিল ৯/১১ এবং তার পরবর্তী বিশ্বব্যাপী অভিবাসী-বিরোধী পলিসি, এয়ারপোর্টে গায়ের চামড়ার রং নিয়ে ভোগান্তি, বিশ্বমন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, ইনফরমেশন ওভারলোড, বারংবার বিভিন্ন দেশে ডানপন্থীদের জয়, রেশিয়াল ভায়োলেন্স, প্রায় দুই বছর ব্যাপী প্যানডেমিক ও লকডাউন, পুলিশি সহিংসতা, জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব ও বিপর্যয় এবং ইতিহাসের সবচেয়ে চড়া মাত্রায় সুদের লোন। জেন-জিদের অনেকেই তাই হতাশাবাদী এবং প্রচলিত সামাজিক প্র্যাক্টিসের ব্যপারে সন্দেহপ্রবণ। যেমন, ‘কর্মই জীবন’।
তারা বরং জীবন ও কর্মের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক মানে ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স চায়। জেন-জিরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করা শুরু করেছে ২০২০ এর প্যান্ডেমিকের মধ্যে। এ সময় সবাই আসন্ন অসুস্থতা বা মৃত্যু নিয়ে চিন্তিত হওয়ায় এবং পরিবারের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পাওয়ায়, এক বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে কর্মীদের মানসিকতায়। জেন-জি এই বাস্তবতা দিয়েই কর্মজীবনের সূচনা করে। এটা তার ওয়ার্ক এথিকসের প্রেক্ষিত তৈরি করে।
উৎসর আলাপ শেষ, এবার আসি তর্জমা ও মাজেজায়।
কোয়ায়েট কুয়িটিং অর্থ শুধু চাকরির জন্য যা যা দরকার, তার চেয়ে একফোঁটা বেশি সময়, প্রচেষ্টা, বা আগ্রহ না দেখানো। এখানে কুইটিং মানে চাকরি ছেড়ে দেওয়া বোঝায় না, বরং চাকরিটা ধরে রেখে কেবল যতটুকু না করলেই নয়, ততটুকুই করাকে বোঝায়। সময়মত আসা, ঠিক সময়ে বের হয়ে যাওয়া, অফিসের বাইরে অফিসের কাজ না করা বা সে বিষয়ে চিন্তা না করা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনলাইন বা অফলাইন মিটিং না করা এবং নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে কর্মজীবন থেকে পুরোপুরি আলাদা রাখা এই ট্রেন্ডের অংশ।
২০২০ সালের প্রথম দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোয়ায়েট কুয়িটিং বিষয়ক আলোচনা যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিংস কলেজ লন্ডনের কর্মসংস্থান বিষয়ক অধ্যাপক কেটি বেইলি বলেন, মহামারীর সময় মানুষ যখন তাদের কাজ, নিয়োগকর্তার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এবং সাধারণভাবে তাদের জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে, তখন থেকেই কোয়ায়েট কুয়িটিং এর জনপ্রিয়তা শুরু হয়। অনেক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ট্রেন্ডের মতোই, এটিও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কারণ যাদের কথা সমাজের প্রবল বয়ান হয়ে ওঠে –যেমন শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং শ্রমশক্তির অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা, সবাই এ নিয়ে কথা বলছিলেন। তাই এটি আরও বেশি করে ট্রেন্ড হয়ে ওঠে। কোয়ায়েট কুয়িটিং শব্দটি বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে গ্রহণ ও ব্যবহার করেছে।’
তবে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এটি আসলে কতটা প্রচলিত? আর এটা কি সত্যিই কোনো নতুন ঘটনা? একজনের চাকরি যতটুকু সময়ের জন্য সে যদি ঠিক ততটুকু সময়ই কাজ করে তাহলে তার আলাদা নাম দেওয়ার কী আছে? কেন বেশি সময় অফিসে থাকাই স্বাভাবিক এবং এর ব্যতিক্রমকে ‘কুয়িটিং’ বলে ধরা হবে?
সবগুলো প্রশ্নই ভ্যালিড। পূর্বের হাসেল কালচার এবং কঠিন পুঁজিবাদী ওয়ার্ক এথিকের কারণে এই কোয়ায়েট কুয়িটিংকে ব্যতিক্রমী এক ট্রেন্ড হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এই ট্রেন্ডের তকমা একপাক্ষিক বললেও ভুল হবে। জেন-জিদের মধ্যে অনেকেই এই ট্রেন্ড ওন করছে এবং দাবি করছে তারাই এর প্রবর্তক বা অন্তত অ্যাক্টিভ চর্চাকারী।
কোয়ায়েট কুয়িটিং হ্যাশট্যাগের হাজার হাজার ভিডিও টিকটক ও ইন্সটাগ্রামে পাওয়া যায়। এমনকি তৈরি হয়েছে কোয়ায়েট কুয়িটিং ইনফ্লুয়েন্সার!
২০২২ সালে, হান্টার কাইমি যখন যুক্তরাষ্ট্রের একটি জনপ্রিয় টক শো ড. ফিল-এ আসেন, তখন প্রযোজকরা তার পুরো নামও ব্যবহার করেননি। তাকে শুধু ‘কোয়ায়েট কুয়িটার’ হিসেবে পরিচয় করানো হয়েছিল। কাইমি দর্শকদের উদ্দেশ্যে সেখানে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি কোয়ায়েট কুয়িটিং আসলে কর্মীদের অধিকারের জন্য একটি প্রতিবাদ। আমি মনে করি না কাজ আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, এবং আমার মনে হয় না এটা কারও জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হওয়া উচিত।’

কাইমির একটি ভিডিওতে বলেন, ‘যে চাকরি আমাকে একজন মানুষ হিসেবে গুরুত্ব দেয় না, তার জন্য আমি ৬০ ঘণ্টা ধরে কাজ করে নিজেকে শেষ করে দিতে পারি না।’ এই ভিডিওতে ৭ মিলিয়নেরও বেশি ভিউ, ৩৮,০০০ কমেন্ট এবং ভিডিওটি ৪৩,০০০ বারের বেশি শেয়ার হয়েছিল।
কাইমি আমেরিকার ওয়াশিংটন রাজ্যের একজন রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার ছিলেন, দ্রুত এই আন্দোলনের এক প্রধান ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। এই ট্রেন্ডও সাড়া ফেলে দ্রুত। কাইমি বলেন, এর কারণ হলো অসংখ্য মানুষ অনুভব করছিল যে তাদের মালিকরা তাদের সুযোগ নিচ্ছে।
হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউতে জ্যাক জেঙ্গার এবং জোসেফ ফোকম্যানের লেখা একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, অনেক মানুষই কর্মজীবনে এমন বসের অধীনে কাজ করেছেন, যারা তাদের কোয়ায়েট কুয়িটিং-এর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এর মূল কারণ হচ্ছে নিজেকে কম মূল্যবান মনে করা। এটা হতে পারে বসের পক্ষপাতিত্বের কারণে, অথবা তাদের অনুচিত আচরণের কারণে। যেমন, কাজের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে সময়মত প্রোমোশন না পাওয়া, বেতন না বাড়া, কাজের প্রশংসা না পাওয়া ইত্যাদি। কর্মীদের আগ্রহের অভাব আসলে বসের এসব কার্যকলাপের একটা প্রতিক্রিয়া।
১,১৩,০০০-এরও বেশি করপোরেট লিডারদের দেওয়া ডেটা বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছেন, একজন প্রতিষ্ঠান প্রধান তার দলের সদস্যদের প্রতি কতটা যত্নশীল এবং তাদের ভালো থাকা নিয়ে চিন্তিত, তা বোঝার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আচরণ আস্থা বা ট্রাস্ট। এই গবেষণা অনুযায়ী, এই আস্থা প্রতিষ্ঠান প্রধানের তিনটি আচরণের সাথে সম্পর্কিত।
প্রথমত, টিমের সবার সঙ্গে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা।
দ্বিতীয়ত, কনসিস্টেন্সি। ফ্রেন্ডলি হওয়ার পাশাপাশি, একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানকে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। অধিকাংশ বস নিজেদের যতটা কনসিস্টেন্ট মনে করেন, আসলে তারা ততটা নন।
তৃতীয়ত, দক্ষতা। এটা অবভিয়াস। কর্মীদের কাজ না বুঝে তাদের উপদেশ দেওয়া বা মূল্যায়ন করা সম্ভব না।
জেঙ্গার ও ফোকম্যানের মতে, এই আস্থার সম্পর্ক যেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে আছে সেগুলোতে কোয়ায়েট কুয়িটিং জাতীয় প্রবণতা কম, কর্মীরা প্রতিষ্ঠানের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করে এবং প্রতিষ্ঠানও তাদের এক্সপ্লয়েট করে না।
এখন প্রশ্ন হলো, এই ট্রেন্ড কি কর্মজীবনের একটি স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে আসবে, নাকি সময়ের সাথে সাথে এটিও পুরোনো হয়ে যাবে?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মুশকিল। জেন-জি এবং পরবর্তী জেন-আলফা (জন্মসাল ২০১০ থেকে ২০২৪) পুঁজিবাদী চাকরি ব্যবস্থা নিয়ে আগের প্রজন্মগুলোর মত মোটিভেটেড বোধ করে না। কিন্তু তারাও কি এক পর্যায়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেবে না? তারা কি জীবনান্দের মত শেষ পর্যন্ত বলে যেতে পারবে—

আইনের দেবী থেমিসের চোখে কালো কাপড় বাঁধা থাকে। এর কেতাবি অর্থ, বিচার হবে অন্ধ বা নিরপেক্ষ; আবেগ, পরিচয় বা দৃশ্যমান চাকচিক্য সেখানে প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু আমার মনে হয় ঘটনা অন্য। থেমিস সম্ভবত লজ্জায় চোখ বাইন্ধা রাখছেন।
৭ দিন আগে
টিকটক, রিলস, ইউটিউব কিংবা ইউটিউব শর্টস– সর্বত্র এখন ভোজপুরি গানের আধিপত্য। বিহার, পূর্ব-উত্তর প্রদেশ ও সংলগ্ন অঞ্চলের ভাষার এই গান কীভাবে বিশ্ব মাতাচ্ছে, দেখাচ্ছে ভাইরালের ভেল্কি? এই প্রশ্নের বিস্তারিত শুলুকসন্ধানের প্রয়াস এই লেখা।
১১ দিন আগে
দেশের ডিজিটাল স্পেসজুড়ে এখন চলছে বটের রাজত্ব। বিটিভির ভাষায় বললে বট আইডির বাম্পার ফলন। ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি বট। মহা সমারোহে চলছে ‘একটি মানুষ একটি বট আইডি’ প্রকল্প। চলুন জানি, নানা ধরণের বটের কর্মকান্ড; ঘুরে আসি বাংলার ডিজিটাল বটমূল।
১২ দিন আগে
শূন্য দশক বাংলা মিউজিকের একটা ক্রান্তিকাল। নিউজিকে নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব এবং ট্রাডিশনাল মিউজিকের নতুন উপস্থাপনের দশক। শিরিনের বিখ্যাত গান পাঞ্জাবিওয়ালাকে কেন্দ্র করে, শূন্য দশকের ফোক ফিউশন নিয়ে এই লেখা।
১৮ দিন আগে