leadT1ad

খালেদা জিয়ার অর্থনৈতিক সংস্কার: ভ্যাট প্রবর্তন থেকে নারী শিক্ষা

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ একটি ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। তখন অর্থনীতির সিংহভাগই ছিল কৃষিনির্ভর। কিন্তু শুধু কৃষিনির্ভর ব্যবস্থার ওপর ভর করে অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই অর্থনীতির রূপান্তর অপরিহার্য হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর কয়েক বছর নানা রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। ফলে ওই সময়ে দেশের অর্থনীতিতে তেমন কোনো রূপান্তর দেখা যায়নি। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রভার গ্রহণ করার পর আত্মনির্ভর অর্থনীতির দেশ গড়তে উদ্যোগী হন। তাঁর উদ্যোগেই বেসরকারি খাত বিকশিত হতে শুরু করে। সেই ধারা অব্যাহত রেখে খালেদা জিয়াও নানা উদ্যোগের মাধ্যমে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেন।

খালেদা জিয়া তিন মেয়াদে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে একটি মেয়াদ ছিল খুবই স্বল্পস্থায়ী। মূলত দুটি মেয়াদে (১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-০৬) তিনি পূর্ণকাল দায়িত্ব পালন করেন। এই উভয় মেয়াদেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। স্বাধীনতার পর দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮০ শতাংশের ওপরে, যা বর্তমানে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। দারিদ্র্য হ্রাসে খালেদা জিয়ার শাসনামলে গৃহীত নানা পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

রাজস্ব সংস্কার ও ভ্যাট প্রবর্তন
১৯৯১ সালে সরকার গঠনের পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করে। করকাঠামোতে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। এটি প্রবর্তনের পর তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ আন্দোলনে নামে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেও ছিল নানা বাধা। তা সত্ত্বেও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভ্যাট ব্যবস্থা চালু রাখার বিষয়ে অনড় ছিলেন। সেই ভ্যাটই বর্তমানে দেশের রাজস্ব আহরণের সবচেয়ে বড় খাতে রূপ নিয়েছে।

আশির দশকে বিদেশি অনুদান ছাড়া বাজেট তৈরি করা সম্ভব হতো না। বাজেটের বড় অংশই নির্ভর করত বিদেশি অনুদানের ওপর। ভ্যাট ব্যবস্থা প্রবর্তনের পাশাপাশি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব সংস্কারের কারণে ধীরে ধীরে বাজেটে দেশীয় অর্থের জোগান বাড়তে থাকে। বর্তমানে বাজেটে বৈদেশিক অনুদানের পরিমাণ এক শতাংশেরও কম, যা একসময় ৫০ শতাংশের ওপরে ছিল।

ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সংস্কার
১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ মেয়াদের সরকার ব্যাংক খাতেও সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে খালেদা জিয়া অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বে ১৯৯৩ সালে ব্যাংক সংস্কার কমিটি গঠন করেন। দুই বছর কাজ করে ওই কমিটি একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই প্রতিবেদন ধরে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ব্যাংক খাতে আমূল সংস্কার আনেন। ফলে ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে আসে। এ ছাড়া ওই সরকার ব্যাংক কোম্পানি আইন প্রণয়ন করে, যা দেশের আর্থিক খাত সংস্কারের অন্যতম মাইলফলক।

নারী শিক্ষা ও তৈরি পোশাক খাত
দেশের নানা টানাপোড়েনের মধ্যেও খালেদা জিয়ার সরকার প্রথম মেয়াদেই নারী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাকে অবৈতনিক করে। পাশাপাশি শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে উপবৃত্তি চালু করা হয়। ফলে শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। এতে দেশের শ্রমশক্তিতেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পে স্বল্পশিক্ষিত নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ বাড়ে। খালেদা জিয়ার গৃহীত পদক্ষেপের ধারাবাহিকতা পরবর্তী সরকারগুলোও চালু রাখে। ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসে। বর্তমানে শিক্ষায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা বেশি।

এ ছাড়া ওই সরকার শিল্পখাতে বেসরকারি বিনিয়োগের বিধিনিষেধ শিথিল করা, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প পুনর্গঠন ও আংশিক বেসরকারীকরণের নীতি অব্যাহত রাখা এবং আমদানি-রপ্তানি নীতিতে উদারীকরণ জোরদার করে। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ে এবং কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৯৯৪-৯৫ সময়ে রপ্তানিমুখী শিল্প ও তৈরি পোশাক খাতের সম্প্রসারণে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা চালু, শুল্ক ও কর কাঠামোয় নীতিগত ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং রপ্তানি খাতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়। এতে তৈরি পোশাকশিল্প দ্রুত সম্প্রসারিত হয় এবং এটি দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎসে পরিণত হওয়ার পথে অগ্রসর হয়।

২০০১ পরবর্তী সংস্কার ও টেলিযোগাযোগ
২০০১ সালে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ফের নানা সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে খালেদা জিয়ার সরকার। এ মেয়াদে বেসরকারি ব্যাংকের কার্যক্রম সম্প্রসারণে নীতিগত সহায়তা প্রদান, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা জোরদার এবং আর্থিক খাতে বাজারভিত্তিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়। ফলে ব্যবসা ও শিল্পখাতে ঋণপ্রবাহ ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ে।

২০০১ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর খালেদা জিয়ার সরকার টেলিযোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ উদারীকরণ নিশ্চিত করে। এর ফলে প্রতিযোগিতামূলক মোবাইল বাজার গড়ে ওঠে এবং গ্রামীণ পর্যায়ে মোবাইল সংযোগ দ্রুত বিস্তৃত হয়। এতে ডিজিটাল যোগাযোগ সহজ হওয়ায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও সেবা খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়তে থাকে। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে ভিজিডি, ভিজিএফসহ খাদ্যনিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা হয়। এনজিও ও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে সরকারি সহায়তা অব্যাহত রাখা হয়। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভোগ ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগ বাড়ে, যা দারিদ্র্য হ্রাসে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

জ্বালানি নিরাপত্তা ও গ্যাস রপ্তানি প্রসঙ্গ
আরেকটি বড় উদ্যোগ নিয়েছিল খালেদা জিয়ার সরকার। ২০০২ সালে ভারতে গ্যাস রপ্তানির বিষয়ে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যদিও এ বিষয়ে আপত্তি তুলেছিল তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। তাদের দাবি ছিল, দেশের প্রয়োজন মেটানোর জন্য ৫০ বছরের গ্যাস মজুদ রেখে রপ্তানি করা যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা খালেদা জিয়াকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, দেশে কী পরিমাণ গ্যাসের মজুদ আছে তা নিশ্চিত নয়। ফলে দেশে যে গ্যাস আছে, তা দিয়ে ৫০ বছরের প্রয়োজন মিটবে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা নেই। এমন পরিস্থিতিতে গ্যাস রপ্তানির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে খালেদা জিয়ার সরকার। এর ফলে দেশ এক ভয়াবহ জ্বালানি সংকটের মুখে পড়া থেকে বেঁচে যায়।

খালেদা জিয়ার শাসনামলের অর্থনৈতিক সংস্কারের বৈশিষ্ট্য ছিল ধাপে ধাপে নীতিগত পরিবর্তন আনয়ন, বড় আকারের ঘোষণা নয়। তাঁর সরকারের সময়ে বাজারমুখী অর্থনীতি, বেসরকারি খাতের বিকাশ এবং রপ্তানিনির্ভর প্রবৃদ্ধির যে ভিত্তি তৈরি হয়, তা পরবর্তী দশকগুলোর অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে একই সঙ্গে কর সংস্কার, রাষ্ট্রায়ত্ত খাত পুনর্গঠন ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কাঠামোগত সীমাবদ্ধতাও ছিল—যা অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে বাধা সৃষ্টি করেছে।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত