leadT1ad

হাইকমিশনারকে তলব: কূটনৈতিক ব্যাখ্যা ও সম্পর্কের নতুন সমীকরণ

প্রকাশ : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০: ০৪
স্ট্রিম গ্রাফিক

গত কয়েক দিন বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ছিল ঘটনাবহুল ও উত্তেজনাকর। কূটনীতির শান্ত জল হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে উঠেছে পাল্টাপাল্টি তলব ও কড়া বার্তা আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে। গত রোববার (১৪ ডিসেম্বর) ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর ঠিক তিন দিনের মাথায়, বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. রিয়াজ হামিদুল্লাহকে তলব করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ ও এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া ভিসা কেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থাকে জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়েছে।

সাধারণত বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকলে তা আলোচনার টেবিলে সমাধান করা হয়, কিন্তু রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনারকে তলব করার মতো ঘটনা কিছুটা বিরল ও তাৎপর্যপূর্ণ। এই ঘটনাপ্রবাহের কূটনৈতিক ব্যাখ্যা, এর নেপথ্যের কারণ ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ওপর এর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন।

হাইকমিশনারকে তলব করার প্রেক্ষাপট

গত ১৪ ডিসেম্বর রোববার সকালে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। এই তলবের মূল কারণ ছিল ভারতে অবস্থানরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্পষ্টভাবে অভিযোগ করে, ভারতে অবস্থান করে শেখ হাসিনা নিয়মিত উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা ও আসন্ন নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টার শামিল।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এই বিষয়কে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে উসকানি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং শেখ হাসিনাসহ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে দ্রুত দেশে ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানায়।

এর প্রতিক্রিয়ায় তিন দিন পর বুধবার দুপুরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহকে তলব করে। ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ‘ক্রমাবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি’ নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানানো হয়। একই সঙ্গে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা উল্লেখ করে কিছু ‘চরমপন্থী গোষ্ঠী’র হুমকির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। ভারত অভিযোগ করে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো নিয়ে ‘ভুয়া বয়ান’ বা ন্যারেটিভ তৈরির চেষ্টা চলছে। এর পরপরই নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশের ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রগুলো (আইভ্যাক) সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

কূটনীতিতে ‘তলব’ বা ‘সামন’

সাধারণ মানুষের চোখে মনে হতে পারে, রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাকা মানে হয়তো কোনো আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ। কিন্তু কূটনীতির পরিভাষায় ‘তলব’ বা ‘সামন’ করা বেশ গুরুতর ও সংবেদনশীল পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ‘প্রোটোকল’ অনুযায়ী, এমন পদক্ষেপ বন্ধুত্বের চেয়ে ‘অসন্তোষ’কেই বেশি প্রকাশ করে।

যখন একটি দেশ মনে করে যে অপর কোনো দেশের কর্মকাণ্ড তাদের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা বা সম্মানের ওপর আঘাত হেনেছে, তখন তারা কেবল সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে ক্ষান্ত হয় না। তারা সেই দেশের প্রতিনিধিকে সশরীরে হাজির হয়ে কৈফিয়ত দেওয়ার নির্দেশ দেয়। তলব করার সময় সুনির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার মন্ত্রণালয়ে পৌঁছানোর পর সাধারণত কোনো করমর্দন বা হাসিমুখের সম্ভাষণ বিনিময় হয় না। স্বাগতিক দেশ তাদের অভিযোগগুলো লিখিত আকারে, যাকে ‘নোট ভারবাল’ বা ‘প্রোটেস্ট নোট’ বলা হয়, রাষ্ট্রদূতের হাতে তুলে দেয়। এই প্রক্রিয়ার মূল বার্তা হলো—‘আমরা তোমাদের আচরণে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং এটি আমাদের রেড লাইন অতিক্রম করেছে।’ কূটনীতিতে তলব করার পরের ধাপই হলো রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করা বা নিজ দেশের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে আনা। অর্থাৎ, তলব করা হলো সম্পর্ক ছিন্নের ঠিক আগের ‘চূড়ান্ত সতর্কবার্তা’।

কেন তলব করা হয়: রেড লাইন অতিক্রমের সংকেত

রাষ্ট্রদূতকে তলব করার মতো কঠোর সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রগুলো হুট করে নেয় না। সাধারণত যখন পর্দার আড়ালের আলোচনা বা সাধারণ কূটনৈতিক চ্যানেলে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না, তখনই তলব করা হয়। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে থাকে—স্বাগতিক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি, গুপ্তচরবৃত্তি, সীমান্তে হত্যা বা আগ্রাসন এবং সেই দেশের নেতাদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অভিযোগ ছিল সুনির্দিষ্ট—ভারতে অবস্থানরত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব (শেখ হাসিনা) বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, যা ঢাকার দৃষ্টিতে ‘রেড লাইন’ বা সহনশীলতার সীমা অতিক্রম করেছে।

অন্যদিকে ভারত তাদের হাইকমিশনের নিরাপত্তা ও বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের কথিত পরিস্থিতির কথা বলে পাল্টা তলব করেছে। অর্থাৎ, যখনই কোনো রাষ্ট্র মনে করে তাদের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে, তখনই তারা তলবের মাধ্যমে অপর পক্ষকে সতর্ক করে।

বিশ্বজুড়ে তলবের কিছু আলোচিত নজির

হাইকমিশনার বা রাষ্ট্রদূতকে তলব করার ঘটনা কেবল বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বের পরাশক্তিগুলোও তাদের অসন্তোষ প্রকাশে এই হাতিয়ার ব্যবহার করে থাকে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন কিছু আলোচিত ঘটনা প্রমাণ করে এই পদক্ষেপ কতটা গুরুত্ব বহন করে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো যখন অভিযোগ করেন, শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যায় ভারত সরকারের হাত থাকতে পারে, তখন ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিকভাবে কানাডীয় হাইকমিশনার ক্যামেরন ম্যাককে-কে তলব করে। তাঁকে মাত্র কয়েক মিনিটের বৈঠকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, ভারত এই অভিযোগ সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করছে।

আবার ২০২২ সালে মার্কিন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে কেন্দ্র করে বেইজিংয়ে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকোলাস বার্নসকে গভীর রাতে জরুরি তলব করে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। চীনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী জি ফং তাঁকে ভর্ৎসনা করেন ও সতর্ক করেন, ‘আমেরিকাকে এই ভুলের চড়া মূল্য দিতে হবে।’

এছাড়া ২০২১ সালে তুরস্কের সমাজকর্মী ওসমান কাভালার মুক্তির দাবি জানানোয় ১০টি পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূতকে একসঙ্গে তলব করেছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান।

পাল্টাপাল্টি তলব বা ‘টিট ফর ট্যাট’ কূটনীতি

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘টিট ফর ট্যাট’ বা ‘ইটের বদলে পাটকেল’ নীতি বেশ পরিচিত কৌশল। বাংলাদেশ যখন ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ড নিয়ে কড়া বার্তা দিল, তখন কূটনৈতিক মহলে ধারণা করা হচ্ছিল ভারত এর প্রতিক্রিয়া দেখাবে। তিন দিনের মাথায় বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করা সেই প্রতিক্রিয়ারই অংশ।

ভারত এখানে দুটি কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রথমত, তারা বাংলাদেশের অভিযোগের সরাসরি উত্তর না দিয়ে পাল্টা অভিযোগ উত্থাপন করেছে। বাংলাদেশ যেখানে শেখ হাসিনার উসকানি ও নির্বাচন বানচালের কথা বলেছে, ভারত সেখানে হাইকমিশনের নিরাপত্তা ও চরমপন্থী গোষ্ঠীর হুমকির কথা সামনে এনেছে।

দ্বিতীয়ত, ভারত তাদের অসন্তোষের মাত্রা বোঝাতে ভিসা কেন্দ্র বন্ধ করার মতো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়েছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি ভারতের পক্ষ থেকে ‘কাউন্টার-প্রেশার’ বা পাল্টা চাপ সৃষ্টির কৌশল। ভারত বোঝাতে চাইছে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে তারাও সমান উদ্বিগ্ন এবং তারা একতরফা কোনো অভিযোগ মেনে নেবে না।

ভিসা কেন্দ্র বন্ধের প্রভাব

কূটনৈতিক এই টানাপোড়েনের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। ভারতের ভিসা কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হাজার হাজার বাংলাদেশি রোগী, শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীর জন্য বড় ধাক্কা। ভারত ‘নিরাপত্তা পরিস্থিতি’র কারণ হিসেবে দেখালেও, বিশ্লেষকেরা মনে করেন এটি কূটনৈতিক হাতিয়ার। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে চাপ সৃষ্টি করা ও সরকারকে বিপাকে ফেলা ভারতের লক্ষ্য হতে পারে। তবে এই ধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশের জনমনে ভারতবিরোধী মনোভাবকে আরও উসকুনি দিতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর।

ভবিষ্যৎ সম্পর্কের গতিপথ

বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত নিবিড়। কিন্তু সাম্প্রতিক এই পাল্টাপাল্টি তলব ও কঠোর ভাষা ব্যবহারের ঘটনা প্রমাণ করে, সম্পর্কের সেই ঐতিহাসিক আবেগ এখন আর কাজ করছে না। সম্পর্ক এখন সম্পূর্ণভাবে ‘বাস্তববাদী’ বা ‘রিয়ালপলিটিক’-এর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বৈঠকে বলেছেন, ভারত বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায় এবং সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। কিন্তু বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রত্যর্পণ না করলে সেই সহযোগিতার আশ্বাস কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

হাইকমিশনারদের তলব করার এই ঘটনা দুই দেশের সম্পর্কের গভীর আস্থার সংকটের বহিঃপ্রকাশ। সমাধানের পথ হলো খোলামেলা আলোচনা। ভারতকে বুঝতে হবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা পরিবর্তিত হয়েছে এবং ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশকে পুরোনো চশমায় দেখা সম্ভব নয়। আর বাংলাদেশকেও নিশ্চিত করতে হবে, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যুতে তারা সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব বজায় রাখছে। তলব ও পাল্টা তলবের এই অধ্যায় যদি দ্রুত সমাপ্ত না হয়, তবে দক্ষিণ এশিয়ার এই গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গভীর সংকটের দিকে ধাবিত হতে পারে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, প্রথম আলো, এনডিটিভি এবং দ্য প্রিন্ট।

Ad 300x250

সম্পর্কিত