leadT1ad

১৭১ বছরের উডবার্ন গণগ্রন্থাগার: বগুড়ায় হাতে লেখা পুঁথি আর দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহশালা

বগুড়া জেলার জ্ঞানপিপাসু মানুষের কাছে এটি এক সমৃদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডার। শত বছরের পুরোনো বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের দুর্লভ সব বই আর আধুনিক জ্ঞানচর্চার মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। গণমানুষের সংস্কৃতি চর্চা, মেধা ও মননের বিকাশে দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি।

প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮: ১১
গ্রন্থাগারের বর্তমান পাঠকক্ষ। সংগৃহীত ছবি

কাগজে দোয়াত-কালির আঁচড়। কয়েকশ বছরের পুরোনো সেই কালির রঙ হয়তো কিছুটা ফিকে হয়েছে, কিন্তু গুরুত্ব কমেনি এতটুকুও। প্রাচীন উপাখ্যান, হাতে লেখা পুঁথি আর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা হাজারো বইয়ের এক বিশাল রাজ্য। বলছিলাম বগুড়ার উডবার্ন সরকারি গণগ্রন্থাগারের কথা।

বগুড়া জেলার জ্ঞানপিপাসু মানুষের কাছে এটি এক সমৃদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডার। শত বছরের পুরোনো বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের দুর্লভ সব বই আর আধুনিক জ্ঞানচর্চার মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। গণমানুষের সংস্কৃতি চর্চা, মেধা ও মননের বিকাশে দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি।

১৮৫৪ থেকে আজকের উডবার্ন

এই লাইব্রেরির ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ। ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত ভারতের পূর্ব বাংলায় জ্ঞানচর্চার যে জোয়ার এসেছিল, তার ঢেউ লেগেছিল বগুড়াতেও। প্রায় পৌনে দুশ বছর আগে, ১৮৫৪ সালে বগুড়ার সাহিত্যপ্রেমীদের প্রচেষ্টায় করতোয়া নদীর তীরে প্রথম স্থাপিত হয় এই পাবলিক লাইব্রেরি।

প্রতিষ্ঠার ৫৪ বছর পর ঘটে একটি বিশেষ ঘটনা। ১৯০৮ সালে তৎকালীন জেলা কালেক্টরেট জে এন গুপ্ত লাইব্রেরিটির নামকরণের উদ্যোগ নেন। তদানীন্তন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জন উডবার্নের নামানুসারে এর নাম রাখা হয় ‘উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি’। সেই থেকে এটি এই নামেই পরিচিত।

উডবার্ন গণগ্রন্থাগার। সংগৃহীত ছবি
উডবার্ন গণগ্রন্থাগার। সংগৃহীত ছবি

তবে এই দীর্ঘ পথচলা মসৃণ ছিল না। ১৯৩০ সালে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে লাইব্রেরিটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুড়ে যায় অনেক বই। এরপর বগুড়ার নবাব পরিবারের সহযোগিতায় এটি স্থানান্তর করা হয় অ্যাডওয়ার্ড পার্কের ভেতরে।

১৯৪৭ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর বড় ভাই শরৎ চন্দ্র বসুসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি এই উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরিতে এসেছেন। ১৯৮৪ সালে এটি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের আওতায় আসে এবং নামকরণ হয় ‘উডবার্ন সরকারি গণগ্রন্থাগার’। সর্বশেষ ২০১৩ সালে এটি পার্কের সেউজগাড়ি সড়কের ধারের বর্তমান বহুতল ভবনে স্থানান্তরিত হয়।

হাতে লেখা পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি

লাইব্রেরিতে ঢুকলেই চোখে পড়ে ইতিহাসের ছাপ। লাইব্রেরির ক্যাটালগ অনুযায়ী, এখানে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ বছরের পুরোনো দুর্লভ বই সংরক্ষিত ছিল। স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় কিছু বই নষ্ট বা হারিয়ে গেলেও, এখনো প্রায় ৮ হাজারের বেশি প্রাচীন বই টিকে আছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে গ্রন্থাগারটিতে বইয়ের সংখ্যা ৫৬ হাজারেরও বেশি।

লাইব্রেরি সহকারী আনিসুল হকের তথ্যমতে, এখানে এমন কিছু বই ও পাণ্ডুলিপি আছে যা সচরাচর চোখে পড়ে না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: হাতে লেখা পুঁথি ‘গোবিন্দ কথামৃত গুণকীর্তন উপাখ্যান’; হস্তলিখিত পুঁথি ও উপন্যাস ‘পদ্মপুরাণ’; হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ‘মনসাদেবীর উপাখ্যান’; সংস্কৃত ভাষার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি।

জ্ঞানপিপাসুদের জন্য লাইব্রেরিটি সপ্তাহে পাঁচ দিন খোলা থাকে। শনিবার থেকে বুধবার পর্যন্ত সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে চলে কার্যক্রম। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হিসেবে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার লাইব্রেরি বন্ধ থাকে।

এছাড়া বিশ্বখ্যাত এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকার সব খণ্ড, এইচ জি ওয়েলসের ‘ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’, টয়েনবির ‘হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ এবং অসমের প্রাচীন গেজেটসহ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রির বেশ কয়েকটি পুরোনো গেজেট সংরক্ষিত আছে এখানে। বিশ্বের বরেণ্য লেখকদের বইয়ের এক বিশাল সমাহার এই লাইব্রেরি।

লাইব্রেরি ভবনটির নিচতলায় রয়েছে মিলনায়তন। দোতলা ও তিনতলায় রয়েছে বিশাল পাঠ কক্ষ, যেখানে পাঠকরা নিবিষ্ট মনে বই পড়েন। আর চতুর্থ তলায় রয়েছে বইয়ের মজুত বা স্টোরেজ। প্রতিবছর গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর থেকে এখানে নতুন নতুন বই পাঠানো হয়, ফলে পুরোনো সংগ্রহের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন বইও।

পাঠকদের পদচারণায় মুখর প্রাঙ্গণ

প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০ পাঠক লাইব্রেরিতে এসে পড়াশোনা করেন। এখানে শুধু বয়োজ্যেষ্ঠরাই নন, ভিড় করেন তরুণ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরাও।

লাইব্রেরিতে নিয়মিত পড়তে আসা কলেজ শিক্ষার্থী রবিউল করিম বলেন, ‘এখানে অনেক পুরোনো লেখকদের বই যেমন পাওয়া যায়, তেমনি নতুন লেখকদের বইও। এমন পরিবেশ সচরাচর পাওয়া যায় না।’

কলেজ শিক্ষক অরুপ রতন এই লাইব্রেরিটিকে ‘সমৃদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডার’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিজ্ঞানসহ আধুনিক তথ্যসমৃদ্ধ এত বইয়ের সম্ভার আর কোথাও নেই।’

চাকরিপ্রার্থী আহসানুল করিম জানান, চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য ও বই তিনি এখান থেকেই সংগ্রহ করেন। সিনিয়র লাইব্রেরিয়ান রেমিনা জান্নাত জানান, বর্তমানে লাইব্রেরিতে ৩৮৮ জন নিবন্ধিত সদস্য রয়েছেন। সাধারণ পাঠক, ছাত্রছাত্রী এবং শিশু—এই তিন ক্যাটাগরিতে বাৎসরিক ফি দিয়ে সদস্য হওয়া যায়। বই বাসায় নিয়ে পড়ার সুযোগ থাকে।

সময়সূচি

জ্ঞানপিপাসুদের জন্য লাইব্রেরিটি সপ্তাহে পাঁচ দিন খোলা থাকে। শনিবার থেকে বুধবার পর্যন্ত সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে চলে কার্যক্রম। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হিসেবে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার লাইব্রেরি বন্ধ থাকে।

নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের এই অমূল্য সম্পদ তুলে ধরতে এবং মেধাভিত্তিক সমাজ গড়তে এই লাইব্রেরিটি বাতিঘর হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন লাইব্রেরি সংশ্লিষ্টরা।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত