২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকাই মসলিন বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে ‘জিআই’ স্বীকৃতি সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়েছিল। একসময় বিশ্বজুড়ে ঢাকাই মসলিনের ছিল একচেটিয়া কদর।
ফাবিহা বিনতে হক

বাংলার ইতিহাসের এক সোনালী অধ্যায়ের নাম মসলিন। একসময় বিশ্বজুড়ে ঢাকাই মসলিনের ছিল একচেটিয়া কদর। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, বিশেষ করে ১৮৫১ সালের লন্ডনের গ্রেট এক্সিবিশনে ঢাকাই মসলিন প্রদর্শিত হয়েছিল। এর ঠিক ১৭০ বছর পর বাংলাদেশে আবার বুনন শুরু হয় মসলিনের। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকাই মসলিন বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে ‘জিআই’ স্বীকৃতি সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়েছিল।
চলুন জেনে আসি মসলিন বুননের সমৃদ্ধ ইতিহাস, এর বৈশিষ্ট্য আর কী কারণে দীর্ঘকাল মসলিন বুনন থেকে সরে গিয়েছিল তাঁতীরা।
মসলিন তৈরির প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল। এর মূল উপাদান ‘ফুটি কার্পাস’ নামের এক বিশেষ জাতের তুলা, যা মেঘনা নদীর তীরের পলিমাটিতে জন্মাত। এই তুলা থেকে সুতা কাটার কাজটি ছিল সবচেয়ে কঠিন। এই সুতা এতটাই সূক্ষ্ম ছিল যে বেশি রোদে বা শুষ্ক আবহাওয়ায় তা ছিঁড়ে যেত। তাই কারিগররা ভোরে বা বিকেলে আর্দ্র আবহাওয়ায় এই সুতা কাটতেন।
চরকা দিয়ে কাটা কিংবা হাতে বোনা মসলিনের জন্য সর্বনিম্ন তিন শ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হতো। এর ফলে মসলিন কাপড়টি দেখাত একদম স্বচ্ছ কাচের মতো। ঢাকার কাছের সোনারগাঁ অঞ্চলে তৈরি করা হতো এই মসলিন কাপড়।

দেখতে সুন্দর হলেও অতি সূক্ষ্ম মসলিন তৈরি করা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। তাঁতিদের দিনে প্রায় আট দশ ঘণ্টা কাজ করে মসলিন তৈরি করতে হতো। কাজ সহজ করার জন্য মসলিন তৈরিতে তাঁতিরা তিনজন মিলে একটি দল গঠন করে নিত। এই তিনজনের মধ্যে একজন ওস্তাদ, একজন সহকারী এবং আরেকজন কারিগর হিসেবে কাজ করত।
আর ১০-১২ বছর বয়সী শিশুরা মসলিন তৈরিতে নিকারি হিসেবে কাজ করতে পারত। অর্থাৎ সরাসরি মজুরি ছাড়া শুধু খাবার ও থাকার জায়গাই পেত শিশুরা। তিন-চার বছর কাজ করার পর তাদের মজুরি দেওয়া শুরু হতো।
গবেষকদের মতে, মূল্যবান এই কাপড়ের ধরন আছে প্রায় ২৮ রকমের। তবে এর মধ্যে জামদানি এখনও বেশ প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু নানা কারণে আনুমানিক আঠারো শতকের শেষে বাংলায় এই মসলিনের বুনন বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণত মসলিনের পার্থক্য করা হতো এর সূক্ষ্মতা, বুনন শৈলী ও নকশার ভিত্তিতে। একেক কারণে এর প্রকারভেদও আলাদা আলাদা নামের হয়।
মলবুস খাস: মলবুস খাসের অর্থ হচ্ছে খাস বা রাজকীয় বস্ত্র। সব ধরনের মসলিনের মধ্যে এই মসলিন সবচেয়ে বেশি দামি ছিল যা ব্যবহার করতেন প্রাচীন সম্রাটরা। এই মসলিন এতটাই পাতলা ছিল যে কথিত আছে, পুরো কাপড় অনায়াসেই একটি আংটির ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া যেত। বিদেশে রপ্তানি হওয়া মসলিনগুলোর মধ্যেও এটি ছিল সবচেয়ে মূল্যবান।
সরকার-ই-আলা: মলবুসের মতো এই মসলিনও বেশ উঁচুমানের ছিল। এই মসলিন তৈরি হতো সাধারণত বাংলার তৎকালীন নবাব বা সুবেদারদের জন্য। রাজকোষ বা সরকারি খাজনা থেকে এর মূল্য পরিশোধ করা হতো বলে এই নামের প্রচলন ঘটে।

ঝুনা: ঝুনা শব্দটি উঠে এসেছে হিন্দি শব্দ ‘ঝিনা’ থেকে, যার অর্থ সূক্ষ্ম। অন্যান্য মসলিনের তুলনায় এর সুতার পরিমাণ বেশ কম থাকত যার কারণে এই মসলিনটি দেখতে বেশ পাতলা ও স্বচ্ছ। শোনা যায়, এই মসলিন কখনোই বাইরে রপ্তানি করা হয়নি। এটি পাঠানো হতো রাজদরবারে। রাজদরবারের মহিলারা এই মসলিনের কাপড় গরমকালে ব্যবহার করতেন।
আব-ই-রওয়ান: আব-ই-রওয়ান ফার্সি শব্দ, যার অর্থ প্রবাহিত পানি। মসলিনের এমন নামকরণের কারণ হচ্ছে এটির কাপড় বেশ সূক্ষ্ম। এই মসলিনের ব্যাপারে বেশ কিছু গল্প প্রচলিত আছে যার মধ্যে একটি খুবই জনপ্রিয়। শোনা যায়, একবার সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে তাঁর মেয়ে উপস্থিত হলে তিনি বেশ রাগ করেই মেয়েকে বলেন, তাঁর কি কাপড়ের অভাব রয়েছে? তখন সম্রাটের মেয়ে বেশ আশ্চর্য হয়ে বলেন, তিনি আব-ই-রওয়ান মসলিনের কাপড়টি সাত ভাঁজ করে পরে আছেন। এই গল্প থেকেই আন্দাজ করা যায়, আব-ই-রওয়ান মসলিন কতটা সূক্ষ্ম ও স্বচ্ছ ছিল।
খাসসা: এই শব্দটিও ফার্সি শব্দ। এই মসলিন মিহি ও সূক্ষ্ম তবে এর বুনন বেশ ঘন।
আনুমানিক ১৭ শতকের দিকে সোনারগাঁ বিখ্যাত হয় এই খাসসা কাপড়ের জন্য। পরবর্তী সময়ে ১৮-১৯ শতকের দিকে জঙ্গলবাড়ি অঞ্চলটিও বিখ্যাত হয় এই খাসসার জন্য। ইংরেজরা একে ডাকত কুষা বলে।
শবনম: শবনম শব্দের অর্থ ভোরের শিশির। এক প্রকার মসলিন তৈরি হতো যা শিশিরভেজা ঘাসে শুকাতে দেওয়া হলে তা আর দেখাই যেত না। এই মসলিনই শবনম মসলিন। মসলিনের এই রকমটি ছিল খুবই মিহি আর সূক্ষ্ম।
নয়ন সুখ: এই মসলিন ব্যবহার করা হতো গলার রুমাল হিসেবে। সব মসলিনের মধ্যে কেবল এটিই বাংলা নামে নামকরণ করা হয়েছে।
বদন খাস: বদন খাস মসলিন ব্যবহার হতো শুধু গায়ে পরা জামার জন্য। তাই এর নামও বদন খাস। অন্যান্য মসলিনের মতো এই মসলিনের বুনন ততটা ঘন ছিল না।
জামদানি: জামদানি মসলিনের উত্তরাধিকারী হলেও এটি সরাসরি তৈরি হতো না; বরং মসলিনের ওপর নকশা করে তৈরি করা হতো। আজ জামদানি বলতে আমরা মূলত শাড়ি বুঝলেও ১৭ শতকে এই নকশা করা মসলিন দিয়ে শেরওয়ানিও বানানো হতো। আধুনিক জামদানির সঙ্গে ঐতিহাসিক জামদানির এখানেই মূল পার্থক্য।
সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ ও ডাচ বণিকরা লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতে আসতে শুরু করেন। তাঁরাই মূলত বাংলার মসলিনকে বিশ্ববাণিজ্যের নতুন পথে নিয়ে যান। সে সময় বাংলা থেকে মসলিনসহ অন্যান্য পণ্য সংগ্রহ করে সুদূর সিরিয়া পর্যন্ত বিক্রি হতো। মসলিনের কদর যে কত ব্যাপক ছিল, তার প্রমাণ মেলে ইস্তাম্বুলে। সেখানকার একটি সরকারি গুদামে আনুমানিক ১৬৪০ সালের প্রায় ২০ ধরনের মসলিন পাওয়া গেছে। মূলত চড়া দাম এবং বিশ্বজুড়ে ব্যাপক চাহিদার কারণেই ধীরে ধীরে মসলিন বাণিজ্যের এই প্রসার ঘটতে থাকে।

পরবর্তী সময়ে ‘অস্টেন্ড কোম্পানি’ও বাংলায় বাণিজ্য করতে আসে। লাভের মুখ দেখায় এই কোম্পানির কর্মকর্তারা একপর্যায়ে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন এবং সরাসরি তাঁতিদের কাছ থেকে বস্ত্র সংগ্রহ করতে থাকেন। মসলিন বাণিজ্যের তৎকালীন রমরমা অবস্থা বোঝা যায় ১৭৪৭ সালের একটি পরিসংখ্যানে, সে বছর শুধুমাত্র ঢাকা থেকেই মসলিনসহ বস্ত্রশিল্পের বাণিজ্যের মূল্য ছিল প্রায় সাড়ে ২৮ লাখ টাকা।
মোগল আমল থেকে ব্রিটিশ শাসন পর্যন্ত মসলিন ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে রাজত্ব করেছে। রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে ফ্রান্সের সম্রাজ্ঞী জোসেফাইন এবং ইংল্যান্ডের অভিজাত নারীদের কাছে ঢাকাই মসলিন ছিল স্বপ্নের পোশাক।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে মেশিনে তৈরি সস্তা সুতি কাপড়ের শিল্প গড়ে ওঠে। কিন্তু ঢাকাই মসলিনের মানের কাছে তাদের কাপড় টিকতে পারছিল না। তাই নিজেদের বাজার বাঁচাতে ব্রিটিশরা মসলিনের ওপর চড়াও হয়।
ব্রিটিশরা বিলেতের বাজারে মসলিন আমদানির ওপর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত চড়া শুল্ক বা ট্যাক্স বসিয়ে দেয়, যাতে সাধারণ মানুষ আর মসলিন কিনতে না পারে। অন্যদিকে, তাঁতিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় ‘দাদন’ প্রথা ও অমানবিক নির্যাতন।
এই দাদন প্রথাটি হলো, কোম্পানির দালাল বা ‘গোমস্তা’রা তাঁতিদের জোর করে অগ্রিম টাকা বা দাদন গছিয়ে দিত। নিয়ম ছিল, একবার দাদন নিলে সেই তাঁতি আর অন্য কোনো ব্যবসায়ীর কাছে কাপড় বিক্রি করতে পারবে না। কিন্তু কোম্পানি মসলিনের যে দাম নির্ধারণ করত, তা ছিল উৎপাদন খরচের চেয়েও কম। কোন কারণে কাপড় দিতে দেরি হলে বা রাজি না হলে তাদের ওপর চলত চাবুক মারা, আটক রাখা ও অমানবিক নির্যাতন।
লোকমুখে প্রচলিত আছে, দক্ষ তাঁতিরা যাতে আর মসলিন বুনতে না পারেন, সেজন্য তাঁদের হাতের বুড়ো আঙুল কেটে দেওয়া হতো। আবার কেউ কেউ বলেন, ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে তাঁতিরা নিজেরাই নিজেদের আঙুল জখম করতেন।
এছাড়া মসলিনের প্রাণ ‘ফুটি কার্পাস’ তুলার চাষও জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পরবর্তে ‘নীল’ চাষ ও অন্য ফসল ফলাতে বাধ্য করে ব্রিটিশরা। ধীরে ধীরে চাষের অভাবে ফুটি কার্পাস গাছটিই বাংলা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এছাড়া, ১৭৪২-১৭৮৭ সালে ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব শুরু হলে স্থানীয়ভাবে তুলা উৎপাদন করা শুরু হতে থাকে। আর ব্রিটেন থেকে তুলা আমদানি করার কারণে মসলিন শিল্প এক সময় হারিয়ে যায়।
এর মধ্যে শস্য রপ্তানির ওপর এক সময় ট্যাক্স প্রত্যাহার করে নিলে মানুষ মসলিন তাঁত ছেড়ে চাষের দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠতে শুরু করে। তাছাড়া মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে ভয়াবহ বন্যা, দুর্ভিক্ষের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বাংলা। এভাবেই ধীরে ধীরে বাংলার বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় ঐতিহ্যবাহী মসলিন কাপড়ে।
তবে আশার কথা হলো, দীর্ঘ গবেষণার পর বাংলাদেশে আবারও সেই ফুটি কার্পাস তুলা চাষ করে মসলিন তৈরির প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার মাধ্যমে মসলিন এখন আইনগতভাবেই বাংলাদেশের, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের।

বাংলার ইতিহাসের এক সোনালী অধ্যায়ের নাম মসলিন। একসময় বিশ্বজুড়ে ঢাকাই মসলিনের ছিল একচেটিয়া কদর। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, বিশেষ করে ১৮৫১ সালের লন্ডনের গ্রেট এক্সিবিশনে ঢাকাই মসলিন প্রদর্শিত হয়েছিল। এর ঠিক ১৭০ বছর পর বাংলাদেশে আবার বুনন শুরু হয় মসলিনের। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকাই মসলিন বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে ‘জিআই’ স্বীকৃতি সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়েছিল।
চলুন জেনে আসি মসলিন বুননের সমৃদ্ধ ইতিহাস, এর বৈশিষ্ট্য আর কী কারণে দীর্ঘকাল মসলিন বুনন থেকে সরে গিয়েছিল তাঁতীরা।
মসলিন তৈরির প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল। এর মূল উপাদান ‘ফুটি কার্পাস’ নামের এক বিশেষ জাতের তুলা, যা মেঘনা নদীর তীরের পলিমাটিতে জন্মাত। এই তুলা থেকে সুতা কাটার কাজটি ছিল সবচেয়ে কঠিন। এই সুতা এতটাই সূক্ষ্ম ছিল যে বেশি রোদে বা শুষ্ক আবহাওয়ায় তা ছিঁড়ে যেত। তাই কারিগররা ভোরে বা বিকেলে আর্দ্র আবহাওয়ায় এই সুতা কাটতেন।
চরকা দিয়ে কাটা কিংবা হাতে বোনা মসলিনের জন্য সর্বনিম্ন তিন শ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হতো। এর ফলে মসলিন কাপড়টি দেখাত একদম স্বচ্ছ কাচের মতো। ঢাকার কাছের সোনারগাঁ অঞ্চলে তৈরি করা হতো এই মসলিন কাপড়।

দেখতে সুন্দর হলেও অতি সূক্ষ্ম মসলিন তৈরি করা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। তাঁতিদের দিনে প্রায় আট দশ ঘণ্টা কাজ করে মসলিন তৈরি করতে হতো। কাজ সহজ করার জন্য মসলিন তৈরিতে তাঁতিরা তিনজন মিলে একটি দল গঠন করে নিত। এই তিনজনের মধ্যে একজন ওস্তাদ, একজন সহকারী এবং আরেকজন কারিগর হিসেবে কাজ করত।
আর ১০-১২ বছর বয়সী শিশুরা মসলিন তৈরিতে নিকারি হিসেবে কাজ করতে পারত। অর্থাৎ সরাসরি মজুরি ছাড়া শুধু খাবার ও থাকার জায়গাই পেত শিশুরা। তিন-চার বছর কাজ করার পর তাদের মজুরি দেওয়া শুরু হতো।
গবেষকদের মতে, মূল্যবান এই কাপড়ের ধরন আছে প্রায় ২৮ রকমের। তবে এর মধ্যে জামদানি এখনও বেশ প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু নানা কারণে আনুমানিক আঠারো শতকের শেষে বাংলায় এই মসলিনের বুনন বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণত মসলিনের পার্থক্য করা হতো এর সূক্ষ্মতা, বুনন শৈলী ও নকশার ভিত্তিতে। একেক কারণে এর প্রকারভেদও আলাদা আলাদা নামের হয়।
মলবুস খাস: মলবুস খাসের অর্থ হচ্ছে খাস বা রাজকীয় বস্ত্র। সব ধরনের মসলিনের মধ্যে এই মসলিন সবচেয়ে বেশি দামি ছিল যা ব্যবহার করতেন প্রাচীন সম্রাটরা। এই মসলিন এতটাই পাতলা ছিল যে কথিত আছে, পুরো কাপড় অনায়াসেই একটি আংটির ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া যেত। বিদেশে রপ্তানি হওয়া মসলিনগুলোর মধ্যেও এটি ছিল সবচেয়ে মূল্যবান।
সরকার-ই-আলা: মলবুসের মতো এই মসলিনও বেশ উঁচুমানের ছিল। এই মসলিন তৈরি হতো সাধারণত বাংলার তৎকালীন নবাব বা সুবেদারদের জন্য। রাজকোষ বা সরকারি খাজনা থেকে এর মূল্য পরিশোধ করা হতো বলে এই নামের প্রচলন ঘটে।

ঝুনা: ঝুনা শব্দটি উঠে এসেছে হিন্দি শব্দ ‘ঝিনা’ থেকে, যার অর্থ সূক্ষ্ম। অন্যান্য মসলিনের তুলনায় এর সুতার পরিমাণ বেশ কম থাকত যার কারণে এই মসলিনটি দেখতে বেশ পাতলা ও স্বচ্ছ। শোনা যায়, এই মসলিন কখনোই বাইরে রপ্তানি করা হয়নি। এটি পাঠানো হতো রাজদরবারে। রাজদরবারের মহিলারা এই মসলিনের কাপড় গরমকালে ব্যবহার করতেন।
আব-ই-রওয়ান: আব-ই-রওয়ান ফার্সি শব্দ, যার অর্থ প্রবাহিত পানি। মসলিনের এমন নামকরণের কারণ হচ্ছে এটির কাপড় বেশ সূক্ষ্ম। এই মসলিনের ব্যাপারে বেশ কিছু গল্প প্রচলিত আছে যার মধ্যে একটি খুবই জনপ্রিয়। শোনা যায়, একবার সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে তাঁর মেয়ে উপস্থিত হলে তিনি বেশ রাগ করেই মেয়েকে বলেন, তাঁর কি কাপড়ের অভাব রয়েছে? তখন সম্রাটের মেয়ে বেশ আশ্চর্য হয়ে বলেন, তিনি আব-ই-রওয়ান মসলিনের কাপড়টি সাত ভাঁজ করে পরে আছেন। এই গল্প থেকেই আন্দাজ করা যায়, আব-ই-রওয়ান মসলিন কতটা সূক্ষ্ম ও স্বচ্ছ ছিল।
খাসসা: এই শব্দটিও ফার্সি শব্দ। এই মসলিন মিহি ও সূক্ষ্ম তবে এর বুনন বেশ ঘন।
আনুমানিক ১৭ শতকের দিকে সোনারগাঁ বিখ্যাত হয় এই খাসসা কাপড়ের জন্য। পরবর্তী সময়ে ১৮-১৯ শতকের দিকে জঙ্গলবাড়ি অঞ্চলটিও বিখ্যাত হয় এই খাসসার জন্য। ইংরেজরা একে ডাকত কুষা বলে।
শবনম: শবনম শব্দের অর্থ ভোরের শিশির। এক প্রকার মসলিন তৈরি হতো যা শিশিরভেজা ঘাসে শুকাতে দেওয়া হলে তা আর দেখাই যেত না। এই মসলিনই শবনম মসলিন। মসলিনের এই রকমটি ছিল খুবই মিহি আর সূক্ষ্ম।
নয়ন সুখ: এই মসলিন ব্যবহার করা হতো গলার রুমাল হিসেবে। সব মসলিনের মধ্যে কেবল এটিই বাংলা নামে নামকরণ করা হয়েছে।
বদন খাস: বদন খাস মসলিন ব্যবহার হতো শুধু গায়ে পরা জামার জন্য। তাই এর নামও বদন খাস। অন্যান্য মসলিনের মতো এই মসলিনের বুনন ততটা ঘন ছিল না।
জামদানি: জামদানি মসলিনের উত্তরাধিকারী হলেও এটি সরাসরি তৈরি হতো না; বরং মসলিনের ওপর নকশা করে তৈরি করা হতো। আজ জামদানি বলতে আমরা মূলত শাড়ি বুঝলেও ১৭ শতকে এই নকশা করা মসলিন দিয়ে শেরওয়ানিও বানানো হতো। আধুনিক জামদানির সঙ্গে ঐতিহাসিক জামদানির এখানেই মূল পার্থক্য।
সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ ও ডাচ বণিকরা লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতে আসতে শুরু করেন। তাঁরাই মূলত বাংলার মসলিনকে বিশ্ববাণিজ্যের নতুন পথে নিয়ে যান। সে সময় বাংলা থেকে মসলিনসহ অন্যান্য পণ্য সংগ্রহ করে সুদূর সিরিয়া পর্যন্ত বিক্রি হতো। মসলিনের কদর যে কত ব্যাপক ছিল, তার প্রমাণ মেলে ইস্তাম্বুলে। সেখানকার একটি সরকারি গুদামে আনুমানিক ১৬৪০ সালের প্রায় ২০ ধরনের মসলিন পাওয়া গেছে। মূলত চড়া দাম এবং বিশ্বজুড়ে ব্যাপক চাহিদার কারণেই ধীরে ধীরে মসলিন বাণিজ্যের এই প্রসার ঘটতে থাকে।

পরবর্তী সময়ে ‘অস্টেন্ড কোম্পানি’ও বাংলায় বাণিজ্য করতে আসে। লাভের মুখ দেখায় এই কোম্পানির কর্মকর্তারা একপর্যায়ে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন এবং সরাসরি তাঁতিদের কাছ থেকে বস্ত্র সংগ্রহ করতে থাকেন। মসলিন বাণিজ্যের তৎকালীন রমরমা অবস্থা বোঝা যায় ১৭৪৭ সালের একটি পরিসংখ্যানে, সে বছর শুধুমাত্র ঢাকা থেকেই মসলিনসহ বস্ত্রশিল্পের বাণিজ্যের মূল্য ছিল প্রায় সাড়ে ২৮ লাখ টাকা।
মোগল আমল থেকে ব্রিটিশ শাসন পর্যন্ত মসলিন ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে রাজত্ব করেছে। রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে ফ্রান্সের সম্রাজ্ঞী জোসেফাইন এবং ইংল্যান্ডের অভিজাত নারীদের কাছে ঢাকাই মসলিন ছিল স্বপ্নের পোশাক।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে মেশিনে তৈরি সস্তা সুতি কাপড়ের শিল্প গড়ে ওঠে। কিন্তু ঢাকাই মসলিনের মানের কাছে তাদের কাপড় টিকতে পারছিল না। তাই নিজেদের বাজার বাঁচাতে ব্রিটিশরা মসলিনের ওপর চড়াও হয়।
ব্রিটিশরা বিলেতের বাজারে মসলিন আমদানির ওপর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত চড়া শুল্ক বা ট্যাক্স বসিয়ে দেয়, যাতে সাধারণ মানুষ আর মসলিন কিনতে না পারে। অন্যদিকে, তাঁতিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় ‘দাদন’ প্রথা ও অমানবিক নির্যাতন।
এই দাদন প্রথাটি হলো, কোম্পানির দালাল বা ‘গোমস্তা’রা তাঁতিদের জোর করে অগ্রিম টাকা বা দাদন গছিয়ে দিত। নিয়ম ছিল, একবার দাদন নিলে সেই তাঁতি আর অন্য কোনো ব্যবসায়ীর কাছে কাপড় বিক্রি করতে পারবে না। কিন্তু কোম্পানি মসলিনের যে দাম নির্ধারণ করত, তা ছিল উৎপাদন খরচের চেয়েও কম। কোন কারণে কাপড় দিতে দেরি হলে বা রাজি না হলে তাদের ওপর চলত চাবুক মারা, আটক রাখা ও অমানবিক নির্যাতন।
লোকমুখে প্রচলিত আছে, দক্ষ তাঁতিরা যাতে আর মসলিন বুনতে না পারেন, সেজন্য তাঁদের হাতের বুড়ো আঙুল কেটে দেওয়া হতো। আবার কেউ কেউ বলেন, ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে তাঁতিরা নিজেরাই নিজেদের আঙুল জখম করতেন।
এছাড়া মসলিনের প্রাণ ‘ফুটি কার্পাস’ তুলার চাষও জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পরবর্তে ‘নীল’ চাষ ও অন্য ফসল ফলাতে বাধ্য করে ব্রিটিশরা। ধীরে ধীরে চাষের অভাবে ফুটি কার্পাস গাছটিই বাংলা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এছাড়া, ১৭৪২-১৭৮৭ সালে ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব শুরু হলে স্থানীয়ভাবে তুলা উৎপাদন করা শুরু হতে থাকে। আর ব্রিটেন থেকে তুলা আমদানি করার কারণে মসলিন শিল্প এক সময় হারিয়ে যায়।
এর মধ্যে শস্য রপ্তানির ওপর এক সময় ট্যাক্স প্রত্যাহার করে নিলে মানুষ মসলিন তাঁত ছেড়ে চাষের দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠতে শুরু করে। তাছাড়া মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে ভয়াবহ বন্যা, দুর্ভিক্ষের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বাংলা। এভাবেই ধীরে ধীরে বাংলার বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় ঐতিহ্যবাহী মসলিন কাপড়ে।
তবে আশার কথা হলো, দীর্ঘ গবেষণার পর বাংলাদেশে আবারও সেই ফুটি কার্পাস তুলা চাষ করে মসলিন তৈরির প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার মাধ্যমে মসলিন এখন আইনগতভাবেই বাংলাদেশের, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের।

ট্রেলার ভাইরাল, পোস্টার ঝলমলে আর নামী তারকার সারি। ছিল হাই বাজেট, বড় স্টুডিও আর ‘বছরের সেরা’ হওয়ার আত্মবিশ্বাসও। কিন্তু পর্দায় আলো জ্বলার পর বাস্তবতা ছিল একেবারেই ভিন্ন। ২০২৫ সালে হলিউডে কিছু সিনেমা আক্ষরিক অর্থেই হাইপের পাহাড় গড়ে তুলেছিল, কিন্তু বক্স অফিসে গিয়ে সেগুলো দাঁড়াতে পারেনি। চলুন দেখে নেওয়
২৫ মিনিট আগে
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা আমাদের নিজস্ব চিন্তাশক্তি বা ‘ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং’-এর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
৯ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব অনেক বেশি। যেমন—প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপির হাল ধরেন তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পর দলের হাল ধরেছেন পুত্র তারেক রহমান।
১ দিন আগে
আজ বলিউডের ‘ভাইজান’ সালমান খানের ৬০তম জন্মদিন। তিন দশকের বেশি সময় ধরে পর্দায় রোমান্স আর অ্যাকশনের মাধ্যমে দর্শকদের মন জয় করে চলেছেন এই তারকা।
১ দিন আগে