১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ব রাজনীতির পরাশক্তিগুলোর ভূমিকা ছিল স্পষ্ট ও বিভাজিত। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের পাশে। এই দুই মেরুর মাঝখানে যুক্তরাজ্যের অবস্থান ছিল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ সরকার ছিল কূটনৈতিকভাবে সতর্ক ও ধীরস্থির। কিন্তু ব্রিটিশ জনগণ, গণমাধ্যম ও রাজনীতিবিদদের একটি বড় অংশ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার।
ব্রিটিশ সরকারের কূটনৈতিক সতর্কতা
১৯৭১ সালে ব্রিটেনে ক্ষমতায় ছিল এডওয়ার্ড হিথের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি। স্নায়ুযুদ্ধের সেই উত্তাল সময়ে পাকিস্তান ছিল পশ্চিমা ব্লকের অন্যতম মিত্র এবং সেন্টো ও সিয়াটো জোটের সদস্য। ফলে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে সরাসরি পাকিস্তানের বিরোধিতা করা বা ভেঙে যাওয়া পূর্ব পাকিস্তানকে (বাংলাদেশকে) সমর্থন দেওয়া সহজ ছিল না।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের নথিপত্র ও তৎকালীন কূটনৈতিক বিশ্লেষণগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ব্রিটিশ সরকার শুরুতে এই সংঘাতকে পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসেবে দেখার চেষ্টা করেছিল।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো যুক্তরাজ্য অন্ধভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়নি। তারা বরং মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছিল। নিক্সন প্রশাসন যখন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছিল, ব্রিটেন তখন পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল নিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার তখন কমনওয়েলথ ও জাতিসংঘের মাধ্যমে সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দিচ্ছিল। যদিও সরকারিভাবে তারা নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তারা লন্ডনে প্রবাসী বাঙালিদের আন্দোলন বা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কূটনৈতিক তৎপরতায় কোনো বাধা সৃষ্টি করেনি। এই ‘দেখে যাও’ নীতি কার্যত বাংলাদেশের পক্ষেই কাজ করেছিল বলে মনে করেন অনেক ইতিহাসবিদ।
লন্ডন: বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কেন্দ্র
মুক্তিযুদ্ধের সময় বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন ও কূটনৈতিক তৎপরতার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল লন্ডন। আর এই কর্মযজ্ঞের প্রধান কারিগর ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। ১৯৭১ সালের মার্চে তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগ দিতে জেনেভায় অবস্থান করছিলেন। সেখানে ২৫শে মার্চের কালরাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক হত্যার খবর পান।
প্রতিবাদস্বরূপ আবু সাঈদ পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। জেনেভা থেকে পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক শিক্ষা সচিবের কাছে পাঠানো পদত্যাগপত্রে তিনি লেখেন, ‘আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম।’ এরপর তিনি মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে লন্ডনে পাড়ি জমান।
লন্ডনে পৌঁছে তিনি প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠিত করতে ‘স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য অ্যাকশন কমিটিজ ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ’ গঠন করেন। এই কমিটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি, মুক্তিযুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহ ও বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন মিশনে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিকদের পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকারে উদ্বুদ্ধ করা হতো এই লন্ডন থেকেই। ব্রিটিশ সরকার তখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলেও, তাদের মাটিতে বসে এই বিশাল কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর সুযোগ দেওয়াটা ছিল বাংলাদেশের প্রতি তাদের পরোক্ষ সমর্থনেরই বহিঃপ্রকাশ।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম ও জনমত গঠনের লড়াই
মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় ও সম্ভবত সবচেয়ে কার্যকর অবদান ছিল তাদের গণমাধ্যমের ভূমিকা। বিশেষ করে বিবিসি ও ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলো পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতাকে বিশ্বমঞ্চে উন্মোচিত করে দিয়েছিল। বিবিসি বাংলার সংবাদ ও মার্ক টালির সরেজমিন প্রতিবেদন অবরুদ্ধ বাংলাদেশে থাকা কোটি কোটি মানুষের দুর্দশার কথা বিশ্বকে জানিয়েছিল।
ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ভূমিকা এই ক্ষেত্রে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণে পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ দেখাতে ঢাকায় এসেছিলেন, কিন্তু যা দেখেছিলেন তাতে তিনি শিউরে ওঠেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে তিনি লন্ডনের ‘দ্য সানডে টাইমস’ পত্রিকায় ১৯৭১ সালের ১৩ জুন ‘গণহত্যা’ (জেনোসাইড) শিরোনামে দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। দাবি করা হয়, এই প্রতিবেদন পড়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক অভিযান জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেন ও খোদ ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর তাদের নীতি পুনর্মূল্যায়নে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ মিডিয়ার এই জোরালো ভূমিকার কারণেই ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ও পার্লামেন্টের ভূমিকা
সরকার সতর্ক থাকলেও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনেক সদস্য, বিশেষ করে লেবার পার্টির এমপিরা ছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে অত্যন্ত সোচ্চার। এদের মধ্যে জন স্টোনহাউজ ও পিটার শোর-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জন স্টোনহাউজ তো সরাসরি ভারতের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন ও ফিরে এসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন।
ব্রিটিশ এমপিরা গঠন করেছিলেন ‘অ্যাকশন কমিটি ফর দ্য পিপল অব বাংলাদেশ’। তারা ব্রিটিশ সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন যাতে পাকিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয় এবং বাংলাদেশকে সহায়তা দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে হাজারো প্রবাসী বাঙালির সঙ্গে ব্রিটিশ এমপিরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছিলেন। এই রাজনৈতিক চাপ এডওয়ার্ড হিথ সরকারকে বাধ্য করেছিল পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে সতর্ক হতে ও ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জন্য বিপুল পরিমাণ ত্রাণ সহায়তা পাঠাতে।
শেখ মুজিবের মুক্তি ও ব্রিটেনের চূড়ান্ত স্বীকৃতি
মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের ভূমিকার চূড়ান্ত ও নাটকীয় পর্ব দেখা যায় যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি প্রথম পা রাখেন লন্ডনে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ও মুজিবের বৈঠক ছিল কার্যত বাংলাদেশকে ব্রিটেনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির পূর্বলক্ষণ। ব্রিটেন যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু ৮ জানুয়ারির ওই উষ্ণ অভ্যর্থনাই প্রমাণ করেছিল যে ব্রিটেন নতুন রাষ্ট্রকে মেনে নিয়েছে। ব্রিটেনের এই পদক্ষেপ কমনওয়েলথভুক্ত অন্যান্য দেশ এবং পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করেছিল।
সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা ছিল বহুমাত্রিক। সরকারি পর্যায়ে তারা কৌশলগত কারণে ধীরে চলো নীতি বা ‘ক্যালকুলেটেড নিউট্রালিটি’ বজায় রাখলেও, তারা কখনোই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নেয়নি। বরং তারা লন্ডনের মাটিকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক যুদ্ধের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। আর ব্রিটিশ জনগণ, গণমাধ্যম ও রাজনীতিবিদরা যে অভূতপূর্ব সমর্থন দিয়েছিল, তা আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে ছিল নির্ণায়ক। মার্কিন প্রশাসন যখন পাকিস্তানকে অস্ত্র ও রাজনৈতিক সমর্থন দিচ্ছিল, তখন যুক্তরাজ্যের এই মানবিক ও নৈতিক সমর্থন বাংলাদেশের জন্য ছিল এক বড় রক্ষাকবচ।
তথ্যসূত্র: বিদেশি সাংবাদিকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (মাহবুব কামাল), প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি (আবু সাঈদ চৌধুরী), ১৯৭১: এ গ্লোবাল হিস্ট্রি অফ দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ (শ্রীনাথ রাঘবন),বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি ডিবেটস (হ্যানসার্ড) এবং বিবিসি