তারিখ: ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
স্থান: স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।
ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম (বীর প্রতীক)-এর কাছে খবর আসে যে ভারতীয় আর্মি কমান্ড ঢাকা রেডিও স্টেশনের মাধ্যমে জনগণের উদ্দেশে বিজয়ের ঘোষণা করবে। এটা শুনে তাঁর মনেহলো যেহেতু বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি ও উপ-সেনাপ্রধান কলকাতায় অবস্থান করছেন সেহেতু বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চল সেক্টর-২ এর অপারেশনাল এলাকা হিসাবে বিজয়ের ঘোষণাটা সেক্টর-২ এর কমান্ডারের দেয়া উচিত। তিনি তাঁর সহযোদ্ধা শহিদকে নিয়ে একটা টয়োটা সেডান গাড়ির ব্যবস্থা করে ৩০ হাটখোলা রোডে আরেক সহযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরীর খোঁজে গেলেন কারণ তাঁর সহায়তা ছাড়া কাজটা করা অসম্ভব। এরপর সকাল ৮টা ১০ মিনিটে রেডিও থেকে প্রথমবারের মতো ভেসে এলো মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরীর কণ্ঠস্বর, এখন জাতির উদ্দেশে কিছু বলবেন সেক্টর টু’র কমান্ডার ইন-চার্জ মেজর আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দার। তাঁর ঘোষণার পর সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে ইথারে ভেসে এলো এক দৃপ্ত কণ্ঠস্বর,
আমি মেজর হায়দার বলছি। প্রিয় দেশবাসী, আমাদের দেশ এখন মুক্ত। আপনারা সবাই এখন মুক্ত বাংলাদেশের নাগরিক। সকল গেরিলার প্রতি আমার নির্দেশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। কোথাও যেন আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট না হয়। লুটপাট বন্ধ করতে হবে। এলাকায় এলাকায় পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার দেশে ফিরে দায়িত্ব না নেবেন, ততদিন পর্যন্ত গেরিলাদের যার যার এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। জনগণের প্রতি আমাদের আবেদন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করুন। আল-বদর, আল-শামস, রাজাকার ও দালালদের ধরিয়ে দিন। নিজ হাতে আইন তুলে নেবেন না।
সেদিনই বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে ফতেহ আলী চৌধুরী কয়েকজন সহযোদ্ধাসহ ডিআইটি ভবনে টিভি স্টুডিওতে পৌঁছান। একটু পরই মেজর হায়দার এবং শাহাদত চৌধুরীকে নিয়ে আলম সেখানে পৌঁছান। সেখানে তখন খালেদা ফাহমি, সখিনা আক্তার, কেরামত মওলা, এম এ ওয়াদুদ, আবদুল্লাহ আল মামুন উপস্থিত ছিলেন। শাহাদত চৌধুরী খালেদা ফাহমি ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে প্রোগ্রাম চূড়ান্ত করেন। সকালের রেডিও প্রোগ্রামের মতো ফতেহ আলী চৌধুরী প্রথমে বাংলা ঘোষকের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ঘোষণার পর মেজর হায়দার সংক্ষিপ্ত ভাষণ এবং গেরিলাদের উদ্দেশে ঘোষণা দেন।
২
১৯৪২ সালের ১২ জানুয়ারি কলকাতার ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন এটিএম হায়দার। তাঁর গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের কান্দাইল গ্রামে। বাবা মোহাম্মদ ইসরাইল ব্রিটিশ-ভারত ও পাকিস্তান পুলিশ বিভাগের অত্যন্ত সৎ ও আদর্শবান একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন। মা হাকিমুন্নেসা বেগম গৃহিণী ছিলেন। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে হায়দার ছিলেন দ্বিতীয়। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন পাবনা জেলার বীণাপানি স্কুলে। পরে ১৯৫৮ সালে কিশোরগঞ্জ রামানন্দ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৬১ সালে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৬৩ সালে লাহোর ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেন। পরে লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পরিসংখ্যানে ভর্তি হন।
ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা, ১৯৭১ সাল। সংগৃহীত ছবিমাস্টার্স শেষ করে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ৪র্থ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি ওয়ার কোর্সে যোগদানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতকার্য হন এবং ১৯৬৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুলে যোগদান করেন। ছয় মাস প্রশিক্ষণ শেষে একই বছরের ৬ আগস্ট সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসাবে গোলন্দাজ বাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। তাঁর বদলি হয় মুলতান সাঁজোয়া ডিভিশনের সেল্ফ প্রপেল্ড আর্টিলারি ইউনিটে।
১৯৬৯ সালে তিনি চেরাটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (কমান্ডো) ট্রেনিংয়ে অংশ নেন ও কৃতিত্বের সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষ করেন। ৩৬০ জন কমান্ডোর মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র দুজন, তিনি এবং রাজশাহীর ক্যাপ্টেন সাইদ। কৃতিত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে কমান্ডো প্রশিক্ষণ শেষ করার পর তাঁকে দুটি পদে বদলি অফার দেওয়া হয়-১. চেরাটে কমান্ডো প্রশিক্ষক, ২. কুমিল্লাতে তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে যোগদান। তিনি মাতৃভূমির টানে কুমিল্লা সেনানিবাসে বদলি হওয়াটাই বেছে নেন। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে হায়দারকে কুমিল্লা সেনানিবাসে তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে বদলি করা হয় এবং তিনি ১৯৭১ সালের প্রথমদিকে যোগদান করেন।
ক্যাপ্টেন হায়দারের মতো কমান্ডোকে মুক্ত রাখা বিপজ্জনক হতে পারে ভেবে মার্চ মাসের শুরুর দিকে ঢাকা সেনানিবাসে পাঠিয়ে তাঁবুর মধ্যে অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে তাঁকেও অন্তরীণ করে রাখা হয়। তিনি বাঙালিদের প্রতি এহেন আচরণে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং এক সিনিয়র অফিসারের কাছে বেতনের কথা বলে কথা কাটাকাটি করলে মার্চের ২০ তারিখে তাঁকে কুমিল্লা সেনানিবাসে নিজ ইউনিট তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নে ফেরত পাঠানো হয়। ইউনিটে ফিরে এসে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রমূলক কথাবার্তা তাঁর মনে সন্দেহের উদ্রেক ঘটায়। তিনি বুঝতে পারেন তারা ভয়ংকর কিছু একটা করার পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় এটা টের পেয়েই তিনি অফিসার মেসে তাঁর রুমে গিয়ে পিস্তলটি নিয়ে বাথরুমের জানালা ভেঙে বের হয়ে ক্রলিং করে সেনানিবাসের বাইরে চলে আসেন।
এরপর ক্রমাগত হাঁটতে শুরু করলেন এবং খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪ ইস্ট বেঙ্গল অবস্থান করছে। দীর্ঘ ৬০ মাইল হেঁটে সেখানে পৌঁছে ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের সঙ্গে তাঁর দেখা হলো। তাঁকে সেখান থেকে ৪ ইস্ট বেঙ্গলের সদর দপ্তর তেলিয়াপাড়ায় মেজর খালেদ মোশাররফের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এসএসজি প্রশিক্ষিত ক্যাপ্টেন হায়দারকে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে মেজর খালেদ মোশাররফ বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি আপনার মতোই একজনকে খুঁজছিলাম।’
৩
বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন হায়দার মুক্তিযুদ্ধকালেই মেজর পদে পদোন্নতি পান। স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক, ভয়ংকর যমদূত। পাকিস্তান সরকারের মিথ্যাচারের জবাব ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে জানান দেয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় গেরিলা অপারেশন করার জন্য মেজর খালেদ মোশাররফের নির্দেশে ক্যাপ্টেন হায়দার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, দুঃসাহসী ও মেধাবী ১৭ জন তরুণকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুললেন এক দুর্ধর্ষ গেরিলা দল।
মেজর হায়দার ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আত্মসমর্পণ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি ও ভারতীয় জেনারেলদের পাশাপাশি হাঁটছেন। উইকিপিডিয়া কমন্সএদের কাজ ছিল গ্রেনেড ছোঁড়া থেকে শুরু করে ঝটিকা আক্রমণ, অতর্কিত ত্রাস সৃষ্টি করা এবং ‘হিট অ্যান্ড রান’। আরবান গেরিলা যুদ্ধের সব কৌশলই এদের রপ্ত করানো হয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এর আশপাশে ‘হিট অ্যান্ড রান’ অপারেশন পরিচালনা করার জন্য এই দলকে প্রথমবারের মতো ঢাকায় পাঠানো হয়। কিন্তু ঢাকার অশান্ত পরিস্থিতি তুলে ধরতে তাঁর যেভাবে লক্ষ্যবস্তুর কেন্দ্রে হামলা করে বসে, তাতে তোলপাড় ওঠে চারদিকে। নড়েচড়ে ওঠে যুদ্ধের সব পক্ষ ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। অপারেশন শেষে আলম, মায়া, জিয়াসহ অন্যরা যখন ক্যাম্পে ফেরেন, তখন তাঁদের প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেন হায়দারকে উদ্দেশ করে মেজর খালেদ মোশাররফ বলে ওঠেন, ‘লুক হায়দার, এদের বললাম টার্গেটের আশপাশে গ্রেনেড মারার জন্য। এরা তো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফুটায়ে দিয়েছে। They all are Crack People. Bravo! Bravo!’ সেই থেকে ঢাকার গেরিলা অপারেশনে যাওয়া যোদ্ধাদের পরিচিতি হয়ে গেল ‘ক্র্যাক প্লাটুন’নামে।
সেক্টর-২ এর প্রত্যেক গেরিলাই মনে করতেন তাঁর সঙ্গে মেজর হায়দারের বিশেষ সম্পর্ক আছে। সবাইকে আপন করে নেয়ার এক অনন্য গুণ ছিল মেজর হায়দারের। তিনি ৩৫ হাজারেরও বেশি ছাত্র-যুবক ও তরুণকে প্রশিক্ষিত করে গেরিলা যোদ্ধায় পরিণত করেছিলেন। মেজর খালেদ মোশাররফ যুদ্ধে মারাত্মক আহত হলে মেজর হায়দার ২ নম্বর সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার হিসাবে (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকার লে. কর্নেল এটিএম হায়দারকে ‘বীর উত্তম’খেতাবে ভূষিত করে।
৪
তারিখ: ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বৃহস্পতিবার।
স্থান: ডেমরা।
শীতের কুয়াশা ভেজা সকাল। ২ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ৮০০ সৈনিকের সাথে ৩ নম্বার সেক্টরের কিছু মুক্তিযোদ্ধা সমবেত হয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি ঢাকার দিকে মুভ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে কিন্তু এরমধ্যেই খবর এসেছে পাকিস্তানি বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। যদিও তখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনো আলোচনা হয়নি তবুও সবার মাঝেই বদ্ধমূল ধারণা বিজয় অবধারিত।
তাঁরা হঠাৎ খেয়াল করলেন, কুয়াশার চাদর ছিন্ন করে পূর্বদিক থেকে একটা সামরিক জীপ এগিয়ে আসছে। কাছে এলে দেখা গেল ৯৫ বিএসএফ হেডকোয়ার্টারের ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং বেসামরিক পোশাক পরা সেক্টর টু’র উপ-অধিনায়ক মেজর হায়দারকে পাশে বসিয়ে ঢাকার দিকে যাচ্ছেন। তাঁরা ইতিহাসের সাক্ষী হতে জেনারেল নিয়াজি’র আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। এই দুই বীর শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী হলেও কয়েকবছর পরে নিজ নিজ দেশে সহযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়েছিলেন।
লে. কর্নেল এটিএম হায়দার বীর উত্তম ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তারিখ সকালে ১০ ইষ্ট বেঙ্গলে কিছু উচ্ছৃঙ্খল জওয়ান ও কর্মকর্তার হাতে নিরস্ত্র অবস্থায় মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম এবং কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম এর সঙ্গে নির্মমভাবে নিহত হন। ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং ১৯৮৪ সালে স্বর্ণমন্দিরের ভেতরে শিখ সম্প্রদায়ের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা জারনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালসহ নিহত হন। নিয়তির হিসাব বড় অদ্ভুত!