leadT1ad

৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে কী লিখেছিলেন এ কে খন্দকার, কী ঘটেছিল তাঁর জীবনে

মুক্তিযুদ্ধের উপসেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার বীরউত্তম শনিবার (২০ ডিসেম্বর) মারা গেছেন। ৯৫ বছরের দীর্ঘ জীবনে মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের নানা ঘটনার স্বাক্ষী তিনি। ২০১৪ সালে প্রথমা প্রকাশন থেকে ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ প্রকাশের পর শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের ওপর লেখা একটি অধ্যায় নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। জাতীয় সংসদেও বইটি নিয়ে আলোচনা হয়। এ কে খন্দকার কী লিখেছিলেন সেই বইয়ে? বইটি প্রকাশের পর কী ঘটেছিল তাঁর জীবনে, সেসব নিয়েই এই লেখা।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

স্ট্রিম গ্রাফিক

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ বাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি ছিলেন বিমানবাহিনীর প্রধান। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাব ও ২০১১ সালে স্বাধীনতা পদক পান।

সামরিক জীবনের পর তিনি রাজনীতিতেও সক্রিয় হন। এরশাদের সামরিক শাসনামলে পরিকল্পনামন্ত্রী হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন।

২০১৪ সালে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর বই ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’। বইটি প্রকাশের পর এ বই নিয়ে বিতর্ক হয়। জাতীয় সংসদেও বইটি নিয়ে আলোচনা হয়। ইতিহাসবিষয়ক এই বইতে তিনি লিখেছিলেন:

সাতই মার্চের ভাষণটি আমি শুনেছি। এর মধ্যে যে কথাগুলো আমার ভালো লেগেছিল, তা হলো: ‘দুর্গ গড়ে তোলো’, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’, ‘শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ সময় সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ তাঁর কাছ থেকে এ ধরনের কথা আশা করছিল। ওই কথাগুলো শক্তিশালী ছিল বটে, তবে তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের নেতাদের ছিল না।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, কিন্তু আমার মনে হয়েছে, কীভাবে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে, তা তিনি পরিষ্কার করেননি। তা ছাড়া জনগণকে যুদ্ধ করার জন্য যেভাবে প্রস্তুত করা প্রয়োজন, তা করা হয়নি। ভাষণে চূড়ান্ত কোনো দিকনির্দেশনা পাওয়া গেল না। ভাষণটির পর মানুষজন ভাবতে শুরু করল-এরপর কী হবে? আওয়ামী লীগের পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় যুদ্ধ শুরু করার কথা বলাও একেবারে বোকামি হতো। সম্ভবত এ কারণেই বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকেন। তা ছাড়া ইয়াহিয়া খান নিজেও ওই ধরনের ঘোষণা না দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হয়তো ঢাকায় ইয়াহিয়ার উপস্থিতিতে একটি রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, তা আমি মনে করি না। এই ভাষণের শেষ শব্দগুলো ছিল ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’। তিনি যুদ্ধের ডাক দিয়ে বললেন, ‘জয় পাকিস্তান’! এটি যে যুদ্ধের ডাক বা স্বাধীনতার আহ্বান, তা প্রচণ্ডভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং তর্কাতীতও নয়। যদি আওয়ামী লীগের নেতাদের কোনো যুদ্ধ-পরিকল্পনা থাকত, তাহলে মার্চের শুরু থেকে জনগণ এবং সরকারি, বেসরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাদের স্বল্প সময়ে সঠিকভাবে সংগঠিত করা যেত। সেটা করা হলে আমার মনে হয় যুদ্ধটি হয়তো-বা খুব অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যেত এবং আমাদের বিজয় নিশ্চিত হতো। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সেটা করা হয়নি।

এই বই প্রকাশের পর বইটি ঘিরে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। ২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে লিখেছে, ‘আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির একাধিক সংসদ সদস্য অভিযোগ করেন, বইটিতে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল ও অসত্য তথ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। কেউ কেউ বইটি নিষিদ্ধ করার দাবিও জানান। এই বিতর্কের মধ্যেই ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে এ কে খন্দকার সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন। দীর্ঘ সময় ধরে সমালোচনার মুখে পড়লেও তিনি প্রকাশ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি।’

পরিস্থিতির পরিবর্তন আসে ২০১৯ সালের ১ জুন। ওই দিন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কে খন্দকার তাঁর বইয়ের একটি সম্পূর্ণ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করে নেন। একই সঙ্গে অসত্য তথ্য দেওয়ার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তাঁর ক্ষমা চাওয়ার খবর প্রকাশ করে ১ জুন দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে, ‘বইয়ে অসত্য দেওয়ার জন্য জাতির কাছে ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিদেহী আত্মার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এ কে খন্দকার।’

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, ‘আমার বয়স এখন ৯০ বছর। আমার সমগ্র জীবনে করা কোনো ভুলের মধ্যে, এটিকেই আমি একটা বড় ভুল মনে করি।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত