leadT1ad

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কেন ইতিহাসের ভুল দিকে ছিল মধ্যপ্রাচ্য

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ইতিহাসের ভুল দিকে অবস্থান নিয়েছিল। ধর্মীয় সংহতি, রাজনৈতিক স্বার্থ ও পরাশক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে তারা ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালন করে। স্নায়ুযুদ্ধের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ায় এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো আঞ্চলিক শক্তি ভারতকে সমর্থন করে। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ আরব দেশ যেমন সৌদি আরব ইরান, মিশর ও সিরিয়া পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায়।

সেই সময়ে মধ্যপ্রাচ্য দুটি ব্লকে বিভক্ত ছিল—রাজতান্ত্রিক (যুক্তরাষ্ট্রপন্থী) এবং প্রগতিশীল বা সমাজতান্ত্রিক (সোভিয়েতপন্থী)। সৌদি আরব ও জর্ডান অন্ধভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন দিলেও মিশরের আনোয়ার সাদাত এবং সিরিয়ার হাফিজ আল-আসদ কিছুটা সংযত ছিলেন। যেহেতু তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র ছিলেন, তাই তারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে খুব কঠোর অবস্থান নেননি বা অস্ত্র পাঠাননি। তারা মূলত নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছিলেন এবং ওআইসিতে পাকিস্তানের পক্ষে খুব জোরালো ভূমিকা নেওয়া থেকে বিরত ছিলেন।

এ ছাড়া ফিলিস্তিনও পাকিস্তানের পক্ষে। ইয়াসির আরাফাত এবং পিএলও ১৯৭১ সালে স্পষ্টভাবে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল। জর্ডান সেনাবাহিনীর সঙ্গে পিএলওর বিরোধ থাকা সত্ত্বেও। পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণের সম্পর্ক ছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন দলিল, হেনরি কিসিঞ্জারের স্মৃতিকথা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি নিয়ে লেখা প্রামাণ্য গ্রন্থগুলো থেকে জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে তুরস্ক পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান সামরিক সহায়তাকারী ছিল। তুরস্ক এবং ইরান মিলে পাকিস্তানের জন্য যুদ্ধের রসদ এবং বিমানের যন্ত্রাংশ সরবরাহে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। ইরান শুধু বিমানঘাঁটিই দেয়নি, তারা পাকিস্তানের ফাইটার জেটগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়ও দিয়েছিল।

সমালোচকদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর এমন অবস্থান গণহত্যার দায়ীদের আরও সাহস জুগিয়েছিল এবং ন্যায়বিচার বিলম্বিত করে। ভূরাজনৈতিকভাবে কথিত বৈশ্বিক-ইসলামি ঐক্যকে প্রাধান্য দিয়ে তারা তাদের নৈতিক দায়িত্ব বিসর্জন দিয়েছিল। তারা যুদ্ধকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যেন এটি ইসলামের অখণ্ডতা রক্ষা এবং বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের লড়াই। আরব লীগ ও ওআইসি পাকিস্তানকে নৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দেয় এবং ‘মুসলিম উম্মাহর ঐক্য’র ওপর জোর দেয়।

ধর্মীয় সংহতি ও ‘ইসলাম বিপন্ন’ ধারণা

অনেক আরব দেশ মুক্তিযুদ্ধকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিল। তাদের ধারণা ছিল, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতা মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের জন্য হুমকি হবে। অবিভক্ত পাকিস্তান তখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। তারা ভারতকে ‘হিন্দু আক্রমণকারী’ হিসেবে দেখত এবং মনে করত ভারত পূর্ব পাকিস্তান দখল করে পাকিস্তানকে দুর্বল করতে চায়।

কিন্তু পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ এবং পূর্ব বাংলার সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য, শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও জলবায়ু ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাঁচটি অংশকে একত্রে রাখার একমাত্র যৌথ সূত্র ছিল ইসলাম ধর্মের নামমাত্র বন্ধন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রস্তাবিত ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ অসার প্রমাণ করে। আরও দেখায় যে কেবল ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক বাস্তবতাকে একই কাঠামোয় ধরে রাখা সম্ভব নয়।

আরব বিশ্বে বহু নেতা ধারণা করেছিলেন যে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে কঠোর সামরিক ব্যবস্থা নেওয়া স্বাভাবিক। তাদের দৃষ্টিতে, ভারতের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ‘যথাযথ জবাব’ দেওয়া প্রয়োজন ছিল, যেমন রেডিও পাকিস্তান প্রচার করত। ফলে আরব দেশগুলো নৈতিক, আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে পাকিস্তানকে সাহস জুগিয়ে যায়, যদিও জানত যে সেনাবাহিনী গণহত্যা ও জাতিগত নিধন চালাচ্ছে।

ভূরাজনৈতিক জোট ও ভারতবিরোধী অবস্থান

স্নায়ু যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অনেক মধ্যপ্রাচ্যের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ছিল। যুক্তরাষ্ট্র তখন সোভিয়েত-সমর্থিত ভারতকে প্রতিহত করতে পাকিস্তানের পক্ষে ঝুঁকে পড়ে। ফলে সৌদি আরব, জর্ডান ও ইরানের মতো দেশ পাকিস্তানের জন্য মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের পথ তৈরি করে। এতে নিষেধাজ্ঞা পরোক্ষভাবে এড়ানো সম্ভব হয়।

বিশ্লেষকদের মতে, মুসলিম দেশগুলো বাংলাদেশকে সমর্থন না দেওয়ার একটি কারণ ছিল, পাকিস্তান নিজেকে ইসলামিক রিপাবলিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ছিল এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আগেই কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করেছিল। একই সঙ্গে এসব দেশের ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক বৈরিতা ছিল।

তথ্যপ্রবাহ ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ

বেশিরভাগ আরব রাষ্ট্র তখন রাজতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে ছিল। এসব দেশে গণমাধ্যম ছিল নিয়ন্ত্রিত। ফলে পাকিস্তানের গণহত্যার খবর জনগণের কাছে পৌঁছায়নি বা বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়। আরব মিডিয়া প্রায়ই পাকিস্তানের প্রচারণা পুনরাবৃত্তি করত এবং ভারতের ওপর আগ্রাসনের দায় চাপাত।

সৌদি আরব পাকিস্তানের অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, তথ্যের সীমিত প্রবাহ এবং আঞ্চলিক কৌশলগত স্বার্থ তাদের নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।

তখন সদ্য গঠিত সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং অন্যান্য উপসাগরীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন দেয়। লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি জোরালো ভাষায় পাকিস্তানের পক্ষ নেন এবং ভারতকে কঠোর সমালোচনা করেন।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর এই অবস্থান বাংলাদেশকে প্রথমদিকে অনেক আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে। যুদ্ধের পর অনেক আরব দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে দেরি করে। তবে পরে বাংলাদেশ আরব বিশ্বের সঙ্গে শ্রমবাজার, উন্নয়ন সাহায্য ও বাণিজ্যের ভিত্তিতে নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলে।

১৯৭২ সালের জুলাইয়ে প্রথম আরব দেশ হিসেবে ইরাক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ধীরে ধীরে অন্য সব আরব রাষ্ট্রও নবস্বাধীন বাংলাদেশকে গ্রহণ করে।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত