‘ভালো থাকা’র স্বপ্ন বুকে নিয়ে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে লাখো মানুষ দূর দেশে পাড়ি জমান। তাদের কারও চোখে থাকে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষার প্রত্যাশা, কেউ বা খোঁজেন উন্নত ক্যারিয়ার, আবার কারও চাওয়া শুধুই একটি নিরাপদ আবাসস্থল; যেখানে পরিবার নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। তবে অভিবাসনের এই পথটি সবার জন্য সমান নয়।
জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইএমও-এর মতে, কোনো ব্যক্তি যদি আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে বা নিজ রাষ্ট্রের ভেতরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বাসস্থান পরিবর্তন করেন, তবে তাকে অভিবাসী বলা হয়।
এদিকে, ইউনেসকো অভিবাসনকে একটু ব্যাপকভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। তাদের মতে, অভিবাসন হলো একটি রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক সীমানা অতিক্রম করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাসস্থান পরিবর্তন করা।
দেশ থেকে যারা বিদেশে পাড়ি জমান, তাদের মধ্যে একটা বৃহৎ অংশের ইচ্ছা থাকে সে দেশেই থেকে যাওয়া। কিন্তু অনেকসময় বিভিন্ন জটিলতার কারণে বিদেশের মাটিতে স্থায়ী হওয়া সম্ভব হয় না। তবে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই প্রবাসে স্থায়ী ঠিকানা গড়তে পারেন অর্থাৎ অভিবাসী হতে পারেন, শত জটিলতার পরও৷ এজন্য প্রয়োজন নিজের সার্বিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতা বিবেচনা করে সঠিক দেশ নির্বাচন।
যোগ্যতা, বাজেট, বয়স এবং পারিবারিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে পাল্টে যায় গন্তব্য। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে কোন দেশগুলো অভিবাসনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী, কোথায় কী সুবিধা এবং কীভাবে যাওয়া যাবে; এ সবকিছু নিয়েই এই লেখা।
কানাডা
বিদেশের মাটিতে স্থায়ী হওয়ার জন্য যে ক'টি দেশকে বাংলাদেশিরা তালিকার শুরুর দিকে রাখেন, এই দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডা।
উন্নত জীবন-যাপন ব্যবস্থা এবং আধুনিক নাগরিক জীবনের সব সুযোগ সুবিধা থাকার কারণে প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য মানুষ পাড়ি জমায় ম্যাপল পাতার দেশ কানাডায়। দেশটির সরকারও জাতিগত বৈচিত্র্য ধরে রাখার লক্ষ্যে এই অভিবাসীদের সাদরে বরণ করে নেয়।
এছাড়া মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও কানাডা এগিয়ে আছে। শিক্ষাজীবন শেষে অনেক উন্নত দেশেই চাকরি কিংবা নাগরিক সুবিধা পাওয়া যায় না। অথচ এ দেশে শিক্ষাজীবন শেষে সহজেই পছন্দনীয় পেশায় যোগদান ও নাগরিক সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে।
দক্ষ পেশাজীবিদের জন্য কানাডার ‘এক্সপ্রেস এন্ট্রি’ এবং ‘প্রোভিনশিয়াল নমিনি প্রোগ্রাম (পিএনপি)’ আশীর্বাদস্বরূপ। উপযুক্ত বয়স, পর্যাপ্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং ইংরেজি দক্ষতার সমন্বয়ে পয়েন্ট অর্জন করে সরাসরি দেশটিতে স্থায়ীভাবে (পিআর) যাওয়ার সুযোগ থাকে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যাংকার, আইটি পেশাজীবী এবং প্রকৌশলীদের ব্যাপক কদর রয়েছে দেশটিতে।
তবে, চলতি বছর বাংলাদেশকে ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ বা ‘রেড লিস্ট’-এ অন্তর্ভুক্ত করার পর থেকে দেশটির নাগরিকদের জন্য ভিসা অনুমোদনের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমিয়ে দিয়েছে কানাডা। যারা কানাডায় স্থায়ী হওয়ার চিন্তা করছেন, তাদের এ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এক সময় দেশটিতে শুধু সিলেট অঞ্চলের মানুষের আধিপত্য থাকলেও এখন সারা দেশ থেকেই মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যুক্তরাজ্যকে বেছে নিচ্ছেন।
ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্য তাদের অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তন এনেছে।
বর্তমানে ‘হেলথ অ্যান্ড কেয়ার ওয়ার্কার’ ভিসা বাংলাদেশিদের জন্য নিয়ে এসেছে সুবর্ণ সুযোগ। এই ভিসায় নার্সিং বা কেয়ার গিভিংয়ে সামান্য অভিজ্ঞতা থাকলেও সপরিবারে সেখানে যাওয়ার সুযোগ আছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য এক বছরের মাস্টার্স এবং এরপর দুই বছরের ‘পোস্ট স্টাডি ওয়ার্ক’ পারমিট ক্যারিয়ার গড়ার দারুণ সুযোগ দিচ্ছে যুক্তরাজ্য সরকার।
তবে একটি বিষয় ভুলে গেলে চলবে না, ইউরোপজুড়ে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করছে। গত বছরে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব পোষণকারী হাজারো মানুষ ‘ওদের দেশে ফেরত পাঠাও’ স্লোগান দিয়ে লন্ডনের রাস্তায় মিছিল করেছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের জন্য যুক্তরাজ্যে অভিবাসনের পথ কিছুটা কঠিন হয়ে গেছে৷
অস্ট্রেলিয়া
যারা শান্তিপূর্ণ আবহাওয়ার সঙ্গে উচ্চ বেতন এবং নিরাপদ জীবন চান, তাদের জন্য অস্ট্রেলিয়া হতে পারে প্রথম পছন্দ। বিশেষ করে, বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার এবং আইটি গ্র্যাজুয়েটদের জন্য অস্ট্রেলিয়া এক স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। তাদের জন্য খোলা আছে ‘সাবক্লাস ১৮৯’ এবং ‘১৯০’ ভিসা।
তাছাড়া, অস্ট্রেলিয়ার বেতন কাঠামো বিশ্বের অন্যতম সেরা, যা সেখানে বসবাসরত অভিবাসীদের দ্রুত অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এনে দেয়।
তবে কানাডা, যুক্তরাজ্যের মতো অস্ট্রেলিয়াও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তাদের অভিবাসন নীতি কঠোর করছে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ইংরেজি দক্ষতার প্রয়োজনীয় স্কোর বাড়ানো হয়েছে এবং গ্র্যাজুয়েট ভিসার মেয়াদ কমিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়া ‘ভিসা হপিং’ বন্ধেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। মূলত, আগামী দুই বছরের মধ্যে অভিবাসীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে নামিয়ে আনা এবং দক্ষ কর্মী নিশ্চিত করাই এই পরিবর্তনের লক্ষ্য।
পর্তুগাল
যাদের বাজেট বা শিক্ষাগত যোগ্যতা কিছুটা কম, কিন্তু স্বপ্ন ইউরোপের পাসপোর্ট, তাদের জন্য পর্তুগাল এখন হতে পারে উপযুক্ত গন্তব্যস্থল।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের অভিবাসন আইন যখন অত্যন্ত কঠোর, পর্তুগাল সেখানে অনেকটাই নমনীয়ভাবে অভিবাসীদের বিদেশের মাটিতে স্থায়ী হতে সাহায্য করে। দেশটিতে বৈধভাবে প্রবেশ করে যেকোনো কাজ (যেমন- রেস্টুরেন্ট, কৃষি বা শপ কিপার) শুরু করে নিয়মিত ট্যাক্স দিলেই রেসিডেন্সি কার্ডের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। মাত্র ৫ বছর বসবাসের পর সাধারণ পর্তুগিজ ভাষা পরীক্ষায় পাস করলেই নাগরিকত্বের আবেদন করা যায়। পর্তুগালের পাসপোর্ট পেলে ইউরোপের শেনজেনভুক্ত দেশগুলোতে কাজ ও বসবাসের স্বাধীনতা পাওয়া যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে পর্তুগালে বাংলাদেশিদের ঢল নেমেছে। বিশেষ করে, পর্তুগালের লিসবন ও পোর্তো শহরে বাংলাদেশি অভিবাসীদের বড় কমিউনিটি গড়ে উঠেছে।
ইতালি
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালিতেই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি প্রবাসী বাস করেন। ইতালি সরকার প্রতি বছর ‘ফ্লুসি ডিক্রি’-এর মাধ্যমে কৃষি, হোটেল এবং নির্মাণ খাতে কয়েক লাখ বিদেশি কর্মী নেয়। বাংলাদেশিদের জন্য এখানে নির্দিষ্ট কোটা বরাদ্দ থাকে। এই কোটাটি স্বল্প শিক্ষিত বা কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন বাংলাদেশিদের জন্য ইউরোপে প্রবেশের একটি বৈধ ও নিরাপদ উপায়। ইতালিতে বৈধ প্রক্রিয়ায় প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ বাংলাদেশি বসবাস করেন।
যুক্তরাষ্ট্র
স্থায়ী হওয়ার জন্য স্বপ্নের দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই মানুষের প্রথম পছন্দ। কিন্তু সেখানে স্থায়ী হওয়ার পথটি বেশ জটিল। একসময় বাংলাদেশিদের জন্য ‘ফ্যামিলি ইমিগ্রেশন’ (ভাই-বোন বা বাবা-মা স্পন্সর করলে) এবং ডিভি লটারি জনপ্রিয় ছিল। তবে বর্তমানে ডিভি লটারি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন মূলত উচ্চশিক্ষাই দেশটিতে পা রাখার প্রধান উপায়। মেধাবী শিক্ষার্থীরা মাস্টার্স বা পিএইচডির জন্য আমেরিকাকে বেছে নিচ্ছেন এবং পড়াশোনা শেষে এইচ-১বি ভিসায় সেখানে স্থায়ী হচ্ছেন। তবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর নীতির কারণে আমেরিকায় অভিবাসন এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।