leadT1ad

ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের মধ্যেও বাড়ছে ভারতের রপ্তানি

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

প্রকাশ : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ২১
নয়াদিল্লির উপকণ্ঠে গ্রেটার নয়ডায় একটি সৌর উৎপাদন কেন্দ্রে অ্যাসেম্বলি লাইনে কাজ করছেন টেকনিশিয়ানরা। ছবি: রয়টার্স।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের মধ্যেও ভারতের রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৫ সালের নভেম্বরে ভারতের রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি গত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধি। এর প্রধান কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে রপ্তানি বৃদ্ধি।

এই প্রবৃদ্ধি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কের কারণে রপ্তানি ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এর ফলে ভারতীয় পণ্যের ওপর মোট শুল্ক দাঁড়ায় ৫০ শতাংশ।

একই সময়ে চীন এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি বাণিজ্য উদ্বৃত্ত অর্জন করেছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রবাহ নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে।

ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্যে বলা হয়েছে, রপ্তানিতে এই উত্থান ভারতীয় পণ্যের চাহিদা টিকে থাকার ইঙ্গিত দেয়। পাশাপাশি নতুন বাজারে রপ্তানি বাড়ানোর কৌশলও এতে ভূমিকা রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমাতে অনেক দেশই এখন এমন কৌশল নিচ্ছে।

নভেম্বরে ভারতের রপ্তানির চিত্র

২০২৫ সালের নভেম্বরে ভারতের পণ্য রপ্তানির মূল্য দাঁড়ায় ৩৮ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের তুলনায় ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। অক্টোবর মাসে রপ্তানি যেখানে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ কমে গিয়েছিল, সেখানে নভেম্বরে পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়ায়।

এই সময়ে আমদানিও কমেছে। বিশেষ করে সোনা, তেল ও কয়লার আমদানি কমেছে। ফলে পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে। এটি জুনের পর সর্বনিম্ন। অক্টোবর মাসে এই ঘাটতি ছিল ৪১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রকৌশল পণ্য, ইলেকট্রনিকস এবং ওষুধ খাত রপ্তানি বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে।

কোন দেশে বেশি যাচ্ছে ভারতীয় পণ্য?

নতুন শুল্ক আরোপের পরও যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি বেড়েছে। নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ২২ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। যুক্তরাষ্ট্র এখনো ভারতের সবচেয়ে বড় একক রপ্তানি গন্তব্য।

প্রকৌশল পণ্য, ইলেকট্রনিকস, গয়না ও রত্ন এবং ওষুধ খাত সবচেয়ে ভালো করেছে। বাণিজ্য সচিব রাজেশ আগরওয়াল বলেন, শুল্ক সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।

চীনে ভারতের রপ্তানি আরও দ্রুত বেড়েছে। নভেম্বরে তা আগের বছরের তুলনায় ৯০ শতাংশ বেড়ে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস ও প্রকৌশল পণ্যের আমদানি চীন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে।

এ ছাড়া স্পেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও তানজানিয়ায় রপ্তানিও সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।

নভেম্বেরে ভারতের প্রধান রপ্তানি। আল-জাজিরার গ্রাফিক
নভেম্বেরে ভারতের প্রধান রপ্তানি। আল-জাজিরার গ্রাফিক

যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বাড়ছে কেন?

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের অনেক রপ্তানি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের আওতায় পড়ে না। যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সাম্বিত ভট্টাচার্য বলেন, ইলেকট্রনিকস ও ওষুধের ওপর শুল্ক নেই। এসব পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে।

এ ছাড়া চা, কফি, মসলা ও অন্যান্য খাদ্যপণ্যও শুল্ক ছাড়ের তালিকায় যোগ হয়েছে। এসব পণ্যের রপ্তানি স্থিতিশীলভাবে বাড়ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ব্যবসায়ীরা ধারণা করছেন, ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র আরও শুল্ক ছাড় দিতে পারে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এখনো একটি বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে।

নভেম্বরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির আওতায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা আইওসি, বিপিসিএল ও এইচপিসিএল প্রতি বছর ২২ লাখ টন মার্কিন এলপিজি আমদানি করবে। এটি ভারতের মোট এলপিজি আমদানির প্রায় ১০ শতাংশ।

অধ্যাপক ভট্টাচার্য বলেন, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতার পথে রয়েছে। শুল্ক কমার সম্ভাবনা আছে। আরও ছাড় আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা ভারতীয় সরবরাহকারীদের ওপর আস্থা রাখছেন। ভারতীয় পণ্য এখনো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও কি রপ্তানি বাজার খঁজুছে ভারত?

হ্যাঁ, ভারত ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও রপ্তানি বাজার খুঁজছে। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত থাকলেও দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।

চলতি বছরের শুরুতে ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করেছিল, ভারত ছাড়ে পাওয়া রুশ তেল কেনা বন্ধ করতে রাজি হয়েছে। বাস্তবে ভারত সেই অবস্থান থেকে সরে আসেনি। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সত্ত্বেও ভারত কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের মতো সংবেদনশীল খাত খুলে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

সরকারের অবস্থান হলো, কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করা হবে এবং শুল্কচাপের কাছে নতি স্বীকার করা হবে না। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এসব খাতে বেশি বাজার প্রবেশাধিকার দাবি করছেন।

এই প্রেক্ষাপটে ভারত বিকল্প বাণিজ্য অংশীদার খুঁজছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে একটি বিস্তৃত বাণিজ্য চুক্তি সই হয়। এই চুক্তির আওতায় দুই দেশই শুল্ক কমিয়েছে। এর আগে ইউরোপীয় মুক্ত বাণিজ্য সংস্থার চার দেশ—সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, আইসল্যান্ড ও লিচেনস্টাইনের সঙ্গে ভারত একটি অংশীদারত্ব চুক্তি করে। এই চুক্তিতে বিনিয়োগের বিনিময়ে বাজার সংযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ভারত মেক্সিকোর সঙ্গেও বাণিজ্য আলোচনা চালাচ্ছে। লক্ষ্য হলো নতুন রপ্তানি করিডর তৈরি করা। তবে মেক্সিকোর সিনেট জানুয়ারি থেকে ভারতসহ কয়েকটি দেশের পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ শুল্ক বাড়ানোর অনুমোদন দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্ত মূলত যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া ওমানের সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্য আলোচনা চলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত ইউরেশিয়া ও মধ্য এশিয়ার বাজারেও রপ্তানি বাড়ানোর দিকে নজর দিচ্ছে।

নভেম্বরে ভারতের বাণিজ্য। আল-জাজিরার গ্রাফিক
নভেম্বরে ভারতের বাণিজ্য। আল-জাজিরার গ্রাফিক

ভারতের রপ্তানি বাড়ার আর কী কারণ আছে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, নভেম্বরে রপ্তানি বাড়ার পেছনে মুদ্রানীতির প্রভাবও রয়েছে। ওই সময়ে রুপির মান ডলারের বিপরীতে দুর্বল ছিল। ফলে ভারতীয় পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে তুলনামূলকভাবে সস্তা হয়েছে। এতে শুল্কের নেতিবাচক প্রভাব আংশিকভাবে সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

এ ছাড়া তুলনামূলক হিসাবের একটি দিকও রয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে লোহিত সাগর সংকটের কারণে রপ্তানি ব্যাহত হয়েছিল। সেই দুর্বল ভিত্তির ওপর ২০২৫ সালের নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি হিসাব করা হয়েছে। ফলে এই প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেশি আশাবাদী বলে মনে হতে পারে।

আর কোন দেশ রপ্তানি বাড়াতে পেরেছে?

চীন ২০২৫ সালেও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। এর ফলে দেশটি এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি বাণিজ্য উদ্বৃত্ত অর্জন করেছে। বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছিল। পরে আলোচনার সুবিধার্থে তা কিছুটা কমানো হয়।

চীন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অন্যান্য এশীয় বাজারে রপ্তানি বাড়িয়ে এই চাপ সামাল দিয়েছে। ইলেকট্রনিকস, বৈদ্যুতিক গাড়ি ও বিরল খনিজ ধাতুর চাহিদা এতে বড় ভূমিকা রেখেছে। নভেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়নে চীনের রপ্তানি প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়েছে। ২০২৫ সালের প্রথম ১১ মাসে চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত আগের বছরের তুলনায় ২১ শতাংশের বেশি বেড়েছে।

ভিয়েতনামও ২০২৫ সালে রপ্তানি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ১২১ বিলিয়ন ডলারের বেশি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেও নভেম্বরে ভিয়েতনামের যুক্তরাষ্ট্রমুখী রপ্তানি ২২ শতাংশের বেশি বেড়েছে।

চীনের প্রধান রপ্তানি। আল-জাজিরার গ্রাফিক
চীনের প্রধান রপ্তানি। আল-জাজিরার গ্রাফিক

অন্য দেশগুলোও কি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমাচ্ছে?

হ্যাঁ, অনেক দেশই যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বিকল্প বাজার খুঁজছে। বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আলোচনায় গতি এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এশিয়ার বাজার—বিশেষ করে চীন, জাপান ও আসিয়ান দেশগুলোর দিকে ঝোঁক বাড়ছে। বাণিজ্য চুক্তি করা, বিনিয়োগ উৎসাহিত করা এবং বাজার খুলে দেওয়াকে অনিশ্চয়তা কমানোর উপায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন লাতিন আমেরিকার মার্কোসুর জোট, মেক্সিকো ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করেছে। এসব চুক্তিতে অধিকাংশ পণ্যের শুল্ক কমানো বা ধাপে ধাপে তুলে নেওয়ার কথা রয়েছে।

কানাডাও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। দেশটি নতুন বাণিজ্য চুক্তিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। নভেম্বরে কানাডা ও সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি সই করেছে। একই সঙ্গে দুই দেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনায় বসতে সম্মত হয়েছে।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে দেশটির রপ্তানি দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত