বিদ্যুতের সরবরাহব্যবস্থা শক্তিশালী করতে দেশে প্রথমবারের মতো নেওয়া ভূ-গর্ভস্থ উপকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প কাজে আসেনি। কোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়াই এ প্রকল্পে সাড়ে ৬৪ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। অত্যধিক ব্যয় বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে প্রকল্পটি অসমাপ্ত রেখেই শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটিতে (পিইসি) পাঠানো হয়েছে। শিগগিরই বিষয়টি পিইসি সভায় উঠবে বলে জানা গেছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২১ জুন ‘ডিপিডিসির আওতায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে ভূ-গর্ভস্থ উপকেন্দ্র নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী পরিষদে (একনেক) অনুমোদিত হয়। ব্যয় ধরা হয় ৯৫০ কোটি ৩৯ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার ও ডিপিডিসির যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল।
উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ১ জুলাই প্রকল্পটি শুরু হয়ে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা ছিল। মাঝে এক দফায় ব্যয়বৃদ্ধি ব্যাতিরেকে শুধু প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কোনো ভৌত কাজ সম্পন্ন হয়নি। কেবল সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও নকশা প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তবে এ কাজের বিপরীতে এখনও বিলের পুরো অর্থ পায়নি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তাদের সেই পাওনা পরিশোধের স্বার্থে ফের প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠিয়েছে ডিপিডিসি। এ লক্ষ্যে আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে মেয়াদ বাড়ানো হলেও যে উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল, সে কাজ আর করা হবে না। কেবল পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পাওনা পরিশোধ সম্পন্ন হলেই প্রকল্পটি অসম্পন্ন রেখেই এটির ইতি টানা হবে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলেও পরামর্শক নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক নানা ব্যয় মিলে ৬৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এ অর্থের পুরোটাই অপচয় হিসেবে পর্যবসিত হবে।
ডিপিপিতে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর কাওরানবাজারে ১৩২/৩৩/১১ কেভি ভূ-গর্ভস্থ গ্রিড উপকেন্দ্র নির্মিত হবে। বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার ক্ষমতাবর্ধন, সরবরাহ নিশ্চিত এবং বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মাঝে ভারসাম্য আনা ছিল এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য। এ উপকেন্দ্রে থাকবে মোট ছয়টি পাওয়ার ট্রান্সফরমার, ট্রান্সফরমার কুলিং সিস্টেম, জিআইএস এবং সুইচগিয়ার। এছাড়া ভূ-গর্ভস্থ উপকেন্দ্র ভবন, ক্যাবল টানেল, আন্ডারগ্রাউন্ড সঞ্চালন লাইন ও অন্যান্য ডিস্ট্রিবিউশন ফ্যাসিলিটিও থাকার কথা।
গত অর্থবছরের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছিল ৫৮ কোটি ৪৩ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। সে হিসাবে আর্থিক অগ্রগতি ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে, বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ৬ কোটি ২১ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এ অর্থবছরেই প্রকল্পটি সমাপ্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ফলে সবমিলিয়ে এ প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৬৪ কোটি ৬৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকা।
প্রকল্প কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্পের আওতায় অবকাঠামো নির্মাণকাজের আগের কাজগুলোই কেবল সম্পন্ন হয়েছে। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন, টেন্ডার ডকুমেন্ট প্রস্তুত করা এবং প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন। কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যে পরিমাণ অর্থ দরকার তার বরাদ্দ নেই। বরাদ্দ কম থাকায় উপযুক্ত ঠিকাদার পাওয়া যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এসব কারণে প্রথমিক সব ধরনের প্রস্তুতি সত্ত্বেও প্রকল্পটির ভৌত কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
প্রকল্পটির পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) হিসেবে আছেন ডিপিডিসির নির্বাহী প্রকৌশলী (প্ল্যানিং) মো. মেহেদী হাসান। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘প্রকল্পের মূল কাজ শুরুর আগে জাইকা জাপানি টেকনিক্যাল এক্সপার্ট টিম দিয়ে বছরখানেক কাজ করেছে। তারপর ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দরে টালমাটাল অবস্থা ছিল। যে কারণে প্রক্ষেপণে সমস্যা হচ্ছিল। প্রথম দফায় যে দরে টেন্ডার দেওয়া হয়েছিল, রি-টেন্ডারে গেলে আরও অনেক বেশি ব্যয় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রকল্পটি এখানেই শেষ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
অর্থের অপচয় হলো কি-না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের প্রকল্প বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ছিল। সংশ্লিষ্টদের অনেক লার্নিং হয়েছে। যদিও ব্যয়বহুল হওয়ায় সরকারকে প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে সরে আসতে হচ্ছে, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এমন প্রকল্প আবারও আসবে। তখন এখান থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতা কাজে দেবে।’
আদালতের দ্বারস্থ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান
জাইকার অর্থায়নে হওয়া এ প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের জন্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এবং সুপার স্ট্রাকচারের ডিজাইন কো-অর্ডিনেশনে স্থানীয় আর্কিটেকচারাল প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের ‘বেসিক’ ডিজাইন, দরপত্র দলিল ও ব্যয় প্রাক্কলন সম্পন্ন করে। দরপত্র আহ্বান করা হলে আন্তর্জাতিক ঠিকাদার প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ অর্থ দাবি করে। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, মালামালের মূল্য বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি বিবেচনায় সংশোধিত ব্যয় প্রাক্কলন করে ২০২৩ সালের ৬ জুলাই পুনরায় দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এটি ছিল মূল প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে ‘অত্যধিক’। ওই বছরের ১৩ জুলাই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সভায় ভূ-গর্ভস্থ উপকেন্দ্রের পরিবর্তে ভূ-উপরিস্থ প্রচলিত উপকেন্দ্র নির্মাণে অর্থায়নে জাইকাকে অনুরোধ করা হয়। সে বছরের ২৮ আগস্ট জাইকা এ প্রস্তাবে অসম্মতি জানায়।
২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিবের সভাপতিত্বে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), জাইকাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি সভা হয়। ওই সভায় প্রকল্পের সংশোধিত প্রাক্কলিত ব্যয় ‘অনেক বেশি’ হওয়ায় কাজ অসমাপ্ত রেখে প্রকল্পটি শেষ করার সিদ্ধান্ত হয়। প্রকল্প শেষ করার প্রস্তুতি হিসেবে মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। প্রকল্পে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও চুক্তি বাতিল করা হয়।
তবে ২০২৪ সালের ৩০ জুনের মধ্যে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের চূড়ান্ত বিল নিষ্পত্তি করতে পারেনি ডিপিডিসি। পাওনার জন্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ২০২৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব আরবিট্রেশনে মামলা করে। ডিপিডিসি পরবর্তীতে অলটারনেটিভ ডিসপুট রিসোলিউশনের (এডিআর) মাধ্যমে মামলাটি নিষ্পত্তি করে। এ বছরের ৩ জুলাই কনসেন্ট অ্যাওয়ার্ড হিসেবে আদালত আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে ৫৫ মিলিয়ন জাপানিজ ইয়েন (প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা) পরিশোধের নির্দেশ দেয়।
এমন পরিস্থিতিতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পাওনা অর্থ পরিশোধ করে অসমাপ্ত রেখে প্রকল্পটি শেষ করতে ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় চেয়ে ডিপিপি সংশোধনের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। এতে আইএমইডি সম্মতি দিয়েছে। এখন পরিকল্পনা কমিশনের পিইসি সভায় এ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে।
পিইসি সভার কার্যপত্রে অবশ্য বলা হয়েছে, প্রকল্প থেকে কোনো কাঙ্ক্ষিত আউটপুট অর্জন হয়নি, তবে ব্যয় হচ্ছে ৬৪ কোটি টাকার বেশি। এটি নিয়ে সভায় আলোচনা হবে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ ধরনের ‘ব্যতিক্রম ও ব্যয়বহুল’ প্রকল্প নেওয়ার আগে যথাযথভাবে ফিজিবিলিটি স্টাডি করে ব্যয় প্রাক্কলন ও বাস্তবায়নে সচেতন থাকার কথাও বলা হয়েছে।