leadT1ad

মৎস্য অধিদপ্তরের প্রকল্প

মাছের নামে ‘পুকুর চুরির’ ছক

স্ট্রিম গ্রাফিক

ভুয়া বিল, গাড়ির অপব্যবহার, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর– মৎস্য অধিদপ্তরের অনেক প্রকল্পেই রয়েছে এমন অভিযোগ। এর মধ্যে ‘আগের ছকে’ই রংপুরে ৪৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই প্রস্তাবে অর্থ ব্যয়ের খাতগুলোতে এত বেশি অসংগতি যে খোদ পরিকল্পনা কমিশনই তুলেছে ১৩ ক্ষেত্রে আপত্তি।

‘খরাপ্রবণ রংপুর বিভাগে টেকসই মৎস্যচাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প’ নামের প্রকল্পটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিকাংশ কেনাকাটায় অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজারদরের কয়েক গুণ বেশি।

৪৫ কোটি ২ লাখ ৭২ হাজার টাকার প্রকল্পটিতে সবচেয়ে বড় অসংগতি রয়েছে গাড়ির জন্য চাওয়া বরাদ্দে। এখানে তেল ও ড্রাইভার খরচ বাদে মাত্র একটি গাড়ি ভাড়া করতে চাওয়া হয়েছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। ৬০ মাসের জন্য এই ভাড়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ, তেল ও চালকের বেতন বাদে প্রতি মাসে গাড়ির ভাড়া পড়বে ২ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে স্ট্রিম কথা বলে একজন গাড়ি বিক্রেতার সঙ্গে। তিনি বলেন, এই টাকায় তো ভালো মানের গাড়িই কেনা যায়।

৫৮টি মোটরসাইকেল কিনতে চাওয়া হয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। মাছ কাটার স্থান বা ‘ফিশ ড্রেসিং সেন্টার’ উন্নয়নে চাওয়া হয়েছে ১ কোটি টাকার বেশি। পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, এই খরচগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

প্রকল্পটি একেবারেই নতুন, কিন্তু আসবাবপত্র মেরামতে চাওয়া হয়েছে সাড়ে ১৪ লাখ টাকা। কম্পিউটার ও অফিস সরঞ্জাম মেরামতের জন্যও একই পরিমাণ টাকা ধরা হয়েছে। এ ছাড়া অফিসের কাগজ-কলম ও ‘অন্যান্য মনোহারী’ পণ্য কিনতে খরচ ধরা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। কর্মকর্তাদের ভ্রমণ ব্যয় চাওয়া হয়েছে ৬৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণের নামে প্রায় ৭০ লাখ এবং প্রযুক্তি প্রদর্শনীর নামে ৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকার আবদার করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তি

৪৫ কোটি টাকার এই প্রকল্পে পদে পদে অসংগতি, গরমিল ও অস্পষ্টতার ছাপ পেয়েছে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি)।

প্রকল্পের প্রধান খাত ‘মাছের আবাসস্থল উন্নয়ন’। সোজা কথায়, জলাশয় খনন বা পুনঃখনন। তবে এই খাতে চাওয়া হয়েছে ১১ কোটি ৪ লাখ টাকা, যা প্রকল্প ব্যয়ের মাত্র ২৫ শতাংশ। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, ৪৮ হেক্টর জলাশয়ের জন্য এই টাকা চাওয়া হলেও তা ঠিক কোথায়, কতটুকু মাটি কাটতে বা কোন জলাশয়ে খরচ হবে, তার বিস্তারিত বিবরণ নেই প্রস্তাবে। অথচ ডিপিপিতে (প্রকল্প প্রস্তাবনা) এই ব্যয়ের বিস্তারিত বিবরণ থাকা বাধ্যতামূলক।

যদি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনে হয় যে প্রাক্কলিত ব্যয় বেশি দেখানো হচ্ছে, সেক্ষেত্রে সেটা কমানোরও সুযোগ থাকে। ফাইনাল মিটিংয়ের পরেও কিছু সাজেশন থাকে। ওটা করে ফাইনালি অনুমোদন হয়। আবদুর রউফ, ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক, মৎস্য অধিদপ্তর

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ ৫ কোটি ৭৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা ধরা হয়েছে মৎস্যচাষ প্রযুক্তি প্রদর্শনীতে। ৯৬৪টি প্রদর্শনীর জন্য অধিদপ্তর এই খরচ ধরেছে। কিন্তু এই প্রদর্শনী কোথায় হবে, খামারগুলো কীভাবে নির্বাচন করা হবে তা নেই ডিপিপিতে। এ ছাড়া প্রকল্পে ১১ হাজার ৬০০ সুফলভোগীকে প্রশিক্ষণ দিতে ৩ কোটি ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা চাওয়া হয়েছে। তবে এই হাজার হাজার লোক কারা, তাদের কীভাবে বাছাই করা হবে, তার কোনো রূপরেখা প্রস্তাবনায় নেই।

কমিশন বলছে, প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনীর জন্য কীভাবে স্থান বা ব্যক্তি নির্বাচন করা হবে, তা স্পষ্ট নয়।

কর্মকর্তাদের ‘অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ’ ও ‘অভিজ্ঞতা বিনিময় সফরে’র নামে যে ৬৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা চাওয়া হয়ে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। বলেছে—কারা এই সফরে যাবেন, কী বিষয়ে জ্ঞান নেবেন এবং তা প্রকল্পের কী কাজে আসবে?

প্রস্তাবে অনেক খাতেই বাজারদরের চেয়ে বেশি দাম ধরা হয়েছে এবং ব্যয়ের হিসাবে গরমিল আছে বলেও মন্তব্য করেছে কমিশন। এর মধ্যে ২ হাজার ৯০০ জনকে মাছ চাষের উপকরণ সহায়তা দিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া ৫৮টি মোটরসাইকেল কিনতে চাওয়া হয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। মাছ কাটার স্থান বা ‘ফিশ ড্রেসিং সেন্টার’ উন্নয়নে চাওয়া হয়েছে ১ কোটি টাকার বেশি। কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, এই খরচগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

নতুন প্রকল্পে অভয়াশ্রম মেরামতের জন্যও টাকা চাওয়া হয়েছে। সাতটি মৎস্য অভয়াশ্রম মেরামতে ১ কোটি ১৪ লাখ এবং ২৫টি নতুন অভয়াশ্রম তৈরিতে ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। কমিশন জানতে চেয়েছে, নতুন অভয়াশ্রমের স্থান কীভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। পুরোনোগুলো কেন এখনই মেরামত করতে হবে।

প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে খরচের পরিমাণ বা সংখ্যা উল্লেখ না করে ‘থোক’ হিসেবে টাকাও চাওয়া হয়েছে। অথচ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি পয়সার সুনির্দিষ্ট খাত থাকতে হয়।

যা বলছে মৎস্য অধিদপ্তর

মৎস্য অধিদপ্তরের প্রস্তাবটি নিয়ে গত সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা হওয়ার কথা ছিল। তবে সভার তারিখ পিছিয়ে ২২ ডিসেম্বর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আবদুর রউফ।

পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির চিঠি পেয়েছেন জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, ‘ওদের (পরিকল্পনা কমিশন) সাজেশন অনুযায়ী আমরা ঠিকঠাক করি। মিটিংয়ের আগে আমরা করেই নিয়ে যাব।’

বাজারদরের চেয়ে কেনাকাটায় বেশি দাম ধরার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যদি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনে হয় যে প্রাক্কলিত ব্যয় বেশি দেখানো হচ্ছে, সেক্ষেত্রে সেটা কমানোরও সুযোগ থাকে। ফাইনাল মিটিংয়ের পরেও কিছু সাজেশন থাকে। ওটা করে ফাইনালি অনুমোদন হয়।’

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত