শীতের সকালে ঢাকা যেন এক দীর্ঘশ্বাসের শহর। ডিসেম্বরের কুয়াশা শুধু নদীর ওপর ভাসে না, ভাসে রাজনীতির ময়দানেও। সেই কুয়াশার আস্তরণ সরিয়ে গত পরশু (২৫ ডিসেম্বর) এয়ারপোর্ট থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ক্ষণে ক্ষণে চমক দেখা গেল বহু বছর পর। এ দিন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শাহজালাল বিমানবন্দরে নেমেই জুতা খুলে খালি পায়ে মাটি স্পর্শ করেন। একমুঠো মাটি হাতেও তুলে নেন। পরে পূর্বাচলে গিয়ে মঞ্চে নিজের জন্য নির্ধারিত আলিশান চেয়ার সরিয়ে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আরেকবার চমক দেন।
সেদিন তারেক রহমানকে স্বাগত জানাতে বগুড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসেছিলেন মকছেদ আলী। তাঁর পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কথা হলো দু-চারটা। মকছেদ বললেন, ‘১৭ বছর একটা মানুষ দ্যাশে থাকবার পারেনি। হামরা দ্যাশে থ্যাকাও পলায়া পলায়া বেড়াইছি। নিজের বাড়িৎ থাকপার পারিনি। ধানের খেতে লুক্যা থাকিছি। কব্বরের মদ্যে লুক্যা থাকিছি। কী কষ্টের দিনগুলো যে গেছে! আজগা আনন্দের দিন। সেই আনন্দ ভাগ করার জন্য আসিছি।’
মধ্যবয়সী মকছেদের কথা থেকে বোঝা যায়, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনটা কোনো সাধারণ ফেরা নয়; এটি যেন হারিয়ে যাওয়া এক গল্পের দ্বিতীয় অধ্যায়। সেই অধ্যায়ের গল্পগুলো আমরা দেখতে পাব সামনের দিনগুলোতে।
কিন্তু ঘটমান বর্তমানেই যে গল্পগুলো রচিত হচ্ছে, সেগুলোও আমাদের ঘুমোতে দেয় না। সেরকম এক গল্পের নাম ‘শরিফ ওসমান হাদি’। গতকাল শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) হাদি হত্যার বিচারের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল শাহবাগ মোড়। শাহবাগের এই প্রজন্মের চোখে ক্রোধ, মুখে স্লোগান—‘হাদি হত্যার বিচার চাই, আমরা সবাই হাদি হব, যুগে যুগে লড়ে যাব।’
গল্পের নাম জাইমা রহমানের বিড়াল ‘জেবু’। আমি আর আবিদ বিস্মিত হয়ে দেখলাম, জেবুর নামে ফেসবুকে পেজও খোলা হয়ে গেছে। কেউ লিখছে, ‘বিড়ালটিই আসল শান্তির দূত’, কেউ আবার ব্যঙ্গ করে লিখেছে, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলার যে অবস্থা, জেবু কি নিরাপদ এই মৃত্যু-উপত্যকায়?’
স্লোগানমুখরিত বিকেলে কথা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিবের সঙ্গে। জাতীয় জাদুঘরের মাথার ওপর দিয়ে ক্লান্ত সূর্যটা নেমে যাচ্ছে। সেই কনে দেখা আলোয় দেখলাম, সাকিব কিছুটা শঙ্কিত গলায় বললেন, ‘বিচার হবে তো?’ পরক্ষণেই কণ্ঠে তেজ ফিরে এনে বললেন, ‘রাষ্ট্রীয় বিচারের ঘড়ি মাঝপথে থমকে যেতে পারে, কিন্তু জনতার বিচারের ঘড়ি কখনো থামে না। আমরা ন্যায্য বিচার আদায় করেই ঘরে ফিরব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তরুণের যে চাওয়া, তা তো আপামর জনসাধারণের। আমার, আপনার, সবার। তাঁর কাঁধে সংহতির হাত রেখে বিদায় নিলাম।
হেঁটে হেঁটে এলাম বাংলামটরের দিকে। ততক্ষণে সূর্য ঘুমিয়ে পড়েছে। রাস্তায় রাস্তায় জ্বলে উঠেছে নিয়ন বাতি। বাংলামটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে দেখা হলো পুরোনো বন্ধু আবিদের সঙ্গে। এখন সে পুরোদস্তুর ব্যাংকার হলেও ছাত্রজীবনের বই পড়ার পুরোনো অভ্যাস এখনো ছাড়তে পারেনি। তাই প্রায়ই চলে আসে এখানে।
আবিদের চোখেমুখে শীতের কুয়াশার মতো বিষণ্নতার ছাপ। গল্পান্তরে জানলাম, জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির জোট বাঁধার গুঞ্জনই তাঁর বিষণ্নতার কারণ। আবিদ ভাঙা গলায় বলল, ‘রাজনীতির মাঠে এনসিপি সাধারণত ধর্মনিরপেক্ষতার সুরে কথা বলে, সেই দলই এখন জামায়াতের সঙ্গে জোটে যেতে চাইছে! এ এক অদ্ভুত রসায়ন!’
বুঝতে অসুবিধা হয় না, আবিদের মতো বিস্মিত আরও অনেকে। বিশেষত শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলিম যে শ্রেণিটা এনসিপিকে নিয়ে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখেছিল, তারা ভীষণ ভেঙে পড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দলের ভেতরেও। তার প্রমাণ এনসিপি চট্টগ্রাম মহানগরের প্রধান সমন্বয়কারী মীর আরশাদুল হকের পদত্যাগ। আদর্শিক দ্বন্দ্বে যখন নিজের ঘরের মানুষরাই পদত্যাগ করেন, তখন সেই জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রশ্নটা বাতাসে ঝুলে রইল অনেকক্ষণ।
তারেক রহমান, জাইমা রহমান ও তাঁদের প্রিয় ‘জেবু’। ছবি: তারেক রহমানের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়াএর মধ্যে আমরা ফেসবুকে ঢুকলাম। দেখলাম নিউজফিডজুড়ে এক মিউ মিউ গল্প। গল্পের নাম জাইমা রহমানের বিড়াল ‘জেবু’। আমি আর আবিদ বিস্মিত হয়ে দেখলাম, জেবুর নামে ফেসবুকে পেজও খোলা হয়ে গেছে। কেউ লিখছে, ‘বিড়ালটিই আসল শান্তির দূত’, কেউ আবার ব্যঙ্গ করে লিখেছে, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলার যে অবস্থা, জেবু কি নিরাপদ এই মৃত্যু-উপত্যকায়?’
আলোচনা থেকে ছাড় পাচ্ছে না জাইমার পোশাক প্রসঙ্গও। তারেক রহমান দেশে ফিরেছেন, হাদির বিচার চেয়ে উত্তাল শাহবাগ, দেশ পুড়ছে, কিন্তু মানুষের কৌতূহল থামল জাইমার পোশাকে! কী পরছেন, কেন পরছেন, হিথ্রো বিমানবন্দরে এক পোশাক, প্লেনের ভেতরে এক পোশাক, আবার ঢাকায় শাহজালাল বিমানবন্দরে যখন নামলেন, তখন আরেক পোশাক! এ নিয়ে যুক্তিতর্ক, প্রশংসা-সমালোচনার শেষ নেই।
এটা কি আমাদের সামাজিক মনস্তত্ত্ব, নাকি রাজনৈতিক পপ-সংস্কৃতির বিস্তার? হয়তো দুটোই। শাসকের চেহারা যত আলোচিত, শাসকের পরিবারের পোশাকও তত আলোচিত। এটাই দক্ষিণ এশীয় বাস্তবতা। নাগরিক যখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বাস করে, তখন সে পোশাকের ভাঁজেও অর্থ খোঁজে, রঙেও বার্তা খোঁজে।
তবে সব বার্তা সব সময় বোঝা যায় না। যেমন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) খোদা বকশ চৌধুরীর হঠাৎ পদত্যাগ। রাজনীতির দাবাবোর্ডে একেকটি ঘুঁটি সরলে বোর্ডের ভারসাম্য কেঁপে ওঠে। খোদা বকশ ছিলেন সেই বোর্ডের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘুঁটি। তাঁর সরে দাঁড়ানো মানে কেবল এক ব্যক্তির প্রস্থান নয়, বরং আস্থার এক টুকরো ইট খুলে যাওয়া। সব মিলিয়ে তাঁর হঠাৎ প্রস্থান ধোঁয়াশাপূর্ণ একটি বার্তাই বটে।
তারেক রহমান দেশে ফিরেছেন, হাদির বিচার চেয়ে উত্তাল শাহবাগ, দেশ পুড়ছে, কিন্তু মানুষের কৌতূহল থামল জাইমার পোশাকে! কী পরছেন, কেন পরছেন, হিথ্রো বিমানবন্দরে এক পোশাক, প্লেনের ভেতরে এক পোশাক, আবার ঢাকায় শাহজালাল বিমানবন্দরে যখন নামলেন, তখন আরেক পোশাক। এ নিয়ে যুক্তিতর্ক, প্রশংসা-সমালোচনার শেষ নেই।
এদিকে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে জনমনে অনিশ্চয়তার কুয়াশা আরও ঘন। আদৌ কি নির্বাচন হবে? ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৬ ঘোষিত তারিখ, কিন্তু ঘোষণাই কি নিশ্চয়তা? রাজনীতির ময়দানে তারেক রহমানের ফেরা নতুন হিসাব তৈরি করেছে, শাহবাগের বিচার আন্দোলন নতুন চাপ তৈরি করেছে, জোটের গুঞ্জন নতুন সন্দেহ তৈরি করেছে। আর এই সবকিছুর ভিড়ে নির্বাচন যেন এক ভোকাট্টা ঘুড়ি, যার নাটাই কার হাতে তা-ই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
অন্যদিকে আরেকটা বড় প্রশ্ন ঘাড়ের ওপর তপ্ত নিশ্বাস ফেলছে। তার নাম আইনশৃঙ্খলা। সারা দেশে অস্থিরতার আগুন এখন আর অজানা নয়, বাস্তব। হিন্দু যুবক দীপু দাসকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। এটা শুধু একটি হত্যা নয়, এটা ভয় উৎপাদনের কারখানা। ভয় যখন উৎপাদিত হয়, তখন তা ঘরে ঘরে সরবরাহ হয়।
লক্ষ্মীপুরে বিএনপি নেতার বাড়িতে আগুন, তাঁর দুটি ছোট মেয়ের আগুনে পুড়ে মৃত্যু! এই ঘটনাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন দুঃখ নয়; এগুলো হলো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতার ধারাবাহিক ট্র্যাজেডি। চট্টগ্রামে এনসিপি নেতার পদত্যাগও যেন সেই ট্র্যাজেডিরই পার্শ্বসুর। আস্থা হারিয়ে ফেলার নীরব প্রতিবাদ।
সারা দেশ এখন একসঙ্গে দুই আগুনে পুড়ছে—একটা রাজনীতির, আরেকটা নৈরাজ্যের। রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের উল্লাসের পাশে দাঁড়িয়ে আছে বিচারহীনতার শঙ্কা, ভোটের জোটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আদর্শের সংকট, সোশ্যাল মিডিয়ার বিড়ালের পাশে দাঁড়িয়ে আছে মানুষের একাকীত্ব, পোশাকের রঙের পাশে দাঁড়িয়ে আছে রক্তের রঙ, আর নির্বাচনের তারিখের পাশে দাঁড়িয়ে আছে অজানা ভবিষ্যৎ।
ইতিহাস ও মিথ আমাদের শেখায়, রাজনীতি হলো নদীর মতো। কখনো শুকায়, কখনো ভাঙে, কখনো প্লাবন আনে। ১৭ বছর পর তারেক রহমানের ফেরা সেই নদীরই প্লাবনের মতো, দীর্ঘ খরা শেষে এক বড় স্রোত। কিন্তু স্রোত বড় হলেই যে পানি স্বচ্ছ হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পানি ঘোলা হলে তলদেশের বিচার, সত্য ও ভবিষ্যৎ দেখা যায় না। আর তাই এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো, স্রোতকে জনতার কল্যাণে প্রবাহিত করা, বিচারকে রাজনীতির গহ্বর থেকে উদ্ধার করা, নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার কুয়াশা থেকে বের করে আনা আর আইনশৃঙ্খলাকে আগুনের গল্প থেকে ফিরিয়ে আনা।
ফেব্রুয়ারি আসবে। নির্বাচনও হয়তো আসবে। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি হলো—রাষ্ট্র যেন বিচারের গল্পে ফিরে আসে, নিরাপত্তার গল্পে ফিরে আসে, নাগরিকের গল্পে ফিরে আসে। কারণ এই দেশ কোনো ‘যুবরাজের’ একার নয়, কোনো জোটের একার নয়, কোনো ভাইরাল বিড়ালেরও নয়। এই দেশ হলো ১৮ কোটি গল্পের সমষ্টি। সেই গল্পগুলো বাঁচলে দেশ বাঁচবে।
মারুফ ইসলাম: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক