leadT1ad

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ফের খাদের কিনারায়

সাকলাইন রিজভি
সাকলাইন রিজভি

প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭: ৪৭
স্ট্রিম গ্রাফিক

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদির হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে নতুন করে সহিংসতা-বিশৃঙ্খলার জন্ম দিয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট এই গণঅভ্যুত্থানের ফলে সরকারের পতন ও শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হাদি আসন্ন সংসদ নির্বাচনের ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। নির্বাচন কমিশন সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার একদিন পর ১২ ডিসেম্বর হাদির ওপর এই হামলা হয়।

হাদি তাঁর ‘ভারতবিরোধী’ রাজনীতির জন্য পরিচিত ছিলেন। ১২ ডিসেম্বর মাথায় গুলি লাগার পর ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। শুরুতে যা বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার মর্মান্তিক ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছিল, হামলার কয়েক দিনের মধ্যে ও বিশেষ করে তাঁর মৃত্যুর পর তা আরও সুদূরপ্রসারী রূপ নেয়। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ও ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর ঘটনাটি নতুন মাত্রা পায়।

হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে যে যুবক গুলি চালিয়েছে, সে আওয়ামী লীগের কর্মী এবং পালিয়ে বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন বলা হচ্ছে। হাদির মৃত্যুর খবরে ১৮ ডিসেম্বর রাতে, ক্ষুব্ধ জনতা দেশের দুটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক— প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে হামলা চালায়। তাঁরা প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটেও ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করে। হামলাকারীদের অভিযোগ, এই প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতের সঙ্গে যুক্ত ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থক।

চট্টগ্রামে বিক্ষোভকারীরা ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের কার্যালয়েও বিক্ষোভ করে ও পাথর ছোড়ে, যা নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। গত এক সপ্তাহে ভারত এবং ভারত-সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার ঘটনা বেড়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের গঠিত রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’র শীর্ষ নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ১৫ ডিসেম্বর বলেছেন, ভারত যদি আওয়ামী লীগ নেতা ও হাদির ওপর হামলায় অভিযুক্তদের আশ্রয় দেওয়া বন্ধ না করে। বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে প্রতিরোধের আগুন সীমানার বাইরেও ছড়িয়ে পড়বে। যেহেতু আপনারা আমাদের অস্থিতিশীলকারীদের আশ্রয় দিচ্ছেন, আমরাও সেভেন সিস্টার্সের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দেব।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যকে ‘সেভেন সিস্টার্স’ বলা হয়। ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চল বিদ্রোহ ও অশান্তিতে জর্জরিত ছিল, যা বর্তমানে অনেকাংশে দমন করা হয়েছে। হাসনাত আবদুল্লাহ সতর্ক করে বলেন, ‘আমি ভারতকে স্পষ্টভাবে বলতে চাই– আপনারা যদি এমন শক্তিকে আশ্রয় দেন যারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, সম্ভাবনা, ভোটাধিকার ও মানবাধিকারকে সম্মান করে না, তবে বাংলাদেশ তার জবাব দেবে।’

শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) দোষী সাব্যস্ত হওয়া ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার বারবার ভারতকে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য অনুরোধ জানালেও দেশটি চুপ রয়েছে।

হাসনাত আবদুল্লাহর বিবৃতির পর, ভারতবিরোধী উসকানিমূলক বক্তব্য ও হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত নিরাপত্তা ইস্যুতে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করে। ভারতীয় কর্মকর্তারা ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের বিরুদ্ধেও হুমকির ইঙ্গিত দেন। এর থেকে স্পষ্ট হচ্ছে যে, নয়াদিল্লি এই ঘটনাকে কেবল বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক গোলযোগ নয়, বরং সরকারি ও কূটনৈতিক পরিবেশের সাধারণ অবনতি হিসেবে দেখছে।

পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন একদল বিক্ষোভকারী ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন অভিমুখে মিছিলের ঘোষণা দেয়। এই মিছিলে শেখ হাসিনা ও তাঁর স্বৈরাচারী শাসনামলে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধে অভিযুক্ত অন্যান্য সন্দেহভাজনদের প্রত্যর্পণের দাবি জানানো হয়। তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে তথাকথিত ভারতীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। যদিও পুলিশি বাধার কারণে মিছিলটি ভারতীয় হাইকমিশন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। তবুও এই মিছিলের প্রভাব ইতোমধ্যে টানাপোড়েনে থাকা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আরও খারাপ করেছে, বিশেষ করে যখন বাংলাদেশে জনমত ক্রমশ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে ভারতের দেওয়া বিবৃতির প্রতিক্রিয়ায়, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ঢাকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিষয়ে ভারতীয় পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে তার বিষয়গুলো পরিচালনা করবে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে আবদুল্লাহর মন্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। ভারতকে খণ্ডিত করার যেকোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ভারতীয় প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, ‘দেখুন, আমাদের একটা চিকেন’স নেক (শিলিগুড়ি করিডোর) আছে। কিন্তু বাংলাদেশের দুটো চিকেন’স নেক আছে। বাংলাদেশ যদি আমাদের চিকেন’স নেক-এ আক্রমণ করে, আমরা বাংলাদেশের দুটো চিকেন’স নেক-এই আক্রমণ করব। মেঘালয়ে অবস্থিত বাংলাদেশের চিকেন’স নেক, যা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরকে সংযুক্ত করে, তা ভারতের চিকেন’স নেক-এর চেয়েও সরু ও এটি ঢিল ছোড়া দূরত্বে অবস্থিত।’

হাদির রাজনৈতিক পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জুলাই অভ্যুত্থানের নেতা হিসেবে তিনি তাঁর ভারতবিরোধী রাজনীতির জন্য পরিচিত। তাঁর হত্যাকাণ্ডকে অভ্যুত্থানের ওপর প্রতীকী আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে। এমনকি আনুষ্ঠানিক নিশ্চিতকরণ ছাড়াও, হাদির হামলাকারীর সীমান্ত পার হওয়ার গুজব বাংলাদেশে চরম জনরোষ তৈরি করেছে।

ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে যে তাদের ভূখণ্ড আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তারা জোর দিয়ে বলেছে, তারা বাংলাদেশের প্রতি বৈরী কোনো কার্যকলাপ সহ্য করে না। তবে, দৃশ্যমান যৌথ যোগাযোগ বা সমন্বিত তদন্তের বয়ান না থাকায় জল্পনা ডালপালা মেলেছে। আস্থার এই সংকটের পরিবেশে রাজনৈতিক কুশীলব, সোশ্যাল মিডিয়া মন্তব্যকারী ও উগ্র ডানপন্থী কর্মীরা সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছে। ফলে জনমত আরও কঠোর হয়েছে ও উভয় পক্ষের কূটনৈতিক পরিসর সংকুচিত হয়েছে।

ভারতের বাংলাদেশবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি অনেকাংশে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে ভারতবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দেওয়ার ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ও ২০০০-এর দশকের শুরুতে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসামের (উলফা) মতো গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছিল, যা ভারতের স্মৃতিতে স্থায়ী ছাপ রেখেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, এই গোষ্ঠী আশ্রয়ের চেয়েও বেশি কিছু পেয়েছিল।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটি ও নেটওয়ার্ক ভেঙে দেয় ও বেশ কয়েকজন শীর্ষ উলফা নেতাকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর শেখ হাসিনার শাসনামলে নিরাপত্তা ইস্যুতে ঢাকা-দিল্লির এই সহযোগিতা ভারতের পক্ষ থেকে তাঁর সরকারের প্রতি জোরালো সমর্থনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনে কার্যত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সেই সহযোগিতার অবসান হয়েছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা সহযোগিতা উল্টে ফেলার কোনো ইঙ্গিত দেয়নি। তবুও ক্রমবর্ধমান দ্বিপক্ষীয় অবিশ্বাস ও পর্যায়ক্রমে বৈরী বাক্যবিনিময়ের বিপরীতে পাকিস্তান এবং চীনের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্থিতিশীল হচ্ছে না।

আঞ্চলিক সংযোগ বা কানেক্টিভিটির প্রেক্ষাপটে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে ড. ইউনূসের মন্তব্যও এসেছিল। কিন্তু নয়াদিল্লি ইউনূসের এই মন্তব্যকে উসকানিমূলক হিসেবে দেখে। বিশেষ করে ২০২৩ সাল থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, বিশেষত মণিপুরে অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চলমান সংকটের মধ্যে দিল্লির জন্য বাংলাদেশ থেকে আন্তঃসীমান্ত হস্তক্ষেপের যেকোনো প্রচেষ্টা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

ভারতীয় বিষয়ে বাংলাদেশের হস্তক্ষেপ এই মুহূর্তে কেবলই বাগাড়ম্বর। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায়, নেতাদের জন্য শক্তি ও জাতীয়তাবাদ প্রদর্শনের সহজ উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতবিরোধী কথাবার্তা। দিল্লির উদ্বেগ ভারতবিরোধী বাগাড়ম্বর নিয়ে ততটা নয়, যতটা আসন্ন রাজনৈতিক পালাবদলের ফলে নিরাপত্তা সহযোগিতা শিথিল হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে। বাংলাদেশে চলমান সহিংসতা এক সময়ের ঘনিষ্ঠ দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কের জন্য ভালো কোনো ইঙ্গিত বহন করছে না।

লেখক: বাংলাদেশি সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী

দ্য ডিপ্লোম্যাটে সাকলাইন রিজভির নিবন্ধ অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ

Ad 300x250

সম্পর্কিত