leadT1ad

নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি কি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে

বাহাউদ্দিন ফয়েজী
বাহাউদ্দিন ফয়েজী

প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪: ২২
স্ট্রিম গ্রাফিক

আগামী বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং রাষ্ট্র সংস্কারের ওপর গণভোটের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বাংলাদেশ। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা দেশটির রাজনৈতিক দৃশ্যপটে নিঃসন্দেহে একটি মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। দেড় বছরের সংস্কার প্রক্রিয়া ও নানাবিধ ঘটনার পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই আকাঙ্ক্ষিত নির্বাচন।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়ার শুরু হয়েছিল। অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন ও ভারতে পালিয়ে যান। বর্তমানে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নতুন করে বিক্ষোভের মুখে পড়ে, বিশেষ করে সংস্কারে বিলম্বের কারণে। পাশাপাশি নির্বাচনের তারিখ নিয়ে গভীর মতভেদ দেখা দেয়। অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম কয়েক মাস নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ প্রকাশে গড়িমসি করে। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসন্তোষ বেড়েছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রথমে ২০২৬ সালের জুন, এরপর এপ্রিল এবং চূড়ান্তভাবে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

ভোটাররা নতুন আইনপ্রণেতাদের নির্বাচন করবেন, শুধু মাত্র এই কারণেই আসন্ন নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং ‘জুলাই চার্টার’ বা জুলাই সনদ নামে পরিচিত প্রস্তাবিত সংস্কার প্যাকেজের ওপর গণভোটেও অংশ নেবেন ভোটাররা। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের পর তৈরি এই রাষ্ট্র সংস্কার পরিকল্পনায় নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা কমানো, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা শক্তিশালী করা এবং নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিগত সরকারের সময়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপব্যবহার নিয়ে যে বিতর্ক ছিল, তা রোধ করাও এই সংস্কারের লক্ষ্য।

মূল উদ্দেশ্য হলো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দাবি পূরণ করে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরও বেশি জনমুখী ও জবাবদিহিমূলক করা। তবে গণভোট নিজেই কিছু বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

নির্বাচনী প্রক্রিয়া

২০২৬ সালের সাধারণ নির্বাচন অন্তর্বর্তী প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে একটি নতুন ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। ৩০০ আসনে প্রায় ১২ কোটি ৭৬ লাখ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিরা ডাকযোগে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। এই পদক্ষেপকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দেশের সীমানার বাইরেও ভোটাধিকার সম্প্রসারণের ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এছাড়া আসন্ন নির্বাচনে ভোটগ্রহণের সময় আট ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে নয় ঘণ্টা করা হয়েছে। এই সংস্কারগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আস্থা ফেরানো এবং নির্বাচনের নিরাপত্তা ও সততা নিশ্চিত করার বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ।

দলগুলোর ভেতরে বিভাজনের এই বহুমুখী সংঘাত নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে পারে; যা শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

নির্বাচনের নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে নিয়মিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সেনা সদস্যদেরও মোতায়েন করা হবে। শেখ হাসিনার শাসনামলে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়া নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা ফেরাতে এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

প্রধান দলগুলোর প্রতিক্রিয়া

গত ১১ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সময় ড. ইউনূস এই নির্বাচন ও গণভোটকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রায় ‘গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক’ হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই নির্বাচনটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পথ প্রশস্ত করবে। এতে দেশের গভীর রাজনৈতিক বিভাজন দূর হবে। ড. ইউনূস প্রতিশ্রুতি দেন, শেখ হাসিনার আমলের কারচুপিপূর্ণ নির্বাচনগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীতে আসন্ন নির্বাচন হবে উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক এবং সুষ্ঠু।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-সহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যে নির্বাচনের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপিকে আসন্ন নির্বাচনে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে। জামায়াতে ইসলামীও রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে জড়িত ছাত্রনেতাদের দ্বারা গঠিত এনসিপি রাজপথের আন্দোলনে প্রভাবশালী শক্তি হলেও ভোটারদের মধ্যে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। রাজপথের শক্তিকে নির্বাচনী সমর্থনে রূপান্তর করতে তাদের সংগ্রাম করতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, হাসিনার দল আওয়ামী লীগ এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বলেছে, ইউনূস সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবেন না। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। ফলে দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।

গত নভেম্বর মাসে ছাত্র অভ্যুত্থানের সময় নৃশংসতাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।

এই সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও দেশে অশান্তির হুমকি ঘনীভূত হচ্ছে।

অশান্তির অশনিসংকেত

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডাদেশের পর তাঁর সমর্থকরা, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এর আগে বলেছিলেন, যদি ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে তাঁর মায়ের দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া না হয়, তবে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা রাস্তায় নামবে এবং নির্বাচন প্রতিহত করবে।

ওয়াজেদ দাবি করেছেন, তিনি ও হাসিনা দেশের ভেতরে দলের সব নেতা ও কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তিনি ব্যাপক বিক্ষোভ ও সম্ভাব্য সংঘাতের সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দলের লক্ষ লক্ষ কর্মী ও কোটি কোটি সমর্থক মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত।

ওয়াশিংটন ডিসি থেকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওয়াজেদ বলেন, ‘ব্যাপক বিক্ষোভ হবে... সংঘাত হবে।’

অশান্তির এই হুমকিগুলো দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জটিলতা সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ফ্রন্টে উত্তেজনা বাড়ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষের আশঙ্কা তো আছেই, সেই সঙ্গে বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপির মতো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আওয়ামী লীগের সংঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

একই সঙ্গে, হাসিনাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করায় যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তাতে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে সংঘাত বাড়তে পারে। এই দুই দলেরই আওয়ামী লীগের প্রতি দীর্ঘদিনের বৈরিতা রয়েছে। অতীতে তারা হাসিনার বিরোধিতায় একজোট হলেও এখন তারা ক্ষমতা ও প্রভাবের জন্য একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। বিএনপি ও জামায়াতের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হাসিনা-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অস্থিতিশীলতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এছাড়া বিএনপি ও জামায়াতের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও অশান্তি উসকে দিতে পারে।

দলগুলোর ভেতরে বিভাজনের এই বহুমুখী সংঘাত নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে পারে; যা শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক বিভাজন গভীর হওয়ার ও আওয়ামী লীগের সংঘাতের হুঁশিয়ারির কারণে পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, বিবাদমান পক্ষগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করা ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা—পরিস্থিতি যাতে আরও বিশৃঙ্খল না হয়, সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে। এই উত্তেজনা যদি সতর্কভাবে সামাল দেওয়া না হয়, তবে তা কেবল নির্বাচনকেই ব্যাহত করবে না, বরং বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলবে।

আসন্ন নির্বাচন দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার সক্ষমতার পরীক্ষা নেবে। তবে ইতিবাচক দিক হলো, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচন ও রাষ্ট্র সংস্কারের গণভোট বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথের জন্য একটি সন্ধিক্ষণ। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজানোর এই সুযোগ কেবল নতুন সরকার নির্বাচনের বিষয় নয়, বরং দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর দিকনির্দেশনাও ঠিক করবে।

জাতি যখন এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তখন বিশ্বের দৃষ্টি থাকবে বাংলাদেশের ওপর—কীভাবে দেশটি বৃহত্তর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশের জন্য বাজি এর চেয়ে বেশি আর কখনোই ছিল না।

বাহাউদ্দিন ফয়েজী: ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক। তিনি দ্য ডিপ্লোম্যাট, দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট, ইন্ডিয়ান ডিফেন্স রিভিউ, জার্নাল অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স এবং ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে লেখালেখি করেন।

নিবন্ধটি দ্য ডিপ্লোম্যাটে থেকে অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত