leadT1ad

তারেক রহমানের ভাঙন ঠেকানোর ম্যাজিক, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে কেন ব্যতিক্রম?

মাইনুল ইসলাম
মাইনুল ইসলাম
ঢাকা

২০০৭ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই বিএনপির রাজনীতি কার্যত সংকটের ভেতর দিয়ে গেছে। স্ট্রিম গ্রাফিক

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বড় দলের সংকট মানেই সাধারণত ভাঙন। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা, শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতি, রাষ্ট্রীয় চাপ ও বিতর্কিত নির্বাচন— এসব একসঙ্গে হলে দল টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), বাংলাদেশের ন্যাপ, জাসদ, বাসদ বা জাতীয় পার্টির ইতিহাসে এমন নজির বহুবার দেখা গেছে। এই প্রেক্ষাপটে দল ভাঙা যেন দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির এক ধরনের নিয়মিত পরিণতি।

এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গত দেড় দশক ধরে যেভাবে বড় কোনো বিভাজন ছাড়াই টিকে আছে, তা সত্যিই ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে নানা উপাদানের কথা আসে—রাষ্ট্রীয় দমননীতি, দলীয় সাংগঠনিক সংস্কৃতি, ক্ষমতার বাইরে থাকার বাধ্যতামূলক ঐক্য। তবে এসবের মধ্যেই তারেক রহমানের ভূমিকার কথাই বারবার সামনে আসে ।

রাষ্ট্রীয় চাপ ভাঙনের চক্রান্ত

২০০৭ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই বিএনপির রাজনীতি কার্যত সংকটের ভেতর দিয়ে গেছে। সেনাসমর্থিত সরকারের সময় গ্রেপ্তার, পরে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে যাওয়া—এখান থেকেই তারেক রহমানের লন্ডনে নির্বাসিত জীবনের শুরু। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়। একদিকে নির্বাচনব্যবস্থার ওপর ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে মামলা, গ্রেপ্তার, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা—সব মিলিয়ে বিএনপিকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়ার একটি কাঠামোগত চাপ তৈরি হয়।

এই সময়টাতেই দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসের সেই চেনা ছবির পুনরাবৃত্তি হওয়ার কথা ছিল—দলে ভাঙন। আওয়ামী লীগ সরকারও প্রকাশ্যে ও পরোক্ষভাবে সেই সম্ভাবনার দিকেই এগিয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে বিএনপির মূল কাঠামোতে চিড় ধরাতে না পেরে কাছাকাছি নামে একের পর এক দল গঠনে পরোক্ষ মদত দেওয়া হয়। তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, বিএসপি, বিএনএফ—এসব দলের নির্বাচন কমিশনের দ্রুত নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক মহলে আলোচিত বিষয়। এমনকি বিএনএফকে ধানের শীষের কাছাকাছি গমের শীষ প্রতীক বরাদ্দ দেওয়াও কাকতালীয় বলে মানা কঠিন। এসব প্রয়াসের উদ্দেশ্য ছিল—মূল দলকে বিভ্রান্ত করা, ভোটব্যাংক ও নেতৃত্বে ফাটল ধরানো।

কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। বিএনপি বড় কোনো ভাঙনের মুখে পড়েনি। খালেদা জিয়াকে ২০১৮ সাল থেকে সাজা দিয়ে কার্যত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে রাখা হয়। তারেক রহমানের বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারেও আইনি নিষেধাজ্ঞা আসে। তবু দল ভাঙেনি। বরং নেতৃত্বের শীর্ষ স্তরটি অক্ষুণ্ন থেকেছে। এই জায়গায় প্রশ্ন ওঠে—এটি কি কেবল পরিস্থিতির বাধ্যতামূলক ফল, নাকি সচেতন রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার ফল? এখানেই তারেক রহমানের রাজনৈতিক কৌশলের প্রসঙ্গ সামনে আসে।

ভার্চ্যুয়াল নেতৃত্ব কৌশল

লন্ডনে বসেই তিনি তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় দল পরিচালনার এক নতুন ধারা তৈরি করেন। অনলাইন বৈঠক, স্কাইপে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার, নিয়মিত ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগ—এসব তখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছিল। ২০১৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত এবং শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা—সবকিছুর পেছনেই ছিল তাঁর সক্রিয় ভূমিকা। ভিডিও বার্তায় তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানান, একদলীয় প্রহসনের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কথা। এই অবস্থান দলীয় নেতৃত্বের ভেতরে বিতর্ক তৈরি করলেও, শেষ পর্যন্ত সেটিই বিএনপির জন্য একটি অভিন্ন অবস্থান তৈরি করে।

খালেদা জিয়াকে ২০১৮ সাল থেকে সাজা দিয়ে কার্যত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে রাখা হয়। তারেক রহমানের বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারেও আইনি নিষেধাজ্ঞা আসে। তবু দল ভাঙেনি। বরং নেতৃত্বের শীর্ষ স্তরটি অক্ষুণ্ন থেকেছে। এই জায়গায় প্রশ্ন ওঠে—এটি কি কেবল পরিস্থিতির বাধ্যতামূলক ফল, নাকি সচেতন রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার ফল? এখানেই তারেক রহমানের রাজনৈতিক কৌশলের প্রসঙ্গ সামনে আসে।

২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল আরেকটি বড় পরীক্ষা। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি মাত্র সাতটি আসন পায়। এর পরপরই দলের ভেতরে হতাশা, ক্ষোভ ও সন্দেহ ছড়িয়ে পড়ে। নির্বাচন করা ঠিক হয়েছিল কি না—এ প্রশ্নে নেতৃত্ব বিভক্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এই সময়েই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন, দল ভাঙার ষড়যন্ত্র চলছে। সরকারপক্ষও তখন বিএনপির সম্ভাব্য ভাঙন নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে থাকে।

দক্ষিণ এশিয়ায় এ ধরনের পরিস্থিতিতে বড় দলগুলোর ভাঙনের নজির আছে। পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি বেনজির ভুট্টোর আমলেই একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়। ভারতে কংগ্রেস বারবার ভেঙেছে—ইন্দিরা গান্ধী থেকে শরদ পাওয়ার পর্যন্ত। বাংলাদেশে জাসদ বা বাসদের ইতিহাসও একই কথাই বলে। এই তুলনার মধ্যেই বিএনপির ব্যতিক্রমটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নির্বাচন-পরবর্তী হতাশা, পারস্পরিক সন্দেহ, সরকারের প্রলোভন ও চাপ—সবকিছুর মধ্যেও দলটির মূল কাঠামো অটুট থাকে।

দলীয় কর্মীদের সঙ্গে শীর্ষ নেতৃত্বের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ এখানে একটি বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। তারেক রহমান দলীয় বৃত্তের ভেতরে থেকেই নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ক্ষোভ প্রশমিত করেছেন। বড় ধরনের বিচ্যুতি হতে দেননি। এ ক্ষেত্রে স্থায়ী কমিটি ও মাঠপর্যায়ের নেতাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল—যা অনেক সময় আলোচনায় আসে না।

আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা আগামীর পথ

২০২২ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির ধারাবাহিক আন্দোলনের সময়েও এই ঐক্যের ছাপ দেখা যায়। প্রবল রাষ্ট্রীয় বাধা ও দমন সত্ত্বেও বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে বড় জনসমাগম হয়।

অবশ্য এই আন্দোলন নিখুঁত ছিল না। ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনের ঘটনা, পরের বছর ২৮ জুলাইয়ের পরদিন অবস্থান কর্মসূচির ব্যর্থতা, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ ঘিরে সমন্বয়হীনতা—এসব ঘটনায় নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতাও প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে লন্ডনকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত ও মাঠপর্যায়ের বাস্তবতার দূরত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবু লক্ষণীয়, এসব ব্যর্থতা বিএনপিকে ভাঙতে পারেনি।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করলে বিএনপির ভেতরে হতাশা আরও বাড়ে। মামলা, গ্রেপ্তার, আড়াই মাসে প্রায় ২৭ হাজার নেতা-কর্মী আটক—এই চাপের মধ্যেও দল ভাঙেনি। অনেক বিএনপি নেতা এটাকেই বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন—রাষ্ট্রীয় জবরদস্তির মধ্যেও সাংগঠনিক কাঠামো টিকে থাকা।

এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের নেতৃত্বের মূল্যায়ন নতুন করে সামনে আসে। তিনি কোনো জাদুকর নন। বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভাঙনপ্রবণ রাজনীতিতে তিনি এক ধরনের ‘ক্ষয়রোধী’ নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। দীর্ঘ সময় নির্বাসনে থেকেও দলীয় কেন্দ্র ধরে রাখা, খালেদা জিয়ার সঙ্গে যৌথ রাজনৈতিক ধী, সংকটে আপস না করার কৌশল—এই উপাদানগুলো বিএনপির টিকে থাকার প্রধান ভিত্তি হয়ে উঠেছে।

২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমান দেশে ফিরছেন। ভাঙন ঠেকানোর রাজনীতি থেকে এবার সামনে আসছে পুনর্গঠনের প্রশ্ন। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী এই উত্তাল সময়ে বিএনপি কি এই ঐক্যকে কার্যকর রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ দিতে পারবে? দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বলছে—টিকে থাকা কঠিন, কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানো আরও কঠিন। তারেক রহমানের ‘ভাঙন ঠেকানোর রাজনীতি’ সেই দীর্ঘ পরীক্ষার প্রথম ধাপ পেরিয়েছে মাত্র। এর পরের ধাপ—নেতৃত্ব বিকেন্দ্রীকরণ, গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন এবং বাস্তব রাজনৈতিক কৌশল—সেই পরীক্ষাই ঠিক করবে এই ব্যতিক্রম কতটা টেকসই।

Ad 300x250

সম্পর্কিত