leadT1ad

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে খালেদা জিয়ার ভূমিকা কী

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্ব এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার ভূমিকা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের আগের এক যুগেও তাঁর প্রতিরোধ, আপসহীনতা ও আন্দোলন বাংলাদেশের নাগরিক শাসন ও নির্বাচনী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্ব এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত। ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে খালেদা জিয়ার নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। তিনি বাংলাদেশের সামরিক শাসন-পরবর্তী গণতান্ত্রিক উত্তরণে এক কেন্দ্রীয় ও রূপান্তরমূলক ভূমিকা পালন করেন। দীর্ঘ সময় ধরে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। বিশেষ করে ১৯৮০-র দশকের শেষ ভাগ ও ১৯৯০-র দশকের শুরুতে তাঁর নেতৃত্বই প্রায় এক দশকব্যাপী সামরিক একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটায় এবং দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে।

খালেদা জিয়ার অবদান সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে। এই গণআন্দোলনের ফলেই সামরিক শাসক জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর নির্বাচিত বেসামরিক শাসনে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই সময়কাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের একটি নির্ধারক অধ্যায়। এ ছাড়া আওয়ামী ফ্যাসিবাদ, শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তার আপসহীনতাই ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের ভিত্তিও রচনা করে।

একজন গৃহিণী থেকে জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বে তাঁর উত্থান শুধু ব্যক্তিগত জীবনের রূপান্তর নয়; এটি দেশের রাজনৈতিক বিবর্তনেরও প্রতিফলন। ১৯৯১ সালের পর রাষ্ট্রক্ষমতার কাঠামোগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া ছিলেন অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। তাঁর রাজনৈতিক জীবন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে প্রতিনিধিত্ব করে।

১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর খালেদা জিয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। শুরুতে তিনি ছিলেন একজন সংযত ও অন্তরালবাসী গৃহিণী। তবে দ্রুতই তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বে উঠে আসেন। ১৯৮৪ সালে তিনি দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন এবং দলীয় বিভক্তি ও অভ্যন্তরীণ সংকট কাটিয়ে বিএনপিকে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ দেন।

সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান ও ৯০-র গণঅভ্যুত্থান

১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন। এই সময় রাজনৈতিক অধিকার কঠোরভাবে সীমিত করা হয়। নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বিরোধী কণ্ঠ দমন করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়া সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান নেন। এই শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করেন। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

১৯৮৩ সালে বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট গঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোট এবং বামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে আন্দোলন আরও বিস্তৃত হয়। এর লক্ষ্য ছিল গণপ্রতিরোধের মাধ্যমে সামরিক শাসনের অবসান।

এরশাদ সরকার ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে সামরিক শাসনকে বেসামরিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে। খালেদা জিয়া এই নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। এই বর্জন রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এরশাদ সরকারের বৈধতা আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা বাড়ে।

খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত ত্যাগের মাধ্যমে দৃঢ় নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ৯ বছরের আন্দোলনে তিনি ৭ বার গ্রেপ্তার ও গৃহবন্দি হন। তবুও অবস্থান থেকে সরে আসেননি। ফলে তিনি স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম অবিচল নেত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পান।

খালেদা জিয়ার জনসভাগুলোতে বিপুল মানুষের সমাগম ঘটতে থাকে। তাঁর বক্তব্যে আন্দোলনকে কেবল সরকারবিরোধী নয়, বরং প্রকৃত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম হিসেবে তুলে ধরা হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এরশাদকে অপসারণ এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁর একাগ্রতা তাঁকে সমালোচকদের কাছেও সম্মানিত করে তোলে।

এই আন্দোলনে ছাত্রসমাজ, পেশাজীবী সংগঠন, নাগরিক সমাজ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়। বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল ১৯৯০ সালের মধ্যে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে।

প্রথম দিকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আন্দোলন আলাদা ছিল। তবে ১৯৮৭ সালে রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পথে অগ্রসর হন। ৭ দল, ১৫ দল ও বামপন্থী ৫ দলীয় জোট একসঙ্গে রাজপথে নামলে আন্দোলনের গতি বহুগুণে বাড়ে।

এই সম্মিলিত প্রতিরোধ আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত স্বৈরশাসনের ভিত্তি নড়িয়ে দেয়। ১৯৯০ সালের শেষ দিকে টানা দুই মাসের তীব্র আন্দোলন, রাজপথের সংঘর্ষ ও গণচাপের মুখে ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগ করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র এবং নাগরিক স্বাধীনতা বিষয়ক থিঙ্কট্যাঙ্ক ফ্রিডম হাউস এই ঘটনাকে বাংলাদেশের ‘গণতান্ত্রিক যাত্রার প্রকৃত সূচনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে।

সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা

এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও আন্তর্জাতিকভাবে পর্যবেক্ষিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ১৩৮টি আসন পেয়ে সরকার গঠনের সুযোগ পায়। মার্চ মাসে তিনি দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

এই সময়েই একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিএনপি প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার পক্ষে থাকলেও খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত বা দলীয় সুবিধার চেয়ে জাতীয় ঐকমত্যকে অগ্রাধিকার দেন। তিনি সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন।

সর্বদলীয় সমঝোতা ও গণভোটের মাধ্যমে সংবিধানে সংশোধনী এনে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। এর ফলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত হয় এবং প্রধানমন্ত্রী সংসদের কাছে জবাবদিহির কাঠামোর মধ্যে আসেন। এই সিদ্ধান্ত ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ কমিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য জোরদার করে।

সমকালীন বিশ্লেষকদের মতে, এটি ছিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক অবদানগুলোর একটি। এতে প্রমাণিত হয়, তিনি উত্তরাধিকার বা ব্যক্তিগত ক্ষমতার চেয়ে প্রতিষ্ঠান ও জবাবদিহিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।

ফ্রিডম হাউসের ১৯৯২-৯৩ সালের প্রতিবেদনে এই সময়কে তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক উত্তরণের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, তাঁর প্রাথমিক শাসনামলে বড় ধরনের রাজনৈতিক সংঘাত এড়িয়ে একটি কার্যকর বেসামরিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল।

এই সময়ে সরকার রাজনৈতিক সহনশীলতার জন্যও প্রশংসিত হয়। বিরোধী দলের ধর্মঘট ও আন্দোলন বৃদ্ধি পেলেও সরকার কঠোর দমননীতি গ্রহণ করেনি—এমন মূল্যায়ন বহু গবেষণায় পাওয়া যায়।

ত্রয়োদশ সংশোধনী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা

তবে সংসদীয় গণতন্ত্র কাঠামোগতভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও এই সময়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সংঘাত ও মুখোমুখি অবস্থান স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। বিরোধী আওয়ামী লীগ ঠিক সেই কৌশলই গ্রহণ করে, যা খালেদা জিয়া এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ব্যবহার করেছিলেন। ধর্মঘট, গণআন্দোলন, অবরোধ ও সংসদ বর্জন ছিল তাদের প্রধান হাতিয়ার।

তাদের প্রধান দাবি ছিল—ভবিষ্যৎ নির্বাচন ১৯৯১ সালের মতোই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজনের সাংবিধানিক নিশ্চয়তা। বিরোধীদল সংসদ বর্জনের ফলে সংসদের কাজ প্রায় অচল হয়ে পড়ে। সংসদীয় অধিবেশনে বিরোধী আসন শূন্য থাকে প্রায় ৩০০ দিনেরও বেশি। ১৯৯৪ সালের শেষে বিরোধীরা একসঙ্গে পদত্যাগ করে।

১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ না নিলে বিএনপি বড় ধরনের জয় পায়। তবে এই ফলাফল ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। চাপ অব্যাহত থাকায় বিএনপি সহনশীল মনোভাব প্রদর্শন করে। পরিস্থিতি শান্ত করতে দ্রুত সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী পাস করা হয়। এতে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়।

তারপর খালেদা জিয়া সংসদ ভেঙে দেন এবং বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী একটি যুগান্তকারী সমঝোতা ছিল, যা ক্ষমতা হস্তান্তরকে তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ করে তোলে।

দ্বিতীয় মেয়াদে রাজনৈতিক সংকট ও সামরিক হস্তক্ষেপ

২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে খালেদা জিয়া আবার ক্ষমতায় আসেন। তিনি চারদলীয় জোট সরকার গঠন করেন। কিন্তু এই মেয়াদে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের রাজনীতিকীকরণের অভিযোগ সামনে আসে। ২০০৬ সালের অক্টোবরে ক্ষমতা হস্তান্তর ঘিরে ও প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে সংঘাত তৈরি হয়।

ফলে ১৯৯৬ সালে গৃহীত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এক দশক পর ভেঙে পড়ে। আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে, বিএনপি সরকার সাবেক বিএনপি নেতা কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টার পদে বসিয়ে নির্বাচন প্রভাবিত করতে চেয়েছে। এ অভিযোগ ঘিরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সহিংসতা ও লাঠিসোঁটা নিয়ে আন্দোলন (লগি-বৈঠা) ছড়িয়ে পড়ে। অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। দেশ অরাজকতায় নিমজ্জিত হয়।

তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতা সামরিক হস্তক্ষেপের পথ তৈরি করে। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়ান। নির্বাচন স্থগিত করা হয়। জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। এর মাধ্যমে সেনা-সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে। তাদের লক্ষ্য দেখানো হয়—দুর্নীতি দমন ও নির্বাচন সংস্কার।

এই সময়ে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা-উভয় নেত্রীকে গ্রেপ্তার ও কারাবন্দি করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত চালানো হয়। এই পর্ব বাংলাদেশের নির্বাচনী গণতন্ত্রকে দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়। তবে পরে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভূমিধস জয় পায়। এরপর খালেদা জিয়া ও বিএনপি দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক হয়ে পড়ে। ২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়।

খালেদার আপসহীনতা ও ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান

খালেদা জিয়ার ভূমিকা ১৯৯০–৯১ সালের ঘটনাপ্রবাহে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর পুরো রাজনৈতিক জীবনজুড়েই তিনি কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে অবস্থান করেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচন, বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন তিনি বর্জন করেন। কার‌ণ এই নির্বাচনগুলো কোনও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়নি।

আপসহীনতার কারণে খালেদাকে ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কারাবাস ও গৃহবন্দিত্বের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। স্বাস্থের অবনতি হওয়ায় ২০২০ সালে শর্তসাপেক্ষে তাঁর দণ্ড স্থগিত করা হয়। তাঁর বিদেশ ভ্রমণ ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ রেখে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। এতে তিনি কার্যত জনজীবন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন।

দলের হাজারো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা এবং তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানের নির্বাসিত নেতৃত্ব বিএনপির সাংগঠনিক সক্ষমতাকেও সীমিত করে। ফলে দলের রাজনৈতিক সংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে ওঠে। তবুও এই কঠিন সময়েও তিনি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দাবি থেকে সরে আসেননি। তার এই আপসহীনতা ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানেরও পটভূমি তৈরি করে।

তাঁর মৃত্যুর পর দেওয়া শোকবার্তায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস খালেদা জিয়াকে ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, গণতন্ত্র, বহুদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় খালেদা জিয়ার অবদান চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও শেখ হাসিনাও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় খালেদা জিয়ার ঐতিহাসিক ভূমিকার স্বীকৃতি দেন। খালেদা জিয়াকে ‘গণতন্ত্রের জননী’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়।

দ্বৈত উত্তরাধিকার

খালেদা জিয়া গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আরও গভীর করবার সুযোগ ছিল। গণতন্ত্র কাঠামোগতভাবে ফিরে এলেও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আরও ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠে। বহুদলীয় গণতন্ত্রকে পুরোপুরি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারেননি।

মূলত এই দ্বন্দ্বই পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পতন এবং দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। রাজনীতি ক্রমেই মুখোমুখি ও সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ গভীর হয়। তবুও এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্ব এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার ভূমিকা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত।

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের আগের এক যুগেও তাঁর প্রতিরোধ, আপসহীনতা ও আন্দোলন বাংলাদেশের নাগরিক শাসন ও নির্বাচনী অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত