leadT1ad

স্লিমিং পাউডার কি সত্যিই ওজন কমায়

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪: ৪৫
স্ট্রিম গ্রাফিক

শরীরের বাড়তি মেদ ঝরানোর জন্য মানুষ প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উপায় খোঁজে। আর তাই বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে ‘স্লিমিং পাউডার’, ‘হার্বাল টি’ এবং ‘ওয়েট লস সাপ্লিমেন্ট’। স্যোশাল মিডিয়া খুললেই চোখে পড়ে এসব পণ্যের চটকদার বিজ্ঞাপন।

দাবি করা হয়, কোনো ব্যায়াম বা ডায়েট ছাড়াই এক মাসে ১০-১৫ কেজি ওজন কমানো সম্ভব। স্থূলতা বা মেদ নিয়ে চিন্তিত অনেকেই দ্রুত ওজন কমানোর জন্য স্লিমিং পাউডার কেনেন।

এই 'জাদুকরী' পাউডারগুলো কি আসলেই শরীরের ফ্যাট বার্ন করে, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি?

চলুন জেনে নিই চিকিৎসাবিজ্ঞান কী বলছে এ ব্যাপারে।

স্লিমিং পাউডার আসলে কী?

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এগুলোকে বলা হয় ‘ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট’। এগুলো সাধারণত ভেষজ উপাদান (যেমন গ্রিন টি'র নির্যাস, গারসিনিয়া ক্যামবোজিয়া), মিনারেলস, ফাইবার ও ক্যাফেইনের মিশ্রণে তৈরি হয়। এই সাপ্লিমেন্টগুলো পাউডার, ক্যাপসুল, ট্যাবলেট বা তরল বিভিন্ন আকারে এগুলো পাওয়া যায়।

স্লিমিং সাপ্লিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দাবি করে যে, এই পণ্যগুলো শরীরের বিপাক ক্রিয়া বাড়ায়, চর্বি শোষণে বাধা দেয় এবং ক্ষুধা কমায়।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (এনআইএইচ)-এর ‘অফিস অফ ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট’ বিভিন্ন জনপ্রিয় উপাদানের ওপর গবেষণা করে ভিন্ন কথা বলছে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেশিরভাগ স্লিমিং উপাদানের কার্যকারিতা খুবই সীমিত। অনেক ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। প্রথমেই স্লিমিং পাউডারের উপদানগুলো জানা যাক।

কাঁকড়া বা চিংড়ির খোলস থেকে এটি তৈরি করা হয়। দাবি করা হয়, এটি চর্বি শোষণে বাধা দেয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, চিটোসান খুব সামান্য পরিমাণ ফ্যাট ব্লক করতে পারে, যার ফলে ওজন কমার হার খুবই নগণ্য।

গ্রিন টি এক্সট্র্যাক্ট

অনেকের ধারণা গ্রিন টি চর্বি কমায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এতে থাকা ক্যাফেইন এবং ক্যাটেচিন সামান্য পরিমাণে শরীরের ক্যালরি পোড়ানোর হার বাড়াতে পারে। কিন্তু প্রতিবেদনের তথ্যমতে, মানুষের ওপর করা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, গ্রিন টি এক্সট্র‍্যাক্টের প্রভাবে তেমন ওজন কমে না বা ‘ক্লিনিক্যালি সিগনিফিকেন্ট’ বা উল্লেখ করার মতো নয়।

গারসিনিয়া ক্যামবোজিয়া

এটি স্লিমিং পাউডারের অন্যতম জনপ্রিয় উপাদান। দাবি করা হয়, এই উপাদানটি চর্বি তৈরিতে বাধা দেয়। তবে গবেষণার ফলাফল মিশ্র। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে এটি প্লাসিবো (ওষুধ নয় এমন বস্তু)-এর চেয়ে সামান্য বেশি ওজন কমায়, আবার অনেক গবেষণায় এর কোনো প্রভাবই পাওয়া যায়নি। চিকিৎসকদের মতে, মানুষের ওজন কমাতে এই উপাদানের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী নয়।

গ্লুকোমানান

স্লিমিং সাপ্লিমেন্টে থাকা এই উপাদানটি এক ধরনের দ্রবণীয় ফাইবার। দাবি করা হয়, এটি পেটে গিয়ে ফুলে ওঠে এবং ক্ষুধাবোধ কমিয়ে দেয়। তবে বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, গ্লুকোমানান গ্রহণ করার পরেও তাদের ওজনে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসেনি।

চিটোসান

কাঁকড়া বা চিংড়ির খোলস থেকে এটি তৈরি করা হয়। দাবি করা হয়, এটি চর্বি শোষণে বাধা দেয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, চিটোসান খুব সামান্য পরিমাণ ফ্যাট ব্লক করতে পারে, যার ফলে ওজন কমার হার খুবই নগণ্য।

অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ জার্নালের তথ্যমতে, অধিকাংশ স্লিমিং পাউডার বা হার্বাল সাপ্লিমেন্ট ওজন কমানোতে জাদুকরী কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। যদি কারও ওজন কমেও, তবে তা সাধারণত ১-২ কেজির বেশি নয় এবং সাপ্লিমেন্ট বন্ধ করলেই সেই ওজন আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, স্লিমিং পাউডার বা হার্বাল সাপ্লিমেন্ট খেয়ে দীর্ঘমেয়াদী এবং উল্লেখযোগ্য ওজন কমানোর কোনো শক্ত প্রমাণ নেই।

স্লিমিং পাউডার কি স্বাস্থ্যসম্মত?

যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক-এর বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন যে, এসব স্লিমিং সাপ্লিমেন্ট ভেষজ ওষুধ হিসেবে বাজারে বিক্রি হলেও তা সবসময় স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নাও হতে পারে। কারণ, পাউডারের কৌটার গায়ে যেসব উপাদানের কথা লেখা থাকে, ভেতরে সবসময় তা-ই থাকবে এমনটা নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই।

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের তথ্যমতে, ওজন কমানোর এই সাপ্লিমেন্ট অত্যাধিক মাত্রায় গ্রহণ করার ফলে লিভার ড্যামেজের ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিশেষ করে গ্রিন টি এক্সট্র্যাক্ট অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ করলে লিভারের এনজাইম বেড়ে গিয়ে হেপাটাইটিস বা জন্ডিসের মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে লিভার ফেইলিওরের ঘটনাও ঘটেছে।

আমেরিকার এফডিএ-এর পরীক্ষায় বারবার দেখা গেছে, ‘হার্বাল’ স্লিমিং পাউডারে গোপনে ‘সিবুট্রামিন’ মেশানো হয়। এটি একটি শক্তিশালী রাসায়নিক যা ২০১০ সালে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই ক্ষতিকর উপাদানটি স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেয়। হার্বাল পণ্যে এই উপাদান লুকিয়ে রাখার কারণে মানুষ মনে করে ভেষজ উপাদান গ্রহণের কারণে ওজন কমছে, কিন্তু আসলে তারা অজান্তেই করছে বিষপান।

আবার অনেক স্লিমিং সাপ্লিমেন্টে উচ্চমাত্রার ক্যাফেইন, গুয়ারানা বা ইয়েরবা মেট থাকে। এগুলো সাময়িকভাবে এনার্জি বাড়ালেও হার্ট রেট বা হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক করে তোলে। যার ফলে বুক ধড়ফড় করা, ঘুমের সমস্যা এবং দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা দেয়।

স্লিমিং পাউডারগুলোতে প্রায়ই জোলাপ বা ল্যাক্সেটিভ জাতীয় উপাদান থাকে। এটি পেট খারাপ বা ডায়রিয়া সৃষ্টি করে শরীর থেকে দ্রুত পানি বের দেয়। ব্যবহারকারী মনে করেন মেদ কমছে, কিন্তু আসলে শরীর পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এটি ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স বা লবণের ঘাটতি তৈরি করে, যা কিডনির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে কী বলে

বিভিন্ন গবেষণা এবং চিকিৎসকদের মতামত এক এবং অভিন্ন। ওজন কমানোর কোনো ‘শর্টকাট’ বা ‘ম্যাজিক পিল’ নেই।

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের পরামর্শ অনুযায়ী, যদি কোনো পণ্য দাবি করে যে ‘ব্যায়াম ছাড়াই ওজন কমবে’ বা ‘এক সপ্তাহে ৫ কেজি কমবে’, তবে ধরে নিন এটি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি যা স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক।

সাপ্লিমেন্ট কেনার আগে অবশ্যই তাতে ‘ইউএসপি ভেরিফাইড’ বা মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার সিল আছে কিনা দেখে নিন এবং কখনোই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ করবেন না।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, স্লিমিং পাউডার বা হার্বাল সাপ্লিমেন্ট খেয়ে দীর্ঘমেয়াদী এবং উল্লেখযোগ্য ওজন কমানোর কোনো শক্ত প্রমাণ নেই।

ওজন কমানোর মূল চাবিকাঠি আপনার হেলদি লাইফস্টাইল। ওজন কমাতে চাইলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তারপর জীবনে নিয়মমাফিক পরিবর্তন নিয়ে আসুন। চটকদার বিজ্ঞাপনের মোহে পড়ে নিজের অমূল্য স্বাস্থ্যের ক্ষতি করবেন না।

Ad 300x250

সম্পর্কিত