ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থীদের ঋণখেলাপি সংক্রান্ত তথ্য যাচাইয়ে আরও কঠোর ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ লক্ষ্যে মনোনয়নপত্র দাখিলকারীদের বিস্তারিত তথ্য নির্দিষ্ট ছকে সংগ্রহ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় যাচাই করা হবে। একই সঙ্গে, ভুল তথ্য দিয়ে কোনো খেলাপিকে ছাড় দেওয়ার চেষ্টা করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আজ শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ মনির হোসেন স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করা হয়েছে।
যাচাই প্রক্রিয়া ও সময়সীমা
ইসি সূত্র জানায়, মনোনয়নপত্র যাচাইয়ের জন্য নির্বাচন কর্মকর্তারা ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে ৪ জানুয়ারি ২০২৬ পর্যন্ত মোট ছয় দিন সময় পাবেন। পরিপত্র অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলকারীদের ঋণখেলাপি তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) এবং অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হবে। এজন্য রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে প্রার্থীর নাম, পিতা-মাতার নাম, বিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে স্বামীর নাম, ১০ ও ১৭ ডিজিটের জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্মতারিখ, করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) এবং বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা বাংলা ও ইংরেজি—উভয় ভাষায় নির্ধারিত ছকে (পরিশিষ্ট-খ) লিপিবদ্ধ করে সরবরাহ করা হবে।
মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ২৯ ডিসেম্বর বিকেল ৫টার পরপরই দাখিল হওয়া সব প্রার্থীর তথ্য নির্ধারিত ছকে প্রস্তুত করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবিতে পাঠাতে হবে। একই সঙ্গে দাখিলকৃত মনোনয়নপত্রের সারসংক্ষেপ—যেমন মোট প্রার্থীর সংখ্যা ও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের নাম—অবিলম্বে টেলিফোন, ইন্ট্রানেট বা ফ্যাক্সে জানাতে হবে। এ ছাড়া সব তথ্য ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ইএমএস)-এর মাধ্যমেও পাঠানোর নির্দেশনা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর অবস্থান
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকও তফসিলের মাস দুয়েক আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করেছে। গত ৫ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রার্থীদের ঋণখেলাপি তথ্য সঠিক, নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গভাবে প্রস্তুত করার নির্দেশনা দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচনের সময় কেউ যেন অবৈধ সুবিধা নিতে না পারেন, সে বিষয়ে বিশেষ নজরদারি থাকবে। যদি কোনো কর্মকর্তা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য দেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা নয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। এমনকি ভুল তথ্যের ভিত্তিতে যদি কোনো খেলাপি প্রার্থী মনোনয়ন পান, তবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকেরও দায় থাকবে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, প্রার্থীদের নামে খেলাপি ঋণ থাকলে তা মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে নবায়ন বা পরিশোধ করতে হয়। আইন অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনের আগে ঋণ নিয়মিত করলেই নির্বাচনে অংশ নেওয়া যায়। জাতীয় নির্বাচনে ঋণখেলাপিদের অংশগ্রহণ ঠেকাতে ১৯৯১ সালে প্রথম এই বিধান চালু করা হয়।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে প্রার্থীর দেওয়া তথ্য মিলিয়ে দেখা হয়। কোনো প্রার্থী ঋণখেলাপি প্রমাণিত হলে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। এ কারণে বাছাইয়ের সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে এবং আপিল শুনানির সময় নির্বাচন কমিশনে উপস্থিত থাকেন। এমনকি নির্বাচিত হওয়ার পরও ঋণখেলাপি বা মিথ্যা তথ্য প্রদান প্রমাণিত হলে সংসদ সদস্যপদ বাতিলের বিধান রয়েছে।
উল্লেখ্য, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে মোট ২ হাজার ৭১৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেন। সে সময় নির্বাচন কমিশনের অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি অন্তত ১১৮ জন প্রার্থীকে ঋণখেলাপি হিসেবে শনাক্ত করে, যাদের মনোনয়নপত্র পরবর্তীতে বাতিল করা হয়েছিল।