আমীন আল রশীদ

জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা এক ঝাঁক তরুণের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বিদলীয় তথা পরিবারতান্ত্রিকতা ছিল প্রবল। এর বাইরে গিয়ে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তারা আর্বিভূত হবে—যাদের আদর্শ হবে কট্টর ডান ও বামের মাঝামাঝি এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের সমর্থন দেবে—এরকমটি ধারণা করা হচ্ছিল। রাজনৈতিক পরিসরে এই আলাপটি ছিল। এনসিপির তরফেও এরকম ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছিল। যে কারণে শুরুর দিকে এনসিপিকে জামায়াতের ‘বি টিম’ বলে অনেকে টিপ্পনী কাটলেও ধীরে ধীরে সেই ধারণা ভুল মনে হচ্ছিল। সাম্প্রতিক নানা ইস্যুতে জামায়াতের সঙ্গে তাদের দূরত্বও স্পষ্ট হচ্ছিল।
নাহিদ ইসলাম জামায়াতের পিআর আন্দোলনকে ‘সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রতারণা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। একে অভিহিত করলেন ‘দেশের সংবিধান ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের প্রকৃত পুনর্গঠনের উপকরণ থেকে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা’ বলে। তখন জনমনে এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হল যে, আর যাই হোক, জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির জোট হচ্ছে না।
কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনা আর ধারণার অবসান ঘটিয়ে সত্যি সত্যিই জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করল এনসিপি। এর তীব্র সমালোচনা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। অনেকেই বলছেন, এর মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হল যে, এনসিপি আসলেই জামায়াতের ‘বি টিম’ এবং তারা আখেরে জামায়াতে বিলীন হয়ে যাবে।
অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও সমালোচনার কারণ
জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার বিরোধিতা এসেছে খোদ এনসিপির ভেতর থেকেই। বিশেষ করে এনসিপির সামনের সারিতে থাকা নারী নেতৃত্ব এর প্রতিবাদ করছেন সবচেয়ে বেশি। সেই সঙ্গে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের ৩০ জন নেতা জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করার বিরোধিতা করে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে একটি স্মারকলিপিও দিয়েছিলেন। কিন্তু এর পরদিনই জামায়াতের জোটে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।
জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির নির্বাচনী জোটের কেন এই সমালোচনা? দলটির নাম জামায়াত বলে? ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে জামায়াতের নাম আছে বলে? নাকি দলটির সঙ্গে ইসলাম শব্দটি থাকার কারণে এনসিপির তুলনামূলক প্রগতিশীল অংশটি এর বিরোধিতা করছে? তারা যদি বিএনপির সঙ্গে জোট করত তাহলে এই সমালোচনা হত? নিশ্চয়ই না। কিন্তু এই বিএনপির সঙ্গেই তো জামায়াতের নির্বাচনী জোট ছিল দীর্ঘদিন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারেরও অংশ ছিল জামায়াত। সুতরাং, সেই জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির জোট গঠনের সমালোচনা কেন? জামায়াতের সঙ্গে জোট করার মধ্য দিয়ে এনসিপির স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচয় বিনির্মাণের সম্ভাবনা কি সত্যিই শেষ হয়ে গেল? বিএনপি যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে, তাহলে নির্বাচনের পরে কি আসলেই এনসিপিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, নাকি জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোটই সরকার গঠন করবে এবং তখন এনিসিপি হবে সরকারের প্রধান অংশীদার? এই সম্ভাবনা কতটুকু? নাকি জামায়াত ও এনসিপির এই জোট আগামী সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হবে এবং পরবর্তী তথা চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে এনসিপি একটি স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভুত হবে—যারা ওই নির্বাচনে শাসকদলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হবে?
এর কোনো প্রশ্নের জবাব ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। এখানে অনেকগুলো ‘যদি কিন্তু’ আছে। রাজনীতি যেমন সরলরেখায় চলে না, তেমনি রাজনীতিতে চিরশত্রু ও চিরমিত্র বলেও কিছু নেই। কয়েক দিন আগেও যে এনসিপির নেতারা কড়া ভাষায় জামায়াতের সমালোচনা করেছেন, তারাই এখন জামায়াতের সঙ্গে জোট করলেন। সুতরাং এখন কি এনসিপির নেতারা আর জামায়াতের সমালোচনা করবেন? তারা যেসব ইস্যুতে জামায়াতের সমালোচনা করেছিলেন, সেই ইস্যুগুলোতে এনসিপি কি নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে?
জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির জোট গঠনের নানা ব্যাখা থাকতে পারে। তবে এখানে এনসিপির নিজের এবং দলের ভেতরে যারা সমালোচনা করছেন, তাদের ব্যাখ্যাগুলো জরুরি।
ভাঙনের সুর ও পরিকল্পিত ছক
জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট গঠনের পরে রাজধানীর বাংলামোটরে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ ইসলাম বলেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট ‘সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ’ করার জন্য ‘বৃহত্তর ঐক্যের’ প্রয়োজনবোধ থেকে তারা জামায়াত ও সমমনা আট দলের সঙ্গে কথা বলেছেন। এর ভিত্তিতে তারা ‘নির্বাচনী সমঝোতায়’ একমত হয়েছেন।
জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোটে যাওয়া না যাওয়ার সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে সামনে আসার আগেই এনসিপি ছাড়েন দুই নেতা। তারা হলেন, দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা ও যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন। এর মধ্যে তাসনিম জারা ঢাকা-৯ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন। আর ভোট থেকে সরে দাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন তাজনূভা জাবীন।
নির্বাচনী জোট গঠনের দিনই তাজনূভা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আপনারা অনেকে ভাবছেন, হয়তো জামায়াতের সঙ্গে জোটে ঐতিহাসিক কারণ বা নারী বিষয়ের কারণে আমার আপত্তি। এর চেয়েও ভয়ঙ্কর যে কারণ, সেটা হল যে প্রক্রিয়ায় এটা হয়েছে। এটাকে রাজনৈতিক কৌশল, নির্বাচনী জোট ইত্যাদি লেভেল দেয়া হচ্ছে। আমি বলব এটা পরিকল্পিত। এটাকে সাজিয়ে এ পর্যন্ত আনা হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, এনসিপি এককভাবে নির্বাচন করবে বলে কয়েক দিন আগেই ১২৫ জনকে মনোনয়ন দিয়েছে। কিন্তু জামায়াতের সঙ্গে ৩০টি আসনে সমঝোতার মানে হলো বাকি ঘোষিত প্রার্থীদের মধ্যে ৯৫ জন আর নির্বাচনের মাঠে থাকতে পারবেন না। সুতরাং জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির জোটের বিরোধিতার এটিও একটি বড় কারণ। উপরন্তু ঘটনাগুলো এমন সময়ে ঘটেছে যে, এনসিপি থেকে বেরিয়ে অধিকাংশের পক্ষে স্বতন্ত্র নির্বাচন করাও সম্ভব নয়। কেননা মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখের আগের দিন এই জোট হলো। নির্বাচনী আইন আরপিও অনুযায়ী স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে হলে সংশ্লিষ্ট আসনের মোট ভোটারের এক শতাংশের স্বাক্ষর জমা দিতে হয়। এই অল্প সময়ে সেটা অসম্ভবই বলা চলে। তার মানে পুরো বিষয়টা করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবেই—মেটিক্যুলাস!
একই দিন সামান্তা শারমিন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নির্ভরযোগ্য মিত্র না। তার রাজনৈতিক অবস্থান বা দর্শনসহ কোন সহযোগিতা বা সমঝোতায় যাওয়া এনসিপিকে কঠিন মূল্য চুকাতে হবে বলে আমি মনে করি।’
বিকল্প শক্তি হওয়ার সম্ভাবনার কি ইতি
জুলাই অভ্যুত্থানের অংশগ্রহণকারী তরুণদের প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন মাহফুজ আলম। নির্বাচন করবেন বলে সম্প্রতি তিনি সরকার থেকে পদত্যাগ করেছেন। এটি মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে, তিনি এনসিপিতেই যোগ দিচ্ছেন। কিন্তু জামায়াত ইস্যুতে তিনি এনসিপিতে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘বিদ্যমান বাস্তবতায় আমার জুলাই সহযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান, স্নেহ এবং বন্ধুত্ব মুছে যাবে না। কিন্তু, আমি এই এনসিপির অংশ হচ্ছি না।’
এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্বকে ইঙ্গিত করে তাজনূভা লিখেছেন, ‘এরা নিজেদের মধ্যে রাজনীতি করতে এতো ব্যস্ত এরা কখনো দেশের জন্য নতুন একটা মধ্যপন্থার বাংলাদেশপন্থী রাজনীতি করতে পারবে না।’ মাহফুজ আলমের আক্ষেপ, ‘এনসিপিকে একটা বিগ জুলাই আম্ব্রেলা আকারে স্বতন্ত্র উপায়ে দাঁড় করানোর জন্য আমি সকল চেষ্টাই করেছি। কিন্তু, অনেক কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি।’
বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এটিই দুর্ভাগ্য বা ট্র্যাজেডি যে, বিএনপি-আওয়ামী লীগ ও ধর্মীয় বলয়ের বাইরে গিয়ে সত্যিকারের বাংলাদেশপন্থি ও মধ্যপন্থি একটি দল হয়ে ওঠার যে সম্ভাবনা এনসিপির মধ্যে অনেকেই দেখেছিলেন, জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করা এবং তার প্রতিবাদে অনেক সম্ভাবনাময় নেতার দল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সেই সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেল বলেই অনেকে মনে করছেন। তবে রাজনীতিতে শেষ বলে যেহেতু কিছু নেই, অতএব নির্বাচনী কৌশলের অংশ হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে জোট করলেও এনসিপি যদি সত্যিই একটি স্বতন্ত্র ও মধ্যপন্থার রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের দাঁড় করানোর রাজনীতিটা করতে পারে, তাহলে হয়তো তারা জামায়াতে বিলীন হবে না। কিন্তু তাদের জন্য সম্ভবত সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত হত এবার এককভাবেই নির্বাচন করা।
বাস্তবতা হল, এনসিপির অনেকেই একসময় ছাত্রলীগ করতেন। তারা একসময় বঙ্গবন্ধুর নাম বলতে বলতে গলা ফাটাতেন। এমনকি জুলাই আন্দোলনের সময় তারা এমন স্লোগানও দিয়েছিলেন- ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই।’ কিন্তু সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে জানা গেল তাদের অনেকেই আসলে শিবির—যারা পরিচয় গোপন করে ছাত্রলীগে ছিলেন। তারাই এখন স্লোগান দিচ্ছেন ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ।’ উপরন্তু শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের সমালোচনা করতে গিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধকে ডিফেইম করা, ৭১-এর উপরে চব্বিশকে স্থান দেয়ার চেষ্টা করা এবং বাহাত্তরের সংবিধানকে ‘মুজিববাদী সংবিধান’ আখ্যা দিয়ে তার কবর রচনার কথা বলে বিপুল সংখ্যক মানুষের মনে যে বিরক্তি ও অসন্তুষ্টির জন্ম দিয়েছেন, তার মধ্য দিয়েও এনসিপির বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অথচ তাদের সামনে অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এসব বিষয়ের বাইরে গিয়ে একেবারে সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত দৈনন্দিন বিষয় নিয়ে তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রেখে ন্যূনতম কিছু সংস্কার বাস্তবায়নে বাধ্য করতে পারলে বরং তাদের জনপ্রিয়তা আরও বাড়ত। কিন্তু তারা এমন নীতিগত বিষয় নিয়ে ব্যস্ত ছিল যা সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করেনি।
যেসব কারণে তারা বিতর্কিত হয়েছে, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি রোধ করে নতুন উদ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়া এবং চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন টার্গেট করে ধীরে ধীরে পায়ের নিজের মাটি শক্ত করার সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে না গেলেও এনসিপির মধ্যে একধরনের তাড়াহুড়া লক্ষ্য করা যায়। তারা হয়তো এখনই ক্ষমতার অংশীদার হতে চায়। হতে পারে তারা অভ্যুত্থানের পরে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকায় আ্ত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে এবং তাদের অনেকে টাকা ও ক্ষমতার স্বাদও পেয়েছেন। ফলে সেটাকে আরও বাড়িয়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, রাজনীতি একশো মিটার দৌড় নয়। এটা ম্যারাথন। এখানে ধীরে ধীরে এগোতে হয় এবং লম্বা রেসের ঘোড়ার মতো টিকে থাকতে হয়।
লেখক: সাংবাদিক

জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা এক ঝাঁক তরুণের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্বিদলীয় তথা পরিবারতান্ত্রিকতা ছিল প্রবল। এর বাইরে গিয়ে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তারা আর্বিভূত হবে—যাদের আদর্শ হবে কট্টর ডান ও বামের মাঝামাঝি এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের সমর্থন দেবে—এরকমটি ধারণা করা হচ্ছিল। রাজনৈতিক পরিসরে এই আলাপটি ছিল। এনসিপির তরফেও এরকম ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছিল। যে কারণে শুরুর দিকে এনসিপিকে জামায়াতের ‘বি টিম’ বলে অনেকে টিপ্পনী কাটলেও ধীরে ধীরে সেই ধারণা ভুল মনে হচ্ছিল। সাম্প্রতিক নানা ইস্যুতে জামায়াতের সঙ্গে তাদের দূরত্বও স্পষ্ট হচ্ছিল।
নাহিদ ইসলাম জামায়াতের পিআর আন্দোলনকে ‘সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রতারণা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। একে অভিহিত করলেন ‘দেশের সংবিধান ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের প্রকৃত পুনর্গঠনের উপকরণ থেকে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা’ বলে। তখন জনমনে এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হল যে, আর যাই হোক, জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির জোট হচ্ছে না।
কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনা আর ধারণার অবসান ঘটিয়ে সত্যি সত্যিই জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করল এনসিপি। এর তীব্র সমালোচনা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। অনেকেই বলছেন, এর মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হল যে, এনসিপি আসলেই জামায়াতের ‘বি টিম’ এবং তারা আখেরে জামায়াতে বিলীন হয়ে যাবে।
অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও সমালোচনার কারণ
জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার বিরোধিতা এসেছে খোদ এনসিপির ভেতর থেকেই। বিশেষ করে এনসিপির সামনের সারিতে থাকা নারী নেতৃত্ব এর প্রতিবাদ করছেন সবচেয়ে বেশি। সেই সঙ্গে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের ৩০ জন নেতা জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করার বিরোধিতা করে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে একটি স্মারকলিপিও দিয়েছিলেন। কিন্তু এর পরদিনই জামায়াতের জোটে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।
জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির নির্বাচনী জোটের কেন এই সমালোচনা? দলটির নাম জামায়াত বলে? ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে জামায়াতের নাম আছে বলে? নাকি দলটির সঙ্গে ইসলাম শব্দটি থাকার কারণে এনসিপির তুলনামূলক প্রগতিশীল অংশটি এর বিরোধিতা করছে? তারা যদি বিএনপির সঙ্গে জোট করত তাহলে এই সমালোচনা হত? নিশ্চয়ই না। কিন্তু এই বিএনপির সঙ্গেই তো জামায়াতের নির্বাচনী জোট ছিল দীর্ঘদিন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারেরও অংশ ছিল জামায়াত। সুতরাং, সেই জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির জোট গঠনের সমালোচনা কেন? জামায়াতের সঙ্গে জোট করার মধ্য দিয়ে এনসিপির স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচয় বিনির্মাণের সম্ভাবনা কি সত্যিই শেষ হয়ে গেল? বিএনপি যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে, তাহলে নির্বাচনের পরে কি আসলেই এনসিপিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, নাকি জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোটই সরকার গঠন করবে এবং তখন এনিসিপি হবে সরকারের প্রধান অংশীদার? এই সম্ভাবনা কতটুকু? নাকি জামায়াত ও এনসিপির এই জোট আগামী সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হবে এবং পরবর্তী তথা চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে এনসিপি একটি স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভুত হবে—যারা ওই নির্বাচনে শাসকদলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হবে?
এর কোনো প্রশ্নের জবাব ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। এখানে অনেকগুলো ‘যদি কিন্তু’ আছে। রাজনীতি যেমন সরলরেখায় চলে না, তেমনি রাজনীতিতে চিরশত্রু ও চিরমিত্র বলেও কিছু নেই। কয়েক দিন আগেও যে এনসিপির নেতারা কড়া ভাষায় জামায়াতের সমালোচনা করেছেন, তারাই এখন জামায়াতের সঙ্গে জোট করলেন। সুতরাং এখন কি এনসিপির নেতারা আর জামায়াতের সমালোচনা করবেন? তারা যেসব ইস্যুতে জামায়াতের সমালোচনা করেছিলেন, সেই ইস্যুগুলোতে এনসিপি কি নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে?
জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির জোট গঠনের নানা ব্যাখা থাকতে পারে। তবে এখানে এনসিপির নিজের এবং দলের ভেতরে যারা সমালোচনা করছেন, তাদের ব্যাখ্যাগুলো জরুরি।
ভাঙনের সুর ও পরিকল্পিত ছক
জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট গঠনের পরে রাজধানীর বাংলামোটরে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ ইসলাম বলেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট ‘সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ’ করার জন্য ‘বৃহত্তর ঐক্যের’ প্রয়োজনবোধ থেকে তারা জামায়াত ও সমমনা আট দলের সঙ্গে কথা বলেছেন। এর ভিত্তিতে তারা ‘নির্বাচনী সমঝোতায়’ একমত হয়েছেন।
জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোটে যাওয়া না যাওয়ার সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে সামনে আসার আগেই এনসিপি ছাড়েন দুই নেতা। তারা হলেন, দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা ও যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন। এর মধ্যে তাসনিম জারা ঢাকা-৯ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন। আর ভোট থেকে সরে দাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন তাজনূভা জাবীন।
নির্বাচনী জোট গঠনের দিনই তাজনূভা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আপনারা অনেকে ভাবছেন, হয়তো জামায়াতের সঙ্গে জোটে ঐতিহাসিক কারণ বা নারী বিষয়ের কারণে আমার আপত্তি। এর চেয়েও ভয়ঙ্কর যে কারণ, সেটা হল যে প্রক্রিয়ায় এটা হয়েছে। এটাকে রাজনৈতিক কৌশল, নির্বাচনী জোট ইত্যাদি লেভেল দেয়া হচ্ছে। আমি বলব এটা পরিকল্পিত। এটাকে সাজিয়ে এ পর্যন্ত আনা হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, এনসিপি এককভাবে নির্বাচন করবে বলে কয়েক দিন আগেই ১২৫ জনকে মনোনয়ন দিয়েছে। কিন্তু জামায়াতের সঙ্গে ৩০টি আসনে সমঝোতার মানে হলো বাকি ঘোষিত প্রার্থীদের মধ্যে ৯৫ জন আর নির্বাচনের মাঠে থাকতে পারবেন না। সুতরাং জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির জোটের বিরোধিতার এটিও একটি বড় কারণ। উপরন্তু ঘটনাগুলো এমন সময়ে ঘটেছে যে, এনসিপি থেকে বেরিয়ে অধিকাংশের পক্ষে স্বতন্ত্র নির্বাচন করাও সম্ভব নয়। কেননা মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখের আগের দিন এই জোট হলো। নির্বাচনী আইন আরপিও অনুযায়ী স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে হলে সংশ্লিষ্ট আসনের মোট ভোটারের এক শতাংশের স্বাক্ষর জমা দিতে হয়। এই অল্প সময়ে সেটা অসম্ভবই বলা চলে। তার মানে পুরো বিষয়টা করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবেই—মেটিক্যুলাস!
একই দিন সামান্তা শারমিন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নির্ভরযোগ্য মিত্র না। তার রাজনৈতিক অবস্থান বা দর্শনসহ কোন সহযোগিতা বা সমঝোতায় যাওয়া এনসিপিকে কঠিন মূল্য চুকাতে হবে বলে আমি মনে করি।’
বিকল্প শক্তি হওয়ার সম্ভাবনার কি ইতি
জুলাই অভ্যুত্থানের অংশগ্রহণকারী তরুণদের প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন মাহফুজ আলম। নির্বাচন করবেন বলে সম্প্রতি তিনি সরকার থেকে পদত্যাগ করেছেন। এটি মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে, তিনি এনসিপিতেই যোগ দিচ্ছেন। কিন্তু জামায়াত ইস্যুতে তিনি এনসিপিতে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘বিদ্যমান বাস্তবতায় আমার জুলাই সহযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান, স্নেহ এবং বন্ধুত্ব মুছে যাবে না। কিন্তু, আমি এই এনসিপির অংশ হচ্ছি না।’
এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্বকে ইঙ্গিত করে তাজনূভা লিখেছেন, ‘এরা নিজেদের মধ্যে রাজনীতি করতে এতো ব্যস্ত এরা কখনো দেশের জন্য নতুন একটা মধ্যপন্থার বাংলাদেশপন্থী রাজনীতি করতে পারবে না।’ মাহফুজ আলমের আক্ষেপ, ‘এনসিপিকে একটা বিগ জুলাই আম্ব্রেলা আকারে স্বতন্ত্র উপায়ে দাঁড় করানোর জন্য আমি সকল চেষ্টাই করেছি। কিন্তু, অনেক কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি।’
বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এটিই দুর্ভাগ্য বা ট্র্যাজেডি যে, বিএনপি-আওয়ামী লীগ ও ধর্মীয় বলয়ের বাইরে গিয়ে সত্যিকারের বাংলাদেশপন্থি ও মধ্যপন্থি একটি দল হয়ে ওঠার যে সম্ভাবনা এনসিপির মধ্যে অনেকেই দেখেছিলেন, জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট করা এবং তার প্রতিবাদে অনেক সম্ভাবনাময় নেতার দল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সেই সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেল বলেই অনেকে মনে করছেন। তবে রাজনীতিতে শেষ বলে যেহেতু কিছু নেই, অতএব নির্বাচনী কৌশলের অংশ হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে জোট করলেও এনসিপি যদি সত্যিই একটি স্বতন্ত্র ও মধ্যপন্থার রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের দাঁড় করানোর রাজনীতিটা করতে পারে, তাহলে হয়তো তারা জামায়াতে বিলীন হবে না। কিন্তু তাদের জন্য সম্ভবত সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত হত এবার এককভাবেই নির্বাচন করা।
বাস্তবতা হল, এনসিপির অনেকেই একসময় ছাত্রলীগ করতেন। তারা একসময় বঙ্গবন্ধুর নাম বলতে বলতে গলা ফাটাতেন। এমনকি জুলাই আন্দোলনের সময় তারা এমন স্লোগানও দিয়েছিলেন- ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই।’ কিন্তু সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে জানা গেল তাদের অনেকেই আসলে শিবির—যারা পরিচয় গোপন করে ছাত্রলীগে ছিলেন। তারাই এখন স্লোগান দিচ্ছেন ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ।’ উপরন্তু শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের সমালোচনা করতে গিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধকে ডিফেইম করা, ৭১-এর উপরে চব্বিশকে স্থান দেয়ার চেষ্টা করা এবং বাহাত্তরের সংবিধানকে ‘মুজিববাদী সংবিধান’ আখ্যা দিয়ে তার কবর রচনার কথা বলে বিপুল সংখ্যক মানুষের মনে যে বিরক্তি ও অসন্তুষ্টির জন্ম দিয়েছেন, তার মধ্য দিয়েও এনসিপির বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অথচ তাদের সামনে অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এসব বিষয়ের বাইরে গিয়ে একেবারে সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত দৈনন্দিন বিষয় নিয়ে তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রেখে ন্যূনতম কিছু সংস্কার বাস্তবায়নে বাধ্য করতে পারলে বরং তাদের জনপ্রিয়তা আরও বাড়ত। কিন্তু তারা এমন নীতিগত বিষয় নিয়ে ব্যস্ত ছিল যা সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করেনি।
যেসব কারণে তারা বিতর্কিত হয়েছে, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি রোধ করে নতুন উদ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়া এবং চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন টার্গেট করে ধীরে ধীরে পায়ের নিজের মাটি শক্ত করার সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে না গেলেও এনসিপির মধ্যে একধরনের তাড়াহুড়া লক্ষ্য করা যায়। তারা হয়তো এখনই ক্ষমতার অংশীদার হতে চায়। হতে পারে তারা অভ্যুত্থানের পরে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকায় আ্ত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে এবং তাদের অনেকে টাকা ও ক্ষমতার স্বাদও পেয়েছেন। ফলে সেটাকে আরও বাড়িয়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, রাজনীতি একশো মিটার দৌড় নয়। এটা ম্যারাথন। এখানে ধীরে ধীরে এগোতে হয় এবং লম্বা রেসের ঘোড়ার মতো টিকে থাকতে হয়।
লেখক: সাংবাদিক

২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর আজ রোববার (২৮ ডিসেম্বর) প্রথমবারের মতো মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হলো।
১ দিন আগে
লক্ষ্মীপুরে বিএনপি নেতার বাড়িতে আগুন, তাঁর দুটি ছোট মেয়ের আগুনে পুড়ে মৃত্যু—এই ঘটনাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন দুঃখ নয়; এগুলো হলো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতার ধারাবাহিক ট্র্যাজেডি।
২ দিন আগে
গণঅভ্যুত্থানের পর মাঠে যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে, তার মধ্যে বিএনপির জনসমর্থন সবচেয়ে বেশি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারাই ক্ষমতায় যাবে বলে ধারণা সবচেয়ে জোরদার। অথচ দলটির সক্রিয় শীর্ষ নেতা এতদিন ছিলেন দেশে অনুপস্থিত।
২ দিন আগে
জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। গত ১৭ নভেম্বরের এই রায়ের বিপরীতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া ছিল বেশ অস্পষ্ট ও রহস্যজনক।
২ দিন আগে