leadT1ad

যেভাবে খালেদা জিয়া দক্ষিণ এশিয়ার এক বিরল কূটনৈতিক মুহূর্তের কেন্দ্রে এলেন

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর এবং পাকিস্তানের পার্লামেন্টের স্পিকার সরদার আইয়াজ সাদিকের সাক্ষাৎ। ছবি: সংগৃহীত

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যু বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি নির্দেশ করে। তবে তাঁর জানাজাকে ঘিরে ঢাকায় বিভিন্ন দেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি শোকের গণ্ডি ছাড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক বাস্তবতায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত তৈরি করেছে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কাসহ সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিদের একসঙ্গে উপস্থিতি সাম্প্রতিক আঞ্চলিক রাজনীতিতে খুব কমই দেখা গেছে। এই উপস্থিতি কোনো আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক উদ্যোগ না হলেও, প্রতীকী দিক থেকে তাৎপর্য বহন করেছে।

এই ঘটনা কেবল শোক প্রকাশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। দীর্ঘদিনের বৈরী ও স্থবির আঞ্চলিক সম্পর্কের মধ্যে একটি বিরল সৌজন্যমূলক পরিসরও তৈরি করেছে। যদিও এই ঘটনাকে তাৎক্ষণিক কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখার সুযোগ সীমিত।

গত বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) দুপুরে ঢাকার জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ ব্লকের একটি কক্ষে এক টেবিলে বসেছিলেন সার্কভুক্ত ছয় দেশের প্রতিনিধিরা। সেখানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার সরদার আইয়াজ সাদিক ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বালা নন্দা শর্মা, ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডি এন ধুংগিয়েল, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত ও উচ্চশিক্ষামন্ত্রী আলী হায়দার আহমেদ এবং শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিজিতা হেরাথ।

সেখানে একপর্যায়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এগিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার সরদার আইয়াজ সাদিকের সঙ্গে হাত মেলান। ২০২৫ সালের মে মাসে চার দিনের ভারত–পাকিস্তান সংঘাতের পর এটিই দুই দেশের মধ্যে প্রথম উচ্চপর্যায়ের সরাসরি সৌজন্য বিনিময়। এর আগে ওই সংঘাতের পর যুদ্ধবিরতির কৃতিত্ব দাবি করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীন। এই প্রেক্ষাপটে ঢাকায় দুই দেশের প্রতিনিধিদের সরাসরি সৌজন্য বিনিময় কেবল একটি প্রোটোকল ইঙ্গিত নয়; তা দক্ষিণ এশিয়ার উত্তেজনাপূর্ণ বাস্তবতায় একটি ব্যতিক্রমী দৃশ্য হিসেবেই দেখা যায়।

একই দিনে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জয়শঙ্কর ও আইয়াজ সাদিক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শোকবার্তা সরাসরি তারেক রহমানের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পাকিস্তানের স্পিকারও সহমর্মিতা জানান। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে এই সাক্ষাৎগুলো দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শক্তিগুলোর রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে একটি নতুন বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়।

ঢাকায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার সরদার আইয়াজ সাদিকের সাক্ষাৎ। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার সরদার আইয়াজ সাদিকের সাক্ষাৎ। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের উপস্থিতি: বরফ গলার ইঙ্গিত, নাকি কূটনৈতিক শিষ্টাচার?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপির সঙ্গে ভারতের একটি প্রচ্ছন্ন দূরত্ব দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত। দিল্লির কূটনীতিতে বিএনপিকে এড়িয়ে চলার প্রবণতাও স্পষ্ট ছিল। সেই প্রেক্ষাপটে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকায় আগমন এবং বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ নতুন প্রশ্ন তৈরি করেছে।

এই নৈকট্য কি সম্পর্কের বরফ গলার ইঙ্গিত, নাকি নিছক রাষ্ট্রীয় শোক প্রকাশের কূটনৈতিক শিষ্টাচার—তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। বাস্তবতা সম্ভবত মাঝামাঝি। আপাতত এটি শিষ্টাচার। তবে কূটনীতিতে প্রতীক ও সংকেতকে কখনোই পুরোপুরি হালকাভাবে দেখা হয় না। দিল্লি হয়তো এটুকু জানিয়ে দিল যে, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করার কৌশল দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর নাও হতে পারে।

পাকিস্তানের স্পিকারের সফর: পুরোনো সম্পর্কের স্মরণ

পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার সরদার আইয়াজ সাদিকের ঢাকায় আগমন বিএনপি–পাকিস্তান সম্পর্কের পুরোনো ইতিহাস সামনে আনে। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের অংশ হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ দৃশ্যমানভাবে বেড়েছিল। বর্তমান রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এই সফর সেই পুরোনো ধারাবাহিকতার স্মরণ করিয়ে দেয়।

জানাজায় পাকিস্তানের স্পিকারের উপস্থিতি শুধু আনুষ্ঠানিক শোক প্রকাশ নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে ঢাকার গুরুত্ব এবং বিএনপির সঙ্গে ইসলামাবাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক এখনও পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় নয়—এমন একটি বার্তা দেয়।

কেন এই মুহূর্ত বিশেষ

দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক বাস্তবতা অত্যন্ত বৈরী। ভারত–পাকিস্তান সম্পর্ক কার্যত অচল। সার্ক দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয়। নেপাল ও ভুটান ভারত–চীন প্রতিযোগিতার চাপ সামলাচ্ছে। মালদ্বীপে ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণ বেড়েছে। শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সংকটের ধাক্কা সামলে নতুন ভারসাম্য খুঁজছে।

এই প্রেক্ষাপটে ঢাকায় একই দিনে এসব দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি একটি ব্যতিক্রমী দৃশ্য তৈরি করেছে। এটি বৈরিতা নিরসনের সূচনা না হলেও, অন্তত সৌজন্য রক্ষার ন্যূনতম রাজনৈতিক পরিসর এখনও যে পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।

জানাজা ও সার্ক: একটি স্মরণমাত্র

খালেদা জিয়ার জানাজায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিদের একসঙ্গে উপস্থিতি সংস্থাটির প্রয়োজনীয়তা নতুন করে সামনে এনেছে। এটিকে সার্কের পুনরুজ্জীবন বলা যাবে না। তবে এটি দেখিয়েছে যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে, আনুষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরেও আঞ্চলিক সংলাপের পরিসর তৈরি হতে পারে।

জানাজায় যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ৩২ দেশের কূটনীতিকের উপস্থিতি আরেকটি বার্তা দেয়। খালেদা জিয়া শুধু একটি দলের নেতা ছিলেন না। তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির দৃষ্টিতেও একটি পরিচিত রাজনৈতিক চরিত্র ছিলেন।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন ছিল কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে এগোনো দীর্ঘ এক যাত্রা। তাঁর জানাজাকে ঘিরে তৈরি হওয়া কূটনৈতিক দৃশ্যপট দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি বিরল মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এটি কোনো নতুন যুগের সূচনা নয়, তবে এটি মনে করিয়ে দিয়েছে—দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি চরম বৈরিতার মাঝেও কখনো কখনো শোক ও সৌজন্যের ভাষায় কথা বলতে পারে।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত