প্রকৃতির রুদ্ররোষে ভিটেমাটি হারিয়ে জীবন বাঁচাতে মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে অচেনা গন্তব্যে। কিন্তু সেই যাত্রা তাদের মুক্তি দিচ্ছে না, বরং ঠেলে দিচ্ছে এক নির্মম বাস্তবতার দিকে। যার নাম ‘আধুনিক দাসত্ব’। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। বেঁচে থাকার তাগিদে শহর কিংবা বিদেশে পাড়ি দিতে গিয়ে এসব মানুষ ঋণের জালে জড়াচ্ছে, হারাচ্ছে স্বাধীনতা এবং বাধ্য হচ্ছে অমানবিক শ্রমে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার এই বিপুল জনগোষ্ঠী এখন শোষণের নতুন হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসীদের ৯২ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে দাসত্বের শৃঙ্খলে আটকা পড়ছেন। আর প্রবাসীদের ক্ষেত্রে এই চিত্র আরও ভয়াবহ।
জলবায়ু অভিবাসন কী
সহজ কথায়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ বা পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে যখন কোনো ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী নিজেদের আদি নিবাস ছেড়ে অন্য কোনো স্থানে (দেশের ভেতরে বা বাইরে) চলে যেতে বাধ্য হয়, তখন তাকে জলবায়ু অভিবাসন বলা হয়।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করেছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মতে, পরিবেশের আকস্মিক বা ধীরগতির পরিবর্তনের ফলে জীবনযাত্রার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়লে যারা বাধ্য হয়ে বা স্বেচ্ছায় নিজ আবাসস্থল ত্যাগ করে, তারাই পরিবেশগত অভিবাসী।
বিশ্বব্যাংকের ‘গ্রাউন্ডসওয়েল’ প্রতিবেদনে মূলত দেশের অভ্যন্তরে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়াকে জলবায়ু অভিবাসন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জাতিসংঘের আইপিসিসির তথ্য অনুসারে, এটি ঝুঁকি মোকাবিলার একটি উপায় বা অভিযোজন কৌশল। যখন কোনো স্থানে বসবাস অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন মানুষ নিরাপত্তার স্বার্থে অভিবাসন বেছে নেয়।
অন্যদিকে ইউএনএইচসিআর আইনি জটিলতা এড়াতে ‘শরণার্থী’ শব্দের বদলে ‘জলবায়ু পরিবর্তন এবং দুর্যোগের প্রেক্ষাপটে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি’ শব্দটি ব্যবহার করে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি: বিশ্বের পঞ্চম সর্বোচ্চ বাস্তুচ্যুতি
জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাতে বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মনিটরিং কেন্দ্রের (আইডিএমসি) সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন পঞ্চম।
দেশে বর্তমানে গড়ে প্রতি বছর ৯ লাখ ১৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, যা গত এক দশকে ছিল গড়ে ৭ লাখ। উপকূলীয় জেলা ভোলা, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও সাতক্ষীরা থেকে মানুষ সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুত হচ্ছে বলে জানিয়েছে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)।
ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস আরও উদ্বেগজনক। তাদের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসীর সংখ্যা ১ কোটি ৯৯ লাখে পৌঁছাতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মোট সংখ্যার প্রায় অর্ধেক।
২১০০ সালের শঙ্কা ও অর্থনৈতিক চাপ
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেলের (আইপিসিসি) ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দীর্ঘমেয়াদি ভয়াবহতার চিত্র উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা শূন্য দশমিক ৪৮ থেকে ২ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ২১ লাখ (২.১ মিলিয়ন) মানুষ অভিবাসনে বাধ্য হতে পারে।
এই বিপুলসংখ্যক মানুষের স্থানান্তর দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ২১ লাখ মানুষের মধ্যে অন্তত ৫ লাখ ৯৪ হাজার জনের নতুন চাকরির প্রয়োজন হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন হবে ১ লাখ ৯৭ হাজার অতিরিক্ত বাসস্থান এবং বিপুল পরিমাণ বাড়তি খাদ্য নিরাপত্তা। এছাড়া তাপমাত্রা বাড়লে রোগবালাই বৃদ্ধি ও শিশু মৃত্যুর হার বাড়ার আশঙ্কার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
চড়া মূল্যে ‘আধুনিক দাসত্ব’ বরণ
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সহায়-সম্বল হারিয়ে মানুষ যখন নতুন জীবনের খোঁজে বের হয়, তখনই তারা পড়ে শোষণের ফাঁদে। আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও উন্নয়ন ইন্সটিটিউটের (আইআইইডি) ‘এক্সপোজড অ্যান্ড এক্সপ্লয়েটেড’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু ঝুঁকির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর দেশের ভেতরে অন্য শহরে স্থানান্তরের সম্ভাবনা ১৬১ শতাংশ এবং বিদেশে যাওয়ার সম্ভাবনা ২১৪ শতাংশ বেড়ে গেছে।
কিন্তু এই অভিবাসনের মূল্য অত্যন্ত চড়া। গবেষণার তথ্যমতে, বিদেশে অভিবাসনের ক্ষেত্রে পিরোজপুরের একটি পরিবারের গড় খরচ হয় ৪ লাখ ৬১ হাজার ২২০ টাকা। সিলেটের পরিবারের ক্ষেত্রে এই খরচ ৪ লাখ ১৩ হাজার ৬৬৭ টাকা।
এই বিপুল অর্থের জোগান দিতে অধিকাংশ পরিবার জমি বিক্রি করে কিংবা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নেয়। ফলে তারা দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জালে আটকে যায়।
শোষণের নির্মম চিত্র
ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে যারা শহর বা বিদেশে পাড়ি জমান, তাদের অনেকেই আর স্বাধীন মানুষ হিসেবে বাঁচতে পারেন না। আইআইইডির জরিপকৃত ৬৪৮টি খানার মধ্যে ৭০ দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ খানাতেই অভিবাসী সদস্য পাওয়া গেছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে আধুনিক দাসত্বের ভয়াবহ চিত্র। অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসীদের অন্তত ৯২ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে দাসত্বের শিকার হচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ছাড়াই দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, নামমাত্র মজুরি এবং বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে তাদের।
আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের বড় অংশই পাড়ি দিচ্ছেন উপসাগরীয় দেশগুলোতে। এদের এক-তৃতীয়াংশই ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। প্রবাসীদের ক্ষেত্রে শোষণের হার প্রায় শতভাগ।
বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসে ভিটেমাটি হারানোর পর মানুষ ভেবেছিল নতুন জায়গায় হয়তো মুক্তি মিলবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, প্রকৃতির রোষানল থেকে বাঁচতে গিয়ে তারা মানুষের তৈরি শোষণ ও দাসত্বের নতুন এক কারাগারে বন্দি হচ্ছেন।