তারেক রহমানের মতো এমন সংঘবদ্ধ মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার ব্যক্তি দুনিয়ায় কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে তাঁকে ব্যাপকভাবে ডেভিলাইজ করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম সারির প্রায় সব মিডিয়া তাতে যোগ দিয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জিঘাংসা, মিডিয়ার টানা অপপ্রচার কাটিয়ে বিস্ময়করভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তারেক রহমান। হয়ে উঠেছেন এমনকি তাদেরও ভরসাস্থল, যারা ডেভিলাইজ করেছিল তারেক রহমানকে।
কেমন ছিল এই জার্নি? কীভাবেই-বা তারেক রহমান হয়ে উঠলেন ভরসাস্থল? ১৯৮৮ সালে বগুড়া জেলা বিএনপির গাবতলী উপজেলা ইউনিটের সদস্য হিসেবে তাঁর আনুষ্ঠানিক রাজনীতি শুরু। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় মা খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাজপথে তারেক রহমানকে দেখা যায়। পরে প্রথমবার ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তিনি নানা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ান। কিন্তু তাঁকে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় দেখা যায় ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে। ওই নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নির্বাচন পরিচালনায় বিশেষ কার্যালয় স্থাপনসহ নানা বিষয় তারেক রহমান নিজে দেখভাল করেন।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের নিরঙ্কুশ জয়ের পর তারেক রহমান ২০০২ সালের ২২ জুন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হন। গঠনতন্ত্রের বাইরে ওই পদ তৈরি করে বিএনপি দায়িত্ব দিলে সারাদেশে সাংগঠনিক সফর করেন তিনি। সংগঠন শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
মিডিয়া ট্রায়াল ও পরিকল্পিত ‘ডেভিলাইজেশন’
এটি সবার জানা, দুর্নীতির অভিযোগে আটক হয়ে ১৮ মাস কারাগারে থাকার পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান তারেক রহমান। পরে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকা ছাড়েন তিনি। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়ার শাসনামলে তারেক রহমানকে ‘দুর্নীতির রাজপুত্র’ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো ঘৃন্য ঘটনা থেকে শুরু করে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার, হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়ে তারেক রহমানকে ‘ভিলেন’ বানিয়ে বয়ান (ন্যারেটিভ) তৈরি করা হয়েছে, যা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে সংস্কারের নামে মাইনাস-টু ফর্মুলা ও বিরাজনীতিকরণের ১/১১ সরকারের সময়ে।
সেই সময়কার সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, তার বিভিন্ন বাহিনী এবং দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো তারেক রহমানকে চূড়ান্তভাবে ডেভিলাইজেশন প্রজেক্ট হাতে নেয়। সম্প্রতি এক জ্যেষ্ঠ সম্পাদক তাঁদের সেই সময়ের কর্মকাণ্ডের জন্য টিভি শোতে বলেছেন, সরকারি গোয়েন্দা বাহিনীর সরবরাহ করা চোতা ব্যবহার করে তাঁরা নিউজ করায় ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। তখন তাঁরা ভালো সাংবাদিকতা করতে পারেননি। সেই ভালো সাংবাদিকতা করতে ‘না পারা’র প্রধান ভিকটিম কিন্তু ছিলেন তারেক রহমান।
ফখরুদ্দীন-মইন ইউ আহমেদ সরকারেরই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আওয়ামী লীগ। সহযোগী হিসেবে পায় সংবাদমাধ্যমকে। বিশেষ শিল্পগোষ্ঠীর মালিকানাধীন কয়েকটি রীতিমতো প্রথম শ্রেণির অনলাইন নিউজমিডিয়া তারেক রহমানের বিপক্ষে নিউজ পিন করে রেখেছিল মাসের পর মাস। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদসহ হেন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে যাচ্ছেতাই পোর্ট্রে করা হয়নি। বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে ইচ্ছা মাফিক রায় পর্যন্ত লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে। এমনকি আদালতের রায়ে ফেরারি হিসেবে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচার পর্যন্ত নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এত কিছু তিনি কীভাবে মোকাবিলা করলেন? সব সময় দলকে পাশে পেয়েছেন তারেক রহমান।
লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার পরের বছর অনুপস্থিতিতে হওয়া সম্মেলনে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন তারক রহমান। ২০১৮ সালে খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর তাঁকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে বিএনপি। তখন থেকে বলতে গেলে তিনিই দল চালিয়েছেন। দলে নিজের অবস্থান অনস্বীকার্য করে তুলেছেন।
এটা তো দলের কথা। দলের বাইরেও তারেক রহমান প্রতিনিয়ত নিজেকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন। এমনকি প্রথম আলো, ডেইলি স্টারের সম্পাদক পর্যন্ত, ২১ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে বিএনপির সভায় যোগ দিয়ে তারেক রহমানকে বারবার তাঁদের ভরসাস্থল উল্লেখ করেছেন।
২০১৪ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও, এর দায় অনেকেই তারেক রহমানের ওপর দিয়েছিল। পরের নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান–প্রতিদিনই তাঁর রাজনৈতিক জার্নিকে কঠিন করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তিনি ভরসা রেখেছেন দলের কর্মী ও জনগণের ওপর। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যেমন করে থাকেন। এর ফলও তিনি পেয়েছেন। নিজ দল তো বটেই, ভদ্রভাষায় যাদের ভিন্নমত বলা হয়, তাদের কাছেও অবিকল্প হয়ে উঠেছেন তিনি।
তারেক রহমান গত ১৭ বছরের নির্বাসন জীবনে কখনো প্রতিশোধের কথা বলেননি। মায়ের মতোই তিনি দারুণ সংযত, মিতবাক। কখনো তাঁকে উত্তেজিত হতে দেখা যায় না। দেখা যায় না আগ্রাসী চেহারায়, যা মিডিয়া ট্রায়ালে তাঁর ব্যক্তিত্বের দানবকরণের সম্পূর্ণ বিপরীত। নমনীয় আচরণের মাধ্যমে তারেক নিজের বিরুদ্ধে দানবকরণের চেষ্টা নস্যাৎ করেছেন। তিনি এমনকি শেখ হাসিনাকেও রুঢ় ভাষা বা ক্ষুব্ধ চেহারায় কিছু বলেন না। ধীর কিন্তু দৃঢ় তাঁর বাচনভঙ্গি। ফিরে আসার পর প্রথম বক্তৃতাতেও শেখ হাসিনার নাম নেননি তারেক রহমান।
২০২৪ সালের ৮ জানুয়ারির নির্বাচনের পর যখন সম্ভাবনাশূন্য অবস্থা চারদিকে, তখনও তারেক রহমান বিভূই থেকে প্রতিনিয়ত নেতাকর্মীকে তাতিয়েছেন অনলাইনে, বুস্টাপ করেছেন। মামলা, হামলা, পালিয়ে থাকা কর্মীদের খোঁজ নিয়েছেন। শোনা যায়, একদম ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকেও তিনি ফোন করতেন।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর সবাই যখন যে যার মতো নিজের পাতে ঝোল টানতে ব্যস্ত, তারেক রহমান তখনো বারবার ঐক্যের কথা বলেছেন। তিনি জুলাই আন্দোলনের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড কিনা জানতে চাইলে বিবিসির সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এই আন্দোলন সবাই মিলে হয়েছে। নিজেকে বড় করার বা ক্রেডিট নেওয়ার কোনো চেষ্টা তিনি করেননি। যে ইনক্লুসিভ বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে গত দেড় বছর ধরে, তার সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড অ্যাম্বেসেডর সম্ভবত তারেক রহমান।
১৭ বছর পর ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরে যে ভাষণ দিয়েছেন তারেক রহমান, সেখানেও ছিল ঐক্যের ডাক। সবাইকে নিয়ে দেশ গড়ার প্রত্যয় আর ন্যায়পরায়ণতার আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ চেষ্টার প্রতিশ্রুতি। পূর্বাচলে লাখো মানুষের সমাবেশ মঞ্চে দাঁড়িয়ে তারেক রহমান স্মরণ করেন মার্টিন লুথার কিংয়ের অমর বাণী, ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’। তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে তিনি বলেন, ‘আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান; ফর দি পিপল অব মাই কান্ট্রি, ফর মাই কান্ট্রি।’ এরপরে তিনি আবার বলেন, ‘উই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান।’ মানে তিনি সবাইকে নিয়ে এগোতে চান। তাঁর স্বপ্ন আর পরিকল্পনায় সবাই আছেন। আর তা বাস্তব করতেও সবাইকে চাই।
তারেক জানেন, জুলাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কত বড় ফেনোমেনা। তাই দেশে ফিরে তিনি জুলাইয়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘১৯৭১ সালে এদেশের মানুষ যেমন স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, ২০২৪ সালে এদেশের ছাত্র-জনতাসহ সর্বস্তরের মানুষ, কৃষক-শ্রমিক, গৃহবধূ, নারী-পুরুষ, মাদ্রাসার ছাত্রসহ দলমত, শ্রেণি-পেশার সব মানুষ ৫ আগস্ট এই দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করেছিল।’ স্মরণ করেছেন শহীদ ওসমান হাদিকে।
রাষ্ট্র পরিচালনার প্রস্তুতি
তারেক রহমানের আরেকটি বিষয় নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। সেটা হলো তাঁর প্রস্তুতি। প্রত্যেক রাজনীতিক কিংবা যেকোনো ব্যক্তির তাঁর কর্মজীবনের ক্ষেত্রে একটা প্রস্তুতি থাকে। তারেক রহমান সম্ভবত শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া-উত্তর একমাত্র ব্যক্তি, যিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। আর কেউ এই প্রস্তুতি নেননি। ফলে তাঁকে ধারণ করতে হবে এই দেশকে, জানতে হবে এই দেশকে। সেটা তিনি খুব ভালোভাবেই নিয়েছেন বলে মনে হয়। যে ৩১ দফার ওপর তাঁর দল আমল করার বাসনা করছে, তাঁর দিকে তাকালেই স্পষ্ট হবে–তারেক রহমানের প্রস্তুতি, উদারতা, স্বপ্ন ও পরিকল্পনা।
কিন্তু, হ্যাঁ, আমাদের সামনে সব সময় যদি-কিন্তু থাকে। থাকে অন্ধকার। আমাদের অতীতের দিকে তাকালে–ভারী অন্ধকারের পাল্লা। বিএনপির মতো একটি দলের নেতা হওয়াও কম ঝুঁকির না। বিশাল নেতাকর্মীদের সব সময় দায়বদ্ধ রাখা, দলকে শৃঙ্খলে রাখা বরং প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে তাঁর পরিকল্পনা বা স্বপ্ন বাস্তবায়নে। যে যুদ্ধে তারেক রহমান সেনাপ্রধান, সেই যুদ্ধে তাঁর সৈনিকরা প্রস্তুত তো?
আপাতত তারেক রহমান এক প্রত্যাশার নাম। প্রত্যাশার চাপও থাকবে তাঁর ওপর। নিজের দল, সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে নিন্দুকেরাও আজ তারেক রহমানের দিকে তাকিয়ে আছে ভরসাস্থল ভেবে। যারা তাঁর অনুসারী, তাঁরা সোনা-রুপা যাচাই না করলেও অন্যরা তো করবেনই। ফলে ১৭ বছরের আগুনে পুড়ে কতটা খাঁটি হয়েছেন তারেক রহমান, তা পরীক্ষা করার লোক যেমন আছেন, তেমনি আছে তাঁর ওপর প্রত্যাশা নামের বিরাট সিন্দাবাদের ভূত। জুলাই উত্তর বাংলাদেশে একদিকে যেমন ডানপন্থার উত্থান ঘটেছে। এমনকি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও একাধিকবার ‘ডানপন্থার উত্থান’ ঘটেছে মর্মে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সেই শঙ্কার বিপরীতে আওয়ামীপন্থী সাবেক অসাম্প্রদায়িক বয়ান চূড়ান্তরূপে ব্যর্থ হয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, বিগত সময়ে তারেক রহমান নিজেকে একটি বিকল্প হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য প্রয়াস নিয়েছেন। এমন এক জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের মধ্যে তারেক রহমান হয়ে উঠেছেন এক ‘অবিকল্প নেতা’। রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘ নির্বাসন কাটিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে তিনি। তাঁকে স্বাগতম।