leadT1ad

২১ ডিসেম্বর কেন বছরের দীর্ঘতম রাত, পৃথিবীর নানা প্রান্তে যেভাবে উদযাপন হয়

আজ ২১ ডিসেম্বর। আমাদের অর্থাৎ উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোর জন্য আজকের রাতটি বিশেষ। কারণ আজ বছরের দীর্ঘতম রাত এবং ক্ষুদ্রতম দিন। এই ‘উইন্টার সলস্টিস’ বা শীতকালীন অয়নকাল পৃথিবীর নানা প্রান্তে কীভাবে উদযাপন হয়?

ফাবিহা বিনতে হক
ফাবিহা বিনতে হক

প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১: ২২
স্ট্রিম গ্রাফিক

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও, সুখের সন্ধানে যাও।’ মানুষ বোধহয় সেই সন্ধানেই নিত্যদিনের ভিড়ের মধ্যে ছোট ছোট উপলক্ষ খোঁজে। কীভাবে সাধারণ দিন একটু উৎসবমুখর হবে, একটু অন্যরকম কাটবে। বছরের দীর্ঘতম রাতটিও তেমনই এক উপলক্ষ অনেকের কাছে। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বছরের দীর্ঘতম রাতটি তাঁরা কাটায় প্রবল আনন্দে, নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে।

উত্তর গোলার্ধে ২১ ডিসেম্বর বছরের দীর্ঘতম রাত। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘উইন্টার সলস্টিস’ বা শীতকালীন অয়নকাল।

কেন ২১ ডিসেম্বর বছরের দীর্ঘতম রাত?

উত্তর গোলার্ধে ডিসেম্বর মানেই কনকনে ঠান্ডা। শীতকালে রাতের দৈর্ঘ্য স্বাভাবিকভাবেই বেশি হয়ে থাকে। কারণ, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরার সময় একদম সোজা হয়ে থাকে না, বরং ২৩.৫ ডিগ্রি কোণে একটু হেলে থাকে। বছরের এই সময়টায় এই দিনে উত্তর গোলার্ধ সূর্যের দিকে কম হেলে থাকে।

এর ফলে সূর্যের আলো এই অংশে খুব কম সময়ের জন্য পড়ে এবং তা তির্যকভাবে বা বাঁকা হয়ে পড়ে। তাই দিন হয় ছোট, আর রাত হয় দীর্ঘ। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের এখানে ২১ ডিসেম্বর যখন দীর্ঘতম রাত, তখন পৃথিবীর উল্টো পিঠে অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে আজ বছরের দীর্ঘতম দিন!

তবে এই প্রাকৃতিক পরিবর্তন কেবল একটি ভৌগোলিক ঘটনা নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন জনপদের মানুষের কাছে এটি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বছরের দীর্ঘতম এই রাতটিকে ঘিরে দেশভেদে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস, তবে সবার মূল সুর একটাই, রাতের অন্ধকারকে বিদায় জানিয়ে নতুন আলোকে বরণ করে নেওয়া।

ইরান: শাব-ই-ইয়ালদা

ইরান ও আশেপাশের দেশগুলোতে যেমন-আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং কিছু ককেশীয় অঞ্চলের দেশ যেমন আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ায় কিছু অঞ্চলে ও সম্প্রদায়ে বছরের দীর্ঘতম রাতটিতে এই শাব-ই-ইয়ালদা উদযাপিত হয় অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে। তারিখ ২০–২১ বা ২২ ডিসেম্বরে হয়। ফারসি শব্দ ‘ইয়ালদা’-র অর্থ জন্ম; অর্থাৎ তাঁরা বিশ্বাস করে দীর্ঘতম এই অন্ধকারের পরেই সূর্যের পুনর্জন্ম হয়।

ইরানে শাব-ই-ইয়ালদা। সংগৃহীত ছবি
ইরানে শাব-ই-ইয়ালদা। সংগৃহীত ছবি

ইরান ছাড়াও এসব অঞ্চলের মানুষ যেসব কারণে শাবে ইয়ালদা উদযাপন করে থাকে তার মধ্যে শীতের আগমন প্রধান। আর তাঁরা মনে করে অন্ধকার মন্দের প্রতীক। শাবে ইয়ালদার পর প্রথম সকাল অন্ধকার ও অশুভ শক্তির উপর সূর্য এবং আলোর বিজয়ের সূচনা। অর্থাৎ এ রাতেই আলোর কাছে আধার পরাজিত হয় এবং এ রাত থেকেই মানবজাতির জন্য সুদিনের পালা বইতে শুরু করে। তাই তাঁরা এই রাতকে উৎসব হিসেবে উদযাপন করে থাকে।

এই রাতে কেউ একা ঘুমায় না। পরিবারের সবাই বয়োজ্যেষ্ঠ কারও বাড়িতে জড়ো হন এবং মেঝেতে বা টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে বসেন। পারিবারিক এই আড্ডায় খাবারের টেবিলে ফল, বিশেষ করে ডালিম ও তরমুজ থাকাটা বাধ্যতামূলক। তাঁদের বিশ্বাস, এই ফলগুলোর লাল রং ভোরের সূর্যের আভা ও জীবনের শক্তির প্রতীক।

এই উৎসবের সবচেয়ে প্রাণবন্ত অংশ হলো কবিতা পাঠ। পরিবারের মুরুব্বিরা পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফিজের ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ’ খুলে কবিতা আবৃত্তি করেন এবং নিজেদের জীবনের সাথে কবিতার লাইনগুলো মেলানোর চেষ্টা করেন।

চীন: দংঝি উৎসব

প্রাচীন চীনা দর্শন ও ঐতিহ্যে ২১–২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে হওয়া ‘দংঝি’ উৎসব, যার আক্ষরিক অর্থ ‘শীতের চরম পর্যায়’। চীনারা মনে করে, এই দীর্ঘতম রাতে প্রকৃতির নেতিবাচক শক্তি বা ‘ইন’ সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে, আর এর পর থেকেই ইতিবাচক শক্তি বা ‘ইয়াং’ বাড়তে শুরু করে। তাই এটি তাদের কাছে ভারসাম্য ফিরে পাওয়ার উৎসব।

চীনে দংঝি উৎসব। সংগৃহীত ছবি
চীনে দংঝি উৎসব। সংগৃহীত ছবি

চীনের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ এই দিনে ‘তাংইউয়ান’ নামের এক বিশেষ ধরণের খাবার খায়। এটি মূলত আঠালো চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি রঙিন মিষ্টি বল, যা গরম সিরাপ বা স্যুপের সাথে পরিবেশন করা হয়। চীনা ভাষায় ‘তাংইউয়ান’ শব্দটি পুনর্মিলনের মতো শোনায় বলে এটি তাঁদের কাছে পারিবারিক ঐক্যের প্রতীক।

জাপান: তোজি

জাপানিদের কাছে এই রাতটি ‘তোজি’ নামে পরিচিত। তারা এই বিশেষ রাতটিকে মূলত স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিন হিসেবে পালন করে।

এই উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও আরামদায়ক প্রথা হলো ‘ইউজু বাথ’ বা সুগন্ধি স্নান। জাপানিরা বিশ্বাস করে, বছরের দীর্ঘতম এই রাতে গরম পানির বাথটাবের মধ্যে অনেকগুলো আস্ত ‘ইউজু’ ফল (এক ধরণের সুগন্ধি লেবু) ভাসিয়ে গোসল করলে শরীর পবিত্র হয়। ফলের তীব্র সুগন্ধ অশুভ শক্তি দূর করার পাশাপাশি সারাবছর সর্দি-কাশি ও ত্বক ফাটা থেকে রক্ষা করে।

স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি খাবারের পাতেও থাকে বিশেষত্ব। এই দিনে তাঁরা ‘কাবোচা’ বা জাপানি মিষ্টি কুমড়া রান্না করে খায়। তাঁদের ধারণা, এই সবজিটি শীতকালে শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

যুক্তরাজ্য: স্টোনহেঞ্জ

যুক্তরাজ্যের উইল্টশায়ারে অবস্থিত পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো রহস্যময় পাথরের স্থাপনা ‘স্টোনহেঞ্জ’ এই রাতটিতে হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। এই স্থাপনাটি এমন নিখুঁত জ্যামিতিক মাপে তৈরি যে, বছরের দীর্ঘতম রাতে উইন্টার সলস্টিসে সূর্য দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে স্টোন সার্কেলের সঙ্গে ‘অ্যালাইন’ করে অস্ত যায়।

এই দৃশ্য দেখতে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ও অনেক প্যাগান ধর্মাবলম্বীরা এখানে ভিড় করেন। সাদা আলখেল্লা পরা ড্রুইডরা প্রাচীন মন্ত্র পাঠ করেন, আর সাধারণ মানুষ সারারাত জেগে গান-বাজনা ও নাচে মেতে থাকেন। তাঁদের এই দীর্ঘ অপেক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো অস্ত যাওয়া সূর্যকে বিদায় দেওয়া এবং পরদিন ভোরে পাথরের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেওয়া নতুন ও শক্তিশালী সূর্যকে স্বাগত জানানো।

রাত যত দীর্ঘই হোক না কেন, তার শেষ কিন্তু আছেই। তাই বছরের দীর্ঘতম রাতটিতে মন ভালো হওয়ার মত কিছু করুন। প্রিয়জনের সঙ্গে গল্প করুন, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিন, বাকেট লিস্টে পড়ে থাকা মুভিটি দেখে ফেলুন অথবা সারা বছরের ‘না হওয়া ঘুমের’ আক্ষেপ কিছুটা হলেও দূর করুন এক রাত ভালো মতো ঘুমিয়ে। অর্থাৎ বছরের দীর্ঘতম রাতটি উপভোগ করুন নিজের মতো করে, যাতে সামনের দীর্ঘ দিবসগুলো আরও সহজ ও সফলভাবে কাটানোর উৎসাহ ফিরে পেতে পারেন।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত