বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ‘টাঙ্গাইল শাড়ি বুননশিল্প’কে অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেসকো। তবে অভিযোগ উঠেছে, এই প্রক্রিয়ার শুরুতেই ‘বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংবেদনশীলতা’র কথা তুলে ধরে টাঙ্গাইলের শাড়ির বদলে গোপালগঞ্জের নৌকাকে ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে তৎপরতা চালিয়েছিলেন ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেসকোতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি খন্দকার মোহাম্মদ তালহা। এ বিষয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরেছেন তিনি। তাঁর দাবি, এই অভিযোগ সঠিক নয়, কারণ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আগেই এ বিষয়ে প্রস্তাবনা দিয়েছিল। রাষ্ট্রদূতের এই দাবির সত্যতাও পেয়েছে স্ট্রিম। তাঁর চিঠি লেখার এক সপ্তাহ আগেই মন্ত্রণালয়ে এক ডিও লেটারে এ বিষয়ে প্রস্তাবনা করা হয়েছিল।
রাষ্ট্রদূত তালহা পাল্টা অভিযোগ করেছেন, বরং অদক্ষতা ও দুর্বল উপস্থাপনার কারণে ইউনেসকো থেকে ফেরতও এসেছিল ‘টাঙ্গাইল শাড়ি শিল্প বুনন’সহ আরও দুটি প্রস্তাবনা। এই প্রস্তাবনা আরও উন্নত করতেই আলোচিত সেই চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন তিনি।
ভারতের দিল্লিতে ইউনেসকো ২০০৩ কনভেনশনের ‘২০তম আন্তঃরাষ্ট্রীয় পর্ষদের’ যে সভায় সর্বসম্মতিক্রমে টাঙ্গাইল শাড়ির বুনন শিল্পকে ‘অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেই সভায় বাংলাদেশ দলের নেতৃত্বও দিচ্ছেন খন্দকার মোহাম্মদ তালহা। সেখান থেকেই তাঁর সঙ্গে কথা হয় স্ট্রিম প্রতিবেদকের। অভিযোগের বিষয়ে তাঁর ভাষ্য, দুর্বল উপস্থাপনার কারণে ইউনেসকো থেকে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি শিল্প বুনন’সহ দুটি প্রস্তাবনা ফিরিয়ে দেওয়ার হয়েছিল। যা ২০২৪ সালের ৫ এপ্রিল ইউনেসকো থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে জানানো হয় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের তৎকালীন মহাপরিচালক কামরুজ্জামানকে। এর প্রেক্ষাপটে শেষ মুহূর্তে সেই ফাইল নতুন করে লেখার জন্য রাষ্ট্রদূত এম তালহা সংস্কৃতি বিষয় মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদকে চিঠি দেন। চিঠিতে বলা হয়, যাতে লেখনীর উন্নয়ন ও কারিগরি শর্তাবলি পূরণ করে সম্পূর্ণ নথিটি জমা দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রদূত খন্দকার মোহাম্মদ তালহা চিঠিসংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অদূরদর্শিতার অভিযোগ
অভিযোগ উঠেছে, রাষ্ট্রদূত এই চিঠি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে লিখেছিলেন। তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘খুশি করতেই’ গোপালগঞ্জের নৌকার বিষয়টি সামনে এনেছিলেন রাষ্ট্রদূত তালহা। যদিও এমন অভিযোগ অস্বীকার করে মোহাম্মদ তালহা বলছেন, গোপালগঞ্জের নৌকা নিয়ে প্রস্তাব তাঁর ব্যক্তিগত ছিল না। এটি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে নৌকার বিষয়টি বারবার উত্থাপন করা হয়েছে।
তালহার এমন দাবির প্রমাণ পাওয়া যায় ২০২৪ সালের ২৮ মার্চের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদের সই করা একটি ডিও লেটারে। যার ১ সপ্তাহ পরে চিঠিটি লিখেছিলেন রাষ্ট্রদূত।
খলিল আহমদের সই করা ডিও লেটারের একটি কপি স্ট্রিমের হাতে এসেছে। ইংরেজি লেখা ওই ডিও লেটারের শিরোনাম ছিল, ‘‘২০২৫ সালে মানবতার বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বমূলক তালিকায় সম্ভাব্য অন্তর্ভুক্তির জন্য ‘গোপালগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নৌকা তৈরির শিল্প’-এর মনোনয়ন প্রস্তাব।’’ লেটারে আরও উল্লেখ করা হয়, ইতিমধ্যে ১০টি হাই-কোয়ালিটি ছবি, সঙ্গে ৯ মিনিট ৪২ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপ ও ওই কমিউনিটির মতামত নিয়েছে তারা।
এরপর ওই বছরের ৩০ মার্চে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামানও একই চিঠি দেন।
রাষ্ট্রদূত তালহার ভাষ্য, ইউনেস্কোর নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে একটি ফাইলকে অগ্রাধিকার দিয়ে জমা দিতে হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় কোনো নিয়ম না মেনে কাঁসা শিল্প, নৌকা ও টাঙ্গাইল শাড়ি— এই তিনটি ফাইল একসঙ্গে পাঠিয়ে দেয়।
রাষ্ট্রদূত জানান, ফাইলগুলোর মান ছিল আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে অনেক নিচে। এমনকি ইউনেসকো তাদের পাঠানো একটি ফাইলে ২১টি ভুল পর্যন্ত ধরেছিল।
খলিল আহমদের সই করা ডিও লেটারটাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে বিতর্ক
টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে ভারত প্রসঙ্গ উল্লেখের বিষয়েও কথা বলেছেন রাষ্ট্রদূত খন্দকার মোহাম্মদ তালহা। তাঁর দাবি, তিনি আগেই সতর্ক করেছিলেন, টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে ভারতের সঙ্গে জিআই সংক্রান্ত স্পর্শকাতর সম্পর্ক রয়েছে। তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ও নিখুঁত প্রস্তুতি ছাড়া এটি পাঠানো ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের তাড়াহুড়ো ও দুর্বল লেখনীর কারণে ইউনেসকো ফাইলটি গ্রহণ না করে ফেরত পাঠায়। এটি ছিল দেশের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর পরিস্থিতি।
তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপেটে নৌকার ফাইল আসার আশঙ্কা করছিলাম আমি। নৌকার ফাইলই তাঁরা পুশ করবে জানতাম। তখন জাদুঘরের মহাপরিচালক ছিলেন কামরুজ্জামান সাহেব। তিনি তখন এক্সটেনশনে ছিলেন, মানে কন্ট্রাক্টে। যতদূর জানি, তখন কন্ট্রাক্ট রিনিউয়ালের (চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো) চেষ্টা করছিলেন তিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নৌকার ফাইলই যদি তিনি পাঠান, আর সেই ফাইল যদি ঠিকমত লেখা না হয়, আর কমিটি যদি তা গ্রহণ না করা হয়, তাহলে সব দোষ কিন্তু কামরুজ্জামানের হবে না। দোষ হবে আমাদের।’
ফাইলটি ফেরত আসার পর রাষ্ট্রদূত খন্দকার এম তালহা ও তাঁর টিম হাল ছাড়েননি। তিনি জানান, মন্ত্রণালয়ের ভুলে তাঁদের দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়েছে। প্যারিসে বসে মিশনের কর্মকর্তারা দিনরাত খেটে টাঙ্গাইল শাড়ির ফাইলটি নতুন করে লেখেন এবং কারিগরি ত্রুটিমুক্ত করেন। রাষ্ট্রদূতের এই ত্বরিত পদক্ষেপ ও পেশাদারত্বের কারণেই শেষ পর্যন্ত ফাইলটি পুনরায় জমা দেওয়া সম্ভব হয়।
রাষ্ট্রদূত খন্দকার মোহাম্মদ তালহা মনে করিয়ে দেন, গত চার বছর ধরে তিনি প্যারিসে যোগ্যতার সঙ্গেই কাজ করছেন। তাঁর কোনো দলীয় পরিচয় নেই, আছে শুধু পেশাদারত্ব। সমালোচকরাও তাঁর কাজের প্রশংসা করেছেন। মূলত মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা ঢাকতেই এখন রাষ্ট্রদূতের ঘাড়ে দায় চাপানোর চেষ্টা চলছে।