leadT1ad

২০২৫ সাল: অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জটিল যাত্রা

প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮: ২৭
স্ট্রিম গ্রাফিক

২০২৫ সালকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বিজয়ের বছর বলা যাবে না, আবার একেবারে ভেঙে পড়ার গল্পও নয়। এই বছরটা যেন মাঝনদীতে দাঁড়িয়ে থাকা একটি নৌকা; পেছনে তীব্র স্রোত, সামনে অজানা গন্তব্য। ধসের একেবারে কিনারা ছুঁয়ে অর্থনীতি ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের অভিঘাত, বৈদেশিক মুদ্রার টানাপোড়েন, মূল্যস্ফীতির চাপ আর ব্যাংকিং খাতের পুরোনো ক্ষত—সব মিলিয়ে ২০২৫ অর্থনীতিকে এনে দাঁড় করিয়েছে এক জটিল মোড়ে। ওপরে তাকালে কিছু সূচকে স্বস্তির আলো দেখা যায়, কিন্তু ভেতরে জমে থাকা অনিশ্চয়তা আর আস্থার সংকট এখনো পুরোপুরি কাটেনি।

এই কঠিন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের দেড় বছরের ব্যবস্থাপনা একেবারে ব্যর্থ বলা যাবে না। অন্তত অর্থনীতির জরুরি রক্তক্ষরণ অনেকটাই থামানো গেছে। বিশেষ করে বৈদেশিক খাতে রিজার্ভ ও রেমিট্যান্সে যে স্থিতিশীলতা এসেছে, তা না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারত। কিন্তু এই স্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রশ্নও ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে—এই উন্নতি কি সত্যিকারের পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত, নাকি কেবল সময় কেনার একটি সাময়িক বিরতি?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই সামনে আসে উচ্চ সুদের হার আর বিনিয়োগের স্থবিরতার গল্প। বর্তমানে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ১২ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে, যা ব্যবসার জন্য মোটেও সহায়ক নয় বলে শিল্পোদ্যোক্তাদের অভিযোগ। বাংলাদেশ যেহেতু একটি ঋণনির্ভর অর্থনীতি, তাই এই উচ্চ সুদ সরাসরি অর্থনৈতিক চাকার গতি কমিয়ে দিয়েছে। উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, নতুন প্রকল্প থমকে গেছে এবং উদ্যোক্তারা ঝুঁকি নিতে ভয় পাচ্ছেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যুক্তিতে সুদহার উচ্চ রাখা হলেও সরবরাহঘাটতি আর কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে কাঙ্ক্ষিত সুফল পুরোপুরি ধরা দিচ্ছে না।

এর প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতেও। ২০২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৩.৯৭ শতাংশে, যা আগের বছরের ৪.২২ শতাংশ থেকে কম। রাজনৈতিক অস্থিরতা আর কঠোর মুদ্রানীতির ছাপ এখানে স্পষ্ট, যা বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে তুলেছে। বিশ্বব্যাংক যেখানে প্রবৃদ্ধিকে ৪ শতাংশের কাছাকাছি ধরেছে, সেখানে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলছে ৩.৯ শতাংশ। তবে এই সংখ্যার আড়ালে একটি গল্প লুকিয়ে আছে। বছরের প্রথমার্ধে উৎপাদনে ধাক্কা এলেও দ্বিতীয়ার্ধে রপ্তানি আর রেমিট্যান্স অর্থনীতিকে ভর দিয়ে রেখেছে।

এই পুরো ছবির সবচেয়ে স্পষ্ট ক্ষতচিহ্ন হয়ে উঠেছে মূল্যস্ফীতি। সাধারণ মানুষের জীবনে এর চাপ সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়েছে। নভেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮.২৯ শতাংশে উঠেছে, যা আগের মাসের চেয়ে সামান্য বেশি। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ আর খাদ্যবহির্ভূত ৯.০৮ শতাংশ। চাল আর প্রোটিনজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ার কারণেই এই চাপ। বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতি ৯ থেকে ১০ শতাংশের ওপর ঘোরাফেরা করেছে; যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নীতির ফলে বছরের শেষে কিছুটা কমার ইঙ্গিত মিলছে। বৈশ্বিক জ্বালানি দামের ওঠানামা আর দেশের ভেতরের সরবরাহ সমস্যাই এখানে মূল কারণ, যা সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষকে। তবু আশার কথা, সরকারের ফিসকাল সংযম আর আমদানি নিয়ন্ত্রণ ঠিকঠাক থাকলে ২০২৬ সালের জুন নাগাদ এটি ৭ শতাংশের নিচে নামার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে।

এই অস্থিরতার মধ্যে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ভরসা হয়ে উঠেছে রেমিট্যান্স। ২০২৫ সালে মোট রেমিট্যান্স ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৫ থেকে ২৬ শতাংশ বেশি। শুধু নভেম্বরে এসেছে ২.৮৮ বিলিয়ন ডলার, যা ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি। মার্চে রেকর্ড ৩.২৯ বিলিয়নের পর জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এই পাঁচ মাসেই ২০২৬ অর্থবছরে এসেছে ১৩ বিলিয়ন ডলার। হুন্ডি দমন আর ফরমাল চ্যানেলে প্রণোদনাই এই সাফল্যের পেছনে বড় কারণ। প্রবাসীদের পাঠানো এই অর্থই তখন দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে, যখন অন্য অনেক খাত হাঁপিয়ে উঠছিল।

রপ্তানির চিত্রটা অবশ্য এতটা সরল নয়। তৈরি পোশাক খাত শক্ত থাকলেও সামগ্রিকভাবে ওঠানামা চোখে পড়ার মতো। নভেম্বরে রপ্তানি আয় নেমেছে ৩.৮৯ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের মাসের তুলনায় ৫.৫৪ শতাংশ কম। অক্টোবরে সামান্য ঘুরে দাঁড়ালেও আগস্টেই দেখা গিয়েছিল পতনের ইঙ্গিত। জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আরএমজি রপ্তানি ৩৫.৫৯ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা মূলত ইইউ আর যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদার ফল। কিন্তু কিছু পণ্যে উচ্চ মার্কিন ট্যারিফ আর বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়ায় বছরের শেষ দিকে ধস নেমেছে। খাতটি এখনো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তবে ঝুঁকিও কম নয়।

এই টালমাটাল অবস্থার মাঝেই কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি গ্রস রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩২.৭২ বিলিয়ন ডলারে, আর বিপিএম-৬ হিসাবে ২৮.০৩ বিলিয়ন। এক বছর আগের তুলনায় এই উন্নতি দেখায় যে ডলার ব্যবস্থাপনায় কিছুটা শৃঙ্খলা এসেছে। এই রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব, যা বৈশ্বিক ঝাঁকুনির সময় বড় ঢাল হিসেবে কাজ করছে। তবে ডলারের দাম ১২২ থেকে ১২৩ টাকায় ঘোরাফেরা করায় পুরো স্থিতিশীলতা এখনো নিশ্চিত নয়।

সবচেয়ে গভীর ক্ষতটা রয়ে গেছে ব্যাংকিং খাতে। খেলাপি ঋণের ভার যেন পুরো অর্থনীতিকে চেপে ধরেছে। সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ পৌঁছেছে ৬.৪৪ লাখ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ৩৫.৭৩ শতাংশ। এটি ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। নেট এনপিএল ২৬.৪ শতাংশ, যা এশিয়ায়ও সর্বোচ্চ পর্যায়ে। পুরোনো অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব আর দুর্বল তদারকিই এই সংকটের মূল কারণ। ব্যাংক একীভূতকরণ আর রেজল্যুশন অর্ডিন্যান্সের মতো সংস্কার শুরু হলেও এই খাত এখনো মেরামতের মাঝপথে আটকে আছে।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বেকারত্বের চাপ, যা অর্থনীতির সামাজিক দিকটাকে আরও গাঢ় করেছে। ২০২৫ সালে বেকারত্বের হার প্রায় ৫ শতাংশে পৌঁছেছে। যুব বেকারত্ব ১০ শতাংশের কাছাকাছি। মোট বেকার ২৭.৪ লাখ মানুষ। বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় নতুন চাকরি তৈরি হয়নি, ফলে দারিদ্র্যের চাপ বেড়েছে। সরকার দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি চালালেও এর প্রভাব এখনো খুব সীমিত।

খাদ্য আর জ্বালানি খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা থাকলেও বিতরণের দুর্বলতা বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের ওপরে থাকলেও আমদানি আর ওপেন মার্কেট সেলের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেছে। চালের দাম বেড়েছে, কিন্তু উৎপাদন স্থিতিশীল। জ্বালানি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি হলেও গড় সরবরাহ আটকে আছে ১৫ থেকে ১৬ হাজারে। এই ভারসাম্যহীনতাই দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করছে।

রাজস্ব আর ফিসকাল নীতিতে সংস্কারের চেষ্টা শুরু হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ভাগ করা হয়েছে, বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে ব্যয় সংকোচন করা হয়েছে। তবে রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত এখনো ১০ শতাংশের নিচে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। কাগজে নকশা তৈরি হলেও বাস্তবে দাঁড়াতে সময় লাগছে।

এই সবকিছুর ওপর ভর করে আছে বৈশ্বিক চাপ আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ, ইউরোপের চাহিদা কমে যাওয়া আর দেশের ভেতরের নির্বাচনী প্রস্তুতি নীতিনির্ধারণকে প্রভাবিত করছে। সুদহার ১৫ শতাংশে ওঠায় বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৬.৩৫ শতাংশে, যা দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। কেউ বলছেন, এই কঠোরতা মূল্যস্ফীতি ঠেকিয়েছে; কেউ বলছেন, এতে অর্থনীতি হাঁপিয়ে পড়েছে। এই দ্বন্দ্বই যেন ২০২৫ সালের অর্থনীতির আসল চরিত্র।

তবু সামনে তাকালে পুরো অন্ধকার নয়। ২০২৬ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪.৮ থেকে ৫.১ শতাংশে ওঠার সম্ভাবনা আছে। মূল্যস্ফীতি নেমে আসতে পারে ৫.৫ শতাংশে, যদি রাজনৈতিক স্থিরতা আসে আর সংস্কার থেমে না যায়। বিনিয়োগ আর কর্মসংস্থানই এখানে মূল চাবিকাঠি।

সব মিলিয়ে ২০২৫ সাল ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য মেরামতের বছর। পুরোপুরি সুস্থ নয়, কিন্তু আইসিইউ থেকেও বেরিয়ে আসার চেষ্টা স্পষ্ট। রেমিট্যান্স আর রিজার্ভ ভরসা দিলেও খেলাপি ঋণ, মূল্যস্ফীতি আর বেকারত্ব এখনো বড় ছায়া হয়ে আছে। এই ছায়া কাটাতে পারলে ২০২৬ সত্যিই নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে, যেখানে সংকট পেছনে পড়ে থাকবে আর সামনে এগোবে স্থিতিশীলতার আলো।

লেখক: ব্যাংকার এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

  • এই লেখাটি লেখকের ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ ও মতামত, যা প্রকাশিত সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত। এখানে উল্লিখিত মতামত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসেবে বিবেচ্য নয়।

তথ্যসূত্র:

১. বাংলাদেশ ব্যাংক, মান্থলি ইকোনমিক ট্রেন্ডস, বিভিন্ন সংখ্যা, ২০২৫ এবং অ্যানুয়াল রিপোর্ট ২০২৪-২৫, ঢাকা।

২. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, কনজুমার প্রাইস ইনডেক্স রিপোর্ট, নভেম্বর–ডিসেম্বর ২০২৫; এবং লেবার ফোর্স সার্ভে, সর্বশেষ সংস্করণ।

৩. বিশ্বব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট, অক্টোবর ২০২৫; এবং গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস, ২০২৫।

৪. এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক, ২০২৫, ম্যানিলা।

৫. এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো, এক্সপোর্ট স্ট্যাটিসটিক্স, জানুয়ারি–নভেম্বর ২০২৫, ঢাকা।

৬. আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক, অক্টোবর ২০২৫; এবং আর্টিকেল ফোর, কনসালটেশন বাংলাদেশ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত