leadT1ad

ঢাকা স্ট্রিমে গোলটেবিল

মেগা প্রকল্প থেকে উন্নয়নের দৃষ্টি ফেরাতে হবে মৌলিক চাহিদায়

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা

ঢাকা স্ট্রিমে ১৩ ডিসেম্বর ‘জলবায়ু সহনশীল ওয়াশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ অতিথিরা। স্ট্রিম ছবি

মেগা প্রকল্পভিত্তিক উন্নয়ন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে মানুষের মৌলিক চাহিদা—বিশেষ করে পানি, স্যানিটেশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়ে দৃষ্টি ফেরাতে হবে। যেখানে মানুষের খাবার পানি নেই, সেখানে হাজার কোটি টাকার অবকাঠামো নির্মাণ নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

আজ শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘ঢাকা স্ট্রিম’-এর সম্মেলন কক্ষে এক গোলটেবিল বৈঠকে এমন মত দেন আলোচকরা। ‘জলবায়ু সহনশীল ওয়াশ (ওয়াটার, স্যানিটেশন অ্যান্ড হাইজিন)’ শীর্ষক গোলটেবিলটি যৌথভাবে আয়োজন করে ঢাকা স্ট্রিম, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হেলভেটাস বাংলাদেশ ও ডর্প। প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

আলোচনায় উপকূলীয় অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রসঙ্গ টেনে উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘সেখানকার মানুষের কাছে যখন খাবার পানি পৌঁছায় না, তখন হাজার কোটি টাকার ব্রিজ বা রাস্তা নির্মাণ নৈতিকতার প্রশ্নে টেকে না।’ এজন্য জাতীয় বাজেটে মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে সেই অর্থ নদীভাঙন রোধ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নিরাপদ পানি সরবরাহের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয়ের আহ্বান জানান তিনি।

সেবা খাতের টেকসই উন্নয়নে জোর দিয়ে উপদেষ্টা বলেন, সার্ভিস সিস্টেম বা সেবা খাতের উন্নয়নের একমাত্র পথ হলো স্থানীয় সরকারকে পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা ও ক্ষমতা দেওয়া। খুলনায় ডিপ টিউবওয়েলের পরিবর্তে রেইনওয়াটার হারভেস্টিং এবং বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি সংকট মোকাবিলায় ফসলের প্যাটার্ন পরিবর্তনের মতো টেকসই সমাধানে যেতে হবে।

শিল্প দূষণ রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের অভাব এবং অবিবেচনাপ্রসূত প্রকল্প গ্রহণের সংস্কৃতির সমালোচনাও করেন তিনি।

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। স্ট্রিম ছবি
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। স্ট্রিম ছবি

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিস) গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর। তিনি জানান, বাংলাদেশে প্রায় ৭ কোটি ১ লাখ মানুষ এখনো নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত। উপকূলীয় জেলায় লবণাক্ততা এবং পার্বত্য ও হাওর অঞ্চলে বন্যা ও খরা ‘ওয়াশখাত’কে বিপর্যস্ত করছে। এ ছাড়া ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে স্যানিটেশন সুবিধাপ্রাপ্তিতে ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে।

ড. মাহফুজ কবীর বলেন, এই খাতে বাজেট বাস্তবায়নের হার বাড়লেও মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্র ৪৪২ টাকা, যা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। এজন্য এলজিইডি (স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর) ও ডিপিএইচই (জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর) একীভূত করা এবং স্থানীয় সরকারকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করার সুপারিশ করেন।

ডর্প-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন তাঁর বক্তব্যে উপকূলীয় অঞ্চল (মোড়লগঞ্জ, বাগেরহাট, কয়রা, পাইকগাছা) ও দুর্গম এলাকার মানুষের দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও লোনা পানির সমস্যা মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তিনি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) নবগঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্লাইমেট ফাইন্যান্স সেল’র সঙ্গে ওয়াশ কার্যক্রম যুক্ত করার উপর জোর দেন।

পানি ও স্যানিটেশন খাতটি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে স্বাস্থ্য বা বাণিজ্যের মতো গুরুত্ব পায় না। অথচ এটি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আয়োজনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে রাজধানীতে ওয়াশ ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ ও পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তিনি জানান, ঢাকায় বর্তমানে ৬০৫টি পাবলিক টয়লেট রয়েছে। এগুলোর মানোন্নয়নে ‘স্টার রেটিং’ ব্যবস্থা এবং ‘কোথায় যাব’ অ্যাপ চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া সুয়ারেজ বর্জ্য শোধনে দাশেরকান্দি প্রকল্প এবং পূর্বাচলে ভূগর্ভস্থ পানির পরিবর্তে নদীর পানি ব্যবহারের প্রস্তাবনার কথা উল্লেখ করেন।

সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খান জলবায়ু পরিবর্তন ও ওয়াশ খাতের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি আন্তর্জাতিক তহবিল নিশ্চিতে ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি), জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ন্যাপ) এবং লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ওয়াশ খাতের জন্য আলাদা ‘সেক্টরাল ন্যাপ’ প্রণয়ন এবং রাজনীতিবিদ, আমলা ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সমন্বয়েরও তাগিদ দেন।

ডর্প-এর ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর যোবায়ের হাসান আক্ষেপ করে বলেন, পানি ও স্যানিটেশন খাতটি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে স্বাস্থ্য বা বাণিজ্যের মতো গুরুত্ব পায় না। অথচ এটি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি এটি আলোচনায় সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন এবং গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে ধারাবাহিক ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানান।

গোলটেবিলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মজলিশে শুরার সদস্য ডা. মোহাম্মদ ফখরুদ্দিন মানিক বলেন, পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন সংকট দলীয় নয়, বরং জাতীয় ও মানবিক ইস্যু। তিনি বিশেষজ্ঞদের সুপারিশগুলো দলের উচ্চপর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার এবং আগামী নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন।

জলবায়ু ও জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারের চেয়ে বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দেন গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল। তিনি উপকূলীয় লবণাক্ততা ও সুন্দরবনের সংকটকে রাষ্ট্রনৈতিক সমস্যা এবং উজানের পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ার ফল হিসেবে চিহ্নিত করেন।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ডর্পের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এএইচএম নোমান, হেলভেটাস বাংলাদেশের প্রোগ্রাম প্রধান (পানি, খাদ্য ও জলবায়ু, কান্ট্রি অফিস) মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান, ডোমেন (জল, খাদ্য ও জলবায়ু) আয়াতুল্লাহ আল-মামুন, ঢাকা স্ট্রিমের সম্পাদক গোলাম ইফতেখার মাহমুদ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ড. মাহদী আমিন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা উত্তরণের পরিচালক শহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ভাইস চেয়ারম্যান ড. জামিল আহমেদ, বিএআইএসওএস-এর সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, ওয়াটার এইডের পলিসি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি লিড ফাইয়াজউদ্দিন আহমদ, পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ডা. আবু জামিল ফয়সাল প্রমুখ।

Ad 300x250

সম্পর্কিত