বহুল আলোচিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণা করেছেন আপিল বিভাগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের রায়ে দিলেও এই রায় আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নয়, পরবর্তী নির্বাচন থেকে কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন আপিল বিভাগ।
বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ এই রায় ঘোষণা করেন।
আপিল বিভাগের অপর ছয় সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
আজ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে প্রধান বিচারপতি ও অপর ছয় বিচারপতি এজলাসে আসেন। পরে রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশ ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি। রায়ে বলা হয়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সম্পর্কিত বিধানাবলি এই রায়ের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হলো।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত বিধানাবলি ভবিষ্যৎ প্রয়োগ যোগ্যতার ভিত্তিতেই কার্যকর হবে বলেও রায়ে ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি।
আপিলে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রায়ের পর তিনি আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেন, ‘আগের রায়টি দেখলেই বোঝা যায় তা ত্রুটিপূর্ণ ছিল। তার ভাষায়, ৪১ বছর পর জাতি আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে। তবে সংবিধানে ফিরলেও এটি বাস্তবে কার্যকর হবে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন থেকেই।’
আদালত আগের রায়টিকে ‘টেইন্টেড’ ও ‘এরর অ্যাপারেন্ট অন দ্য ফেস অব দ্য রেকর্ড’ বলেছেন বলে জানান শিশির মনির। তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণার যে রায় ছিল, তা পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। আদালতের ভাষায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা “রিভাইভড অ্যান্ড রেস্টোর্ড” হয়েছে।’
তবে এটি কখন কার্যকর হবে সে প্রশ্নে তিনি বলেন, পুনর্বহাল আদেশ কার্যকর হবে ভবিষ্যৎ থেকে। অর্থাৎ আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে না। এটি কার্যকর হবে চতুর্দশ জাতীয় নির্বাচনে।
রায় ব্যাখ্যা তিনি বলেন, সংবিধানের ৫৮(গ) অনুযায়ী সংসদ ভেঙে যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কথা। সংসদ ভেঙে গেছে অনেক আগেই, তাই বর্তমানে সেই কাঠামো বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে শিশির মনির বলেন, ‘১৯৮৪ সালে প্রথমবার জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব দিয়েছিল। এরপর দেশ অনেক কিছু দেখেছে—গুম-খুন, নির্বাচন ব্যবস্থার পতন, অস্থিরতা। ৪১ বছর পর আবার সবাই বুঝতে পারছে নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন।’
তাঁর মতে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা জাতিকে এই দীর্ঘ সংকটের মুখে ফেলেছিল। আদালতে তিনি যুক্তি দেন, গণতন্ত্র ও অবাধ নির্বাচন পরস্পরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। তত্ত্বাবধায়ক কাঠামো ছাড়া সেই নির্বাচন সম্ভব নয়।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরলেও পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের মামলা এখনো বিচারাধীন। এ নিয়ে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হবে কিনা এমন প্রশ্নে শিশির মনির বলেন, ‘পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল, যা হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছে। বিষয়টি আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়। তবে আজকের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহাল হওয়ায় মূল ইস্যুর নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। ওই মামলায় তত্ত্বাবধায়ক ছাড়াও আরও ২৯টি দফা আছে, যা আলাদাভাবে বিচার হবে।’
ভবিষ্যতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো কেমন হবে সে বিষয়ে তিনি জানান, বর্তমানে সংবিধানে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান রয়েছে। কিন্তু জুলাই সনদে চারটি বিকল্প প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা গণভোটে পাঠানো হচ্ছে। গণভোটে অনুমোদন পেলে এবং সংসদে পাস হলে কাঠামোয় বড় পরিবর্তন আসতে পারে। বর্তমান মডেলটি সেখানে চতুর্থ প্রস্তাব হিসেবে আছে।
দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে আশাবাদ জানিয়ে শিশির মনির বলেন, নির্বাচনে জয়-পরাজয় স্বীকারের মানসিকতা গড়ে তোলা জরুরি। ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে নয়, গণতন্ত্রের স্বার্থে তাঁরা তত্ত্বাবধায়ক চেয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হবে এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি হবে।
এর আগে গত ২১ অক্টোবর নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে আপিলের শুনানি শুরু হয়। পরে গত ২২ অক্টোবর নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে আপিলের দ্বিতীয় দিনের শুনানি শেষ হয়। এ দু’দিন রিটকারী বদিউল আলম মজুমদারের পক্ষে শুনানি শেষ করেন আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া। এরপর গত ২৩ অক্টোবর তৃতীয় দিনের মতো মামলাটির শুনানি হয়।
আপিলের চতুর্থদিন গত ২৮ অক্টোবর শুনানি করেন জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে শুনানি শেষ করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। এরপর গত ২৯ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে আপিলের ৫ম দিন, গত ৩ ও ৪ নভেম্বর ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম দিনের মতো শুনানি করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
নবম দিন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
পরে গত ১০ দিনের মামলার সব পক্ষের আবেদনের শুনানি শেষে গত ১১ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ রায়ের জন্য আজ বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) রায়ের দিন ধার্য করেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাসংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী ১৯৯৬ সালে সংসদে গৃহীত হয়। পরে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন হলে, দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ ওই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে তা বাতিল করে দেন। ওই রায়ের পর ২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটি বিলুপ্ত করা হয়।
তবে আপিল বিভাগের সেই রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিক পৃথক আবেদন করেন। গত ২৭ আগস্ট সর্বোচ্চ আদালত সেই রিভিউ আবেদনগুলো মঞ্জুর করে আপিলের অনুমতি (লিভ টু আপিল) দেন। সেই আপিলের শুনানি নিয়ে আজ রায় ঘোষণা করলেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ।